আদালতে পিয়ন, পেশকার, আরদালি পুলিশ সবাইকে বাধ্যতামূলক বকশিশ’ দিতেই দিশেহারা বিচারপ্রার্থীরা

হিরা তালুকদার ।।

আদালতে পিয়ন, পেশকার, আরদালি পুলিশ সবাইকে বাধ্যতামূলক বকশিশ’ দিতেই দিশেহারা বিচারপ্রার্থীরা
পিয়ন, পেশকার, আরদালি পুলিশ সবাইকে বকশিশ দেওয়া বাধ্যতামূলক
 
আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা সচেতন না হলে এটা বন্ধ করা কঠিন : আইনমন্ত্রী
 
মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলে বকশিশ বাণিজ্য : আইনজীবী
 
বকশিশ বন্ধে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন সিএমএম : বার সম্পাদক রচি
 
এখানে এসে মনে হচ্ছে আমিই আসামি : একটি মামলার বাদী জেসমিন
 
আদালতের ভোগান্তির থেকে জেলে থাকাও ভালো : বিচারপ্রার্থী মহসিন


একটা কথা চালু আছে ঢাকার নিম্ন-আদালতে। তা হচ্ছে- ‘আদালতের আঠারো ঘাটে পয়সা গুনতে হয় বিচারপ্রার্থীদের।’ এই আঠারো ঘাটের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট না হলেও সেখানে যে পদে পদে ঘুষ দিতে হয় সেটা এখন ওপেন সিক্রেট। সময়ের আলোর অনুসন্ধানেও ওঠে এসেছে এই ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি। যদিও সেখানকার উকিল, মুহুরি, পিয়ন, পেশকার ও পুলিশ কেউই এটাকে ‘ঘুষ’ বলতে নারাজ। তাদের ভাষ্য, নির্বিঘ্নে কাজ শেষ করতে ‘বকশিশ’ দিতে হয় অনেককে।
সময়ের আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে- বিচারপ্রার্থীদের নিম্ন (বিচারিক) আদালতে প্রায় প্রতিটি ধাপে নিয়মবহির্ভূত যে অর্থ গুনতে হয় কর্মচারীরা তাকে বলেন ‘বকশিশ’ বা ‘খরচাপাতি’। আদালতে এই বকশিশ আদান-প্রদানের ‘ঐতিহ্য’ অনেক পুরনো হলেও আগে এই বকশিশের নির্ধারিত হার ছিল না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্ধারিত হারে বকশিশ দেওয়াটা বিচারপ্রার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। মামলার নথি দেখা, হাজিরা দেওয়া, ওকালতনামায় সই করা, জামিননামা দেওয়া, জামিনের শুনানি করা, মামলার নকল তোলাসহ মামলা সংক্রান্ত যেকোনো সেবায় বকশিশ দিতেই হয়। এটা বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকেই নেন আইনজীবী অথবা আইনজীবীর সহকারীরা। আর তারাই মামলার প্রয়োজনে ঘাটে ঘাটে বিলান এসব ঘুষ বা বকশিশ। অনেক আইনজীবী আবার অতি উৎসাহি হয়ে কিংবা নিজেদের ‘কমিশন’ রেখে দিয়ে বকশিশ বিলান। আর এতে করে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বিচারপ্রার্থীদের। বিশেষ করে ঢাকার বিচারিক আদালতে আসা দরিদ্র ও নিম্ন-আয়ের বিচারপ্রার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে মামলা চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনুসন্ধানে এমনটাও উঠে এসেছে, অনেকে বসতবাড়ী পর্যন্ত বিক্রি করে বিচারের শেষ দেখতে পাননি। তাই মামলা চলমান থাকতেই তা আর না চালিয়ে বিচারাঙ্গন ছেড়ে চলে গেছেন।
১৬ অক্টোবর কথা হয় বিচারপ্রার্থী ঢাকার পল্লবীর মহসিন ব্যাপারীর সঙ্গে। একটি ফৌজদারি মামলার আসামি তিনি। বর্তমানে জামিনে আছেন। এসেছেন হাজিরা দিতে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেনÑ এখানে পিয়ন, পেশকার, আরদালি, পুলিশ সবাইকে টাকা দিতে হয়। না দিলে কোনো নথি ‘নড়বে’ না। বছরের পর বছর পড়ে থাকবে। আর আমার আইনজীবীর সঙ্গে টাকা না দিলে তো কথাই বলা যায় না। আমার বসতবাড়ীও বিক্রি করে দিয়েছি মামলা চালাতে গিয়ে। এখন মনে হয়, আদালতের এই ভোগান্তির থেকে জেলে থাকাও ভালো।’
একই দিন নারী নির্যাতন সংক্রান্ত একটি ফৌজদারি মামলার বাদী ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার জেসমিন আক্তার বলেন, ‘মামলার টাকা ভূতে জোগায় এমন কথার প্রচলন আছে। টাকা কোনো মতে জোগাড় করে মামলায় খরচ করেছি ঠিকই, কিন্তু এখন প্রায় নিঃস্ব। বিচার কবে শেষ হবে আল্লাহই জানেন।’ তিনি বলেন, ‘আমি মামলার আসামি না, একজন বাদী। অথচ এখানে সবাইকে এমনভাবে ঘুষ দিতে হয়, আইনজীবী যেভাবে টাকা নেয়, সবাই যে আচরণ করে, তাতে মনে হচ্ছে আমিই আসামি।’
আদালতে এসব বকশিশ বা খরচাপাতির ব্যবস্থা চরম দুর্নীতির বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন আইনজীবীরাই। কিন্তু এই দুর্নীতি ঠেকানোর কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। এ বিষয়ে নেই কোনো নজরদারিও। আদালত সংশ্লিষ্ট সবার সামনেই ঘটছে এসব। কিন্তু সবাই নীরব। নিজে বিপদে পড়বেন ভেবে সামনে পড়তে চান না কোনো আইনজীবী। অনেকেই নাম প্রকাশ না করে অভিযোগের ফিরিস্তি দিয়েছেন এ প্রতিবেদকের কাছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক আইনজীবী বলেন, মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলে অবৈধ বকশিশ বাণিজ্য, যার সবটাই বহন করতে হয় বিচারপ্রার্থীকে। পুলিশ, পেশকার, পিয়ন, আরদালিসহ আদালত সংশ্লিষ্ট সবাই অবৈধভাবে এসব পয়সা বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে নিয়ে থাকে। এটা চরম দুর্নীতি।’ ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সামনে ১৭ অক্টোবর কথা হয় দুজন আইনজীবীর সঙ্গে। তারাও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বকশিশ কত দিতে হবে তা আগে ধরা বাঁধা ছিল না। এখন প্রতিটি ধাপে একটি নির্ধারিত সীমা বেঁধে দিয়েছেন কর্মচারী ও আদালত-পুলিশ। ওই সীমার নিচে বকশিশ দেওয়া যায় না। নির্ধারিত হারে না দিলে কী হয় জানতে চাইলে তাদের একজন (সূত্রাপুরের বাসিন্দা, বার ভবনে চেম্বার) বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে ওই আইনজীবী অন্য কোনো মামলা নিয়ে গেলে তাকে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী বা পুলিশ সহযোগিতা করে না। আদালত-পুলিশ ও কর্মচারীদের হাতে অনেকটা জিম্মি আইনজীবীরা। যদিও এসব খরচাপাতি বিচারপ্রার্থীর কাছ থেকেই নেওয়া হয়। সব চাপ তাদের ওপর।’
এ ব্যাপারