‘দোয়েল’ এখনো সাধারণ গ্রাহকের ল্যাপটপ হয়ে উঠল না, দাম কম হলেও জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে

‘দোয়েল’ এখনো সাধারণ গ্রাহকের ল্যাপটপ হয়ে উঠল না, দাম কম হলেও জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে
দোয়েল ল্যাপটপ ফাইল ছবি

সুহাদা আফরিন, ঢাকা ।।

সরকারের সাশ্রয়ী ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ ‘দোয়েল’ এখনো সাধারণ গ্রাহকের ল্যাপটপ হয়ে উঠল না। নাম লেখাতে পারল না সরকারি দপ্তরের কেনাকাটার তালিকায়ও। অথচ এই সময়ের মধ্যে দেশীয় বেসরকারি কোম্পানি বাজারে নিজস্ব ল্যাপটপ ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। দোয়েল কেন পারল না? 

জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে দেশে তৈরি ল্যাপটপ সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে দোয়েলের উৎপাদন শুরু হয়। দায়িত্ব পায় টেলিফোন শিল্প সংস্থা (টেশিস)। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির অংশ ছিল এই দোয়েল। ২০১১ সালের ১১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ল্যাপটপের উদ্বোধন করেন। গত দশ বছরে একটু একটু করে বাংলাদেশ ডিজিটাল হয়েছে। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশের আইকন হতে পারল না দোয়েল। কেন? 

মূলত চাহিদাপত্র পেয়ে সরকারের কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্য দোয়েল তৈরি করেছিল টেশিস। এর বাইরে কিছু ল্যাপটপ বিক্রি হয় বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) বিক্রয়কেন্দ্রে। এই সীমিত গণ্ডির কারণেই কি ডানা মেলতে পারল না দোয়েল? 

বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি (বিসিএস) থেকে জানা যায়, দেশে প্রতি বছর কম্পিউটার ও ল্যাপটপের চাহিদা পাঁচ লাখের মতো। আর নয় বছরে দোয়েল ল্যাপটপের উৎপাদন মাত্র ৮০ হাজার, যার মধ্যে ৬০ হাজার ল্যাপটপ তৈরি হয়েছিল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ডাক বিভাগ, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রকল্প, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগসহ সরকারের কিছু দপ্তরের জন্য। বাকি ২০ হাজার সাধারণ গ্রাহকের জন্য বিক্রি হয় নির্দিষ্ট বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে। চীন ও তাইওয়ান থেকে যন্ত্রাংশ এনে টেশিস টঙ্গীতে দোয়েল ল্যাপটপ সংযোজন (এসেম্বল) করে থাকে। এ পর্যন্ত ১১টি মডেলের ল্যাপটপ উৎপাদন করেছে তারা। 

টেশিস জানায়, দেশীয় উদ্যোগে ল্যাপটপ তৈরির কথা বলা হলেও শুরু থেকে এ পর্যন্ত সরকারি কোনো বরাদ্দ তারা পায়নি। ২০১০-১১ অর্থবছরে দোয়েল ল্যাপটপের জন্য বিটিসিএল থেকে ৯৫ কোটি টাকা প্রকল্প সহায়তা দেওয়া হয়। যার মধ্যে বিটিসিএলের অপটিক্যাল নেটওয়ার্ক ইউনিট প্রকল্পের জন্য ৫০ কোটি টাকা এবং বাকি মাত্র ৪৫ কোটি টাকা বিটিসিএলের পণ্য সরবরাহের মূল্য সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিশোধ করা হচ্ছে।

দোয়েল ল্যাপটপ কিনতে হলে বিটিসিএলের টেলিফোন বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে যেতে হবে। রাজধানীর রমনা, নীলক্ষেত বিটিসিএল অফিসে দোয়েল বিক্রি হয়। শেরেবাংলা নগরে বিক্রয়কেন্দ্র করা হলেও সেখানে বিক্রি শুরু হয়নি। আগারগাঁওয়ের আইডিবি ভবনে একটি বিক্রয় কেন্দ্র আছে। ঢাকার বাইরে আছে টঙ্গী, খুলনা ও রাজশাহীতে একটি করে বিক্রয় কেন্দ্র। দোয়েলের কোনো প্রচারও নেই। তাদের ওয়েবসাইটটিও সচল নয়।

দোয়েল ল্যাপটপ বিষয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি মো. শাহিদ-উল-মুনীর প্রথম আলোকে বলেন, কোনো পণ্য যখন বাজারে সহজে পাওয়া যায় না, তখন তার চাহিদা কমে যায়। দোয়েলের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। 

বাজারে ‘বদনাম’

দোয়েল ল্যাপটপ দ্রুত গরম হয়ে যায়, চার্জ থাকে না, ঠিকমতো কাজ করে না—এ রকম অভিযোগ ছিল শুরুতে। এ বিষয়ে টেশিস কর্মকর্তারা বলেন, আসলে সেই ২০১১ সালে ১০ হাজার টাকায় মোটামুটি মানের ল্যাপটপও দেওয়া সম্ভব ছিল না। একটি ল্যাপটপের অপারেটিং সিস্টেমের দামই আট হাজার টাকা। কিন্তু সরকারের ঘোষণার কারণে ১০ হাজার টাকার মানের একটি ল্যাপটপ তৈরি করা হয়। এই দামে যে ল্যাপটপটি তখন দেওয়া হয় তা মূলত অ্যান্ড্রয়েড ফোনের ল্যাপটপ ভার্সন ছিল। ফলে মান ভালো ছিল না। 

