আজ পবিত্র লাইলাতুল কদর , শবে কদরের নামাজের নিয়ত-নিয়ম ও দোয়া

আজ পবিত্র লাইলাতুল কদর , শবে কদরের নামাজের নিয়ত-নিয়ম ও দোয়া
আজ লাইলাতুল কদর , শবে কদরের নামাজের নিয়ত-নিয়ম ও দোয়া

লাইলাতুল কদর। মহিমান্বিত এক রাত। যে রাতকে আল্লাহ তাআলা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলেছেন। পবিত্র কোরআনের সুরাতুল কদরে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আমি কোরআন নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি কি জানেন, লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাতে ফেরেশতারা ও জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর নির্দেশে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করেন। এ রাতের ফজর পর্যন্ত প্রশান্তি বর্ষিত হয়।’ (সুরা কদর: ১-৫)

হাজার মাসের চেয়ে উত্তম অর্থ শুধু যে একহাজার মাসের চেয়ে উত্তম-বিষয়টি এমন নয়, বরং অনেক বেশি বোঝাতেও হাজার শব্দটা ব্যবহার করা হয়। তারপরও আমরা যদি এখানে শুধু এক হাজার মাসই ধরি এর সময় দাঁড়ায় ৮৩ বছর ৪ মাস। তার মানে ৮৩ বছর ৪ মাস পর্যন্ত ইবাদত করার যে ফজিলত বা সওয়াব পাওয়া যায় তা এই এক রাতের ইবাদতেই মহান আল্লাহ প্রদান করে থাকেন।

আরবি ‘লাইলাতুল কদর’ এর ফারসি ‘শবে কদর’। লাইলাতুন বা শব-এর অর্থ রাত। কদর-এর অনেক অর্থ, যেমন- পরিমাপ, পরিমাণ, নির্ধারণ, ভাগ্য নিরূপণ, সম্মান, গৌরব, মর্যাদা ও মহিমা। সুতরাং ‘লাইলাতুল কদর’ বা ‘শবে কদর’ অর্থ সম্মানিত, মর্যাদাপূর্ণ, মহিমান্বিত ও ভাগ্যনির্ধারণী রজনী।

এ রাতকে ‘লাইলাতুল কদর’ বলার কারণ হচ্ছে, এ রাতের পূর্বে আমল না করার কারণে যাদের কোনো সম্মান মর্যাদা, মূল্যায়ন ছিল না তারাও তওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদতের মাধ্যমে এ রাতে সম্মানিত ও মহিমান্বিত হয়ে যান। (তাফসিরে মারেফুল কোরআন) রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে ইবাদতের মধ্যে রাত জাগবে, তার আগের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’ (সহিহ বুখারি: ৩৫) 

রাসুলুল্লাহ (স.) আরও বলেন, ‘এ মাসে (রমজানে) এমন একটি রাত আছে, যা হাজার রাতের চেয়ে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে সত্যিই বঞ্চিত হলো।’ (সুনানে নাসায়ি: ২১০৮)

রাতটির এত বড় মর্যাদার কারণ হলো— এ রাতেই পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি একে অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে।’ (সুরা দুখান: ৩)

শবে কদরের কিছু মাসনুন আমল সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হলো—

১) পরিচ্ছন্ন হওয়া: লাইলাতুল কদরের বরকত লাভের প্রধান শর্ত হলো ভেতর ও বাইরের পবিত্রতা লাভ এবং একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর দরবারে হাজির হওয়া। আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলি বলেন—‘উত্তম হলো- যে রাতে কদর অনুসন্ধান করা হবে, তাতে পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, গোসল-সুগন্ধি-উত্তম কাপড়ের মাধ্যমে সৌন্দর্যবর্ধন করা। আর বাহ্যিক সৌন্দর্য সৌন্দর্যের জন্য যথেষ্ট নয়, যদি না মানুষের ভেতরটা সুন্দর হয়। মানুষের ভেতর সুন্দর হয় তওবা ও আল্লাহমুখী হওয়ার মাধ্যমে।’ (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা- ১৮৯)

২) মাগরিব, এশা ও ফজর নামাজ জামাতে আদায় করা: কদরের রাতে মাগরিব, এশা ও ফজর নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা উচিত। তাহলে হাদিস অনুযায়ী শবে কদরের ফজিলত লাভ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি এশা ও ফজর জামাতের সঙ্গে পড়ে, সে যেন সারা রাত দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে।’ (মুসলিম: ৬৫৬)

৩) রাত জেগে ইবাদত: সারারাত নিজে ইবাদত-বন্দেগি করা এবং পরিবারের সবাইকে ইবাদত করার জন্য জাগিয়ে দেওয়া। বছরের অন্য কোনোরাতে সারারাত জেগে ইবাদত করার ব্যাপারে এত বেশি গুরুত্ব নবীজির জীবনীতে দেখা যায় না। সাধারণত তিনি এশার নামাজের পরে বেশি দেরি করতেন না, দ্রুত ঘুমিয়ে যেতেন এবং মধ্যরাতে জেগে ইবাদত করতেন। কিন্তু শবে কদরে তিনি সারারাত জেগে ইবাদত করতেন এবং পরিবারের অন সদস্যদেরও উদ্বুদ্ধ করতেন। আম্মাজান আয়েশা (রা.) বলেন, ‘যখন রমজানের শেষ ১০ রাত আসত, তখন নবী কারিম (স.) কোমরে কাপড় বেঁধে নেমে পড়তেন (বেশি বেশি ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত জেগে থাকতেন। আর পরিবার-পরিজনকেও তিনি জাগিয়ে দিতেন।’ (বুখারি: ১০৫৩)

৪) কোরআন তেলাওয়াত করা: পবিত্র কোরআনের তেলাওয়াত কদরের রাতের বিশেষ আমল। কেননা এই রাতেই কোরআন নাজিল হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আমি কোরআন নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে।’ (সুরা কদর: ১) পুরো রমজানজুড়েই কোরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব রয়েছে। হাদিসে এসেছে, জিব্রাইল (আ.) প্রত্যেক রমজানে নবীজির সাথে কোরআন তেলাওয়াতে অংশ নিতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রমজান মাসের প্রতি রাতে জিব্রাইল (আ.) রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে উপস্থিত হতেন এবং তাঁরা উভয়ই পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করে একে অপরকে শোনাতেন।’ (বুখারি: ৬) সুতরাং রমজানের শেষ দশকে বিশেষ করে বিজোড় রাতগুলোতে আমরা যেন বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করি এবং শবে কদরে কোরআন তেলাওয়াতের মতো আমল মিস না করি।

৫) কিয়ামুল্লাইল করা: রমজানের শেষ দশকের বিশেষ ইবাদতের নাম কিয়ামুল্লাইল। কেননা এর সঙ্গে শবে কদরের সম্পর্ক রয়েছে। একারণেই কিয়ামুল্লাইল শব্দটির সঙ্গে কদর শব্দটি জুড়িয়ে দিয়েছেন রাসুলুল্লাহ (স.)। সহিহ বুখারির বর্ণনায় তিনি ইরশাদ করেছেন,  مَنْ قَامَ لَيْلَةَ القَدْرِ إِيمانًا واحْتِسَابًا، غُفِر لَهُ مَا تقدَّم مِنْ ذنْبِهِ - متفقٌ عَلَيْهِ ‘কদরের রাতে যে কিয়ামুল্লাইল করে বিশ্বাস নিয়ে এবং নাজাতের প্রত্যাশায়, আল্লাহ তাআলা তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (মুত্তাফাকুন আলাইহ) 

সুতরাং আমরা যেন কদরের রাতে কিয়ামুল্লাইল বা লম্বা সময় ধরে সালাত আদায় করি। লম্বা সময় দাঁড়িয়ে ক্বেরাত পড়া ও দীর্ঘ সেজদা করা কেয়ামুল্লাইলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নবীজির কিয়ামুল্লাইল সম্পর্কে আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নামাজে দাঁড়িয়ে নবীজি এত দীর্ঘ সময় তেলাওয়াত করতেন যে, তাঁর পা মোবারক ফুলে যেত।’ (দ্রষ্টব্য- সহিহ মুসলিম: ২৮১৯, ২৮২০)

৬) কদরের রাতের দোয়া: আয়েশা (রা.) রাসুলুল্লাহ (স.)-কে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি জানতে পারি লাইলাতুল কদর কোনটি, তাহলে আমি সে রাতে কী বলব? তিনি বলেন, ‘তুমি বলো, ﺍﻟﻠَّﻬُﻢَّ ﺇِﻧَّﻚَ ﻋَﻔُﻮٌّ ﺗُﺤِﺐُّ ﺍﻟْﻌَﻔْﻮَ ﻓَﺎﻋْﻒُ ﻋَﻨِّﻲ উচ্চারণ: ‘আল্লা-হুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী’ (আরবি উচ্চারণ দেখে পড়বেন)। অর্থ: ‘হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করাটা আপনার পছন্দ। অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ (সুনানে তিরমিজি: ৩৫১৩)। 
সুতরাং সারাদিন-রাত বেশি বেশি এই দোয়া করবেন। এই দোয়াটি হাঁটা-চলা-শোয়া অবস্থায় করা যায়। শেষ দশকে বেশি বেশি পড়া উচিত। 

উল্লেখ্য, শবে কদরের নামে কোনো বিদআতে জড়াবেন না। ইসলামি শরিয়তে লাইলাতুল কদরের বিশেষ কোনো নামাজ কিংবা পদ্ধতি নেই। কদরের নামাজে বিশেষ সুরা পড়তে হবে-এমন কথা লোকমুখে প্রচলিত আছে। এর কোনো ভিত্তি ইসলামে নেই। নামাজের আলাদা কোনো দোয়া বা মোনাজাতও নেই। অনেকে তিন বার করে সুরা পড়েন। এসব বিশুদ্ধ পদ্ধতি নয়, জরুরি বা বাধ্যতামূলকও নয়। নিজের মতো করে দোয়া করবেন, নামাজে সুরা কেরাত পড়বেন অন্য সময়ের নফল নামাজের মতো। আল্লাহ তাআলা আমাদের লাইলাতুল কদর নসিব করুন। সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত করুন। 

শবে কদরের নামাজের নিয়ত

নাওয়াইতু আন্‌ উছাল্লিয়া লিল্লাহি তা’য়ালা রাকআতাই সালাতিল লাইলাতিল কাদ্‌রি নফ্‌লে মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি- আল্লাহু আকবর।

অর্থ: আমি কাবামুখী হয়ে আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্য শবে কদরের দুই রাকআত নফল নামাজ পড়ার নিয়ত করলাম- আল্লাহু আকবর।

লাইলাতুল কদর নামাজের নিয়ম

লাইলাতুল কদরে বিশেষ কোনও নামাজের পদ্ধতি নেই। লাইলাতুল কদরের রাতে নামাজ দুই রাকাত করে যত সুন্দর করে, যত মনোযোগ সহকারে পড়া যায় ততই ভালো। দুই রাকাত, দুই রাকাত করে আপনি যত খুশি পড়তে পারবেন। এই রাতে কোরআন তেলাওয়াত করবেন। বেশি বেশি দোয়া পড়বেন। ইস্তেগফার পড়বেন। তওবা করবেন। 

এই রাতে যে দোয়া বেশি পড়বেন

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, শবে কদরের রাতে আমার কোন দোয়াটি পড়া উচিত?’ তিনি তাঁকে পড়ার জন্য নির্দেশ দিলেন-

اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي

উচ্চারণ: 'আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন; তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।’

অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল; ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিজি, মিশকাত)

লাইলাতুল কদর সুরা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, ইন্না আনযালনাহু ফী লাইলাতিল কদর। অমা আদরা কামা লাইলাতুল কাদর। লাইলাতুল কাদরি খাইরুম মিন আলফি শাহর। তানাযযালুল মালায়িকাতু অররূহু ফীহা বিইযনি রাব্বিহিম মিন কুল্লি আমরি। সালামুন হিয়া হাত্তামাত্ব লাই’ল ফাজ্বর।

বাংলা অর্থ:  শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু। নিশ্চয় আমি এটা (কুরআন) কদর রাতে নাযিল করলাম। আর আপনি কি জানেন, মহিমান্বিত রাত কি? কদর (মহিমান্বিত) রাত, হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সে রাতে প্রত্যেক বরকত পূর্ণ বিষয় নিয়ে ফেরেশতা ও রূহ (জিবরাঈল) (দুনিয়াতে) অবতীর্ণ হয়, স্বীয় রবের নির্দেশে। সে রাতে সম্পূর্ণ শান্তি, ফজর পর্যন্ত বিরাজিত থাকে।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;