টেশিস কর্মকর্তারা বলেন, এখন তাঁরা ভালো মানের ল্যাপটপ তৈরি করছেন। কিন্তু বাজারে যে ‘বদনাম’ হয়েছে, তা আর কাটেনি। সরকারের ক্রয় প্রক্রিয়াতেও তারা ঢুকতে পারেনি।

জানতে চাইলে প্রযুক্তি পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান স্টার টেক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের ল্যাপটপ বিভাগের প্রোডাক্ট ম্যানেজার রাজু আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, শুরুর দিকে খুব কমসংখ্যক গ্রাহক এসে দোয়েলের কথা জিজ্ঞেস করত। কিন্তু দোয়েল শুরুতেই নিজের ভাবমূর্তি নষ্ট করে ফেলেছে। 

টেশিসের মূল্যায়ন

টেশিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত দোয়েল ল্যাপটপ থেকে টেশিসের আয় প্রায় ৩৪১ কোটি টাকা এবং ব্যয় প্রায় ৩২৫ কোটি টাকা। তাদের লাভ প্রায় ১৬ কোটি টাকা।

টেশিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফখরুল হায়দার চৌধুরী লিখিত বক্তব্যে প্রথম আলোকে বলেন, শুরুতে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে অনভিজ্ঞতা, প্রচার প্রচারণা, সার্ভিস সেন্টার, দক্ষ মেরামত কর্মীর স্বল্পতা প্রভৃতি কারণে দোয়েল বাজার ধরে রাখতে পারেনি। তবে টেশিস এখন ল্যাপটপের মান নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে।

আবার ডানা মেলার চেষ্টা

গত ২৯ ডিসেম্বর টঙ্গীতে টেশিসে গিয়ে দেখা যায়, কর্মীরা ল্যাপটপ সংযোজনের কাজ ছাড়াও টেলিভিশন, মুঠোফোন সংযোজনও করছে। দোয়েলের বর্তমান অপারেটর সংখ্যা ৪৭ জন। এখন বাজারে দোয়েলের ১৫ হাজার টাকা থেকে ৭৫ হাজার টাকা দামের ল্যাপটপ পাওয়া যায়।

দোয়েল ল্যাপটপের রাজধানীর বিক্রয়কেন্দ্রগুলোর ইন চার্জ এ বি এম নাহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, নীলক্ষেতে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ল্যাপটপ বিক্রি শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত ৪০টি ল্যাপটপ বিক্রি হয়েছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত আইডিবিতে বিক্রয় কেন্দ্র থেকে ২৭০টি ল্যাপটপ বিক্রি হয়। এ ছাড়া রাজশাহীতে গত দুই বছরে ৩০টি ল্যাপটপ এবং খুলনাতে ১৫টি ল্যাপটপ বিক্রি হয়েছে।

ঢাকার বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে মাসে ৭০-১০০টি ল্যাপটপ বিক্রি হয় বলে জানান এবিএম ওয়াহিদুজ্জামান। তিনি বলেন, তাদের ফ্রিডম নামের ১৫ হাজার টাকার ল্যাপটপটি বেশি বিক্রি হচ্ছে। এর বাজার মূল্য ২২ হাজার টাকা। কিন্তু মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এটি ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করতে বলেছেন।

শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্প (১ম পর্যায়) ২০১৮ সালে ১৩ হাজার ২৬০টি দোয়েল ল্যাপটপ নেয়। প্রকল্পটির দ্বিতীয় পর্যায়ের পরিচালক মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী প্রথম আলোকে বলেন, ল্যাপটপগুলো এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে। মাঠপর্যায় থেকে বড় ধরনের কোনো অভিযোগ আসেনি।

দোয়েলের ভাবমূর্তি ভালো করার জন টেশিস কাজ করছে বলে জানান এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি বলেন, আধুনিকায়ন, উৎপাদন ও সংযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সাধারণ মানুষের কাছে বিভিন্ন মডেলের স্বল্প মূল্যের ল্যাপটপ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। আর ল্যাপটপের যন্ত্রাংশ আমদানির জন্য কিছুটা শুল্ক সুবিধা পেলে ভালো মানের ল্যাপটপ আরও কম দামে দেওয়া যাবে।

টেশিস জানায়, এই মুহূর্তে তাদের স্টকে দুটি মডেলের ল্যাপটপ আছে। একটি কোর আই-৭, অষ্টম জেনারেশনের। এর ফিচারগুলো- ৮ জিবি র‌্যাম, এক টেরাবাইট হার্ডডিস্ক, ইনটেল এইচডি গ্রাফিকস ৬২০, ১৪ ইঞ্চি মনিটর। এর বিক্রয় মূল্য ৭৫ হাজার ২৯৫ টাকা। আরেকটি মডেল ফ্রিডম। যার ফিচার হচ্ছে ইনটেল কিউএন ৪২০০, ৪ জিবি র‌্যাম, সাধারণ গ্রাফিকস, এক টেরাবাইট হার্ডডিস্ক, ১৪ ইঞ্চি মনিটর। এর বাজার মূল্য ২২ হাজার হলেও এখন ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের বিভিন্ন ল্যাপটপের তুলনায় দোয়েলের দাম কম। তবে জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ ভেবেছিল দোয়েল তাদের জন্য একটি সাশ্রয়ী বিকল্প হবে। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সরকারি ব্যবসার ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা থাকে। এ থেকে শিক্ষা নিয়েই সরকারকে এগুতে হবে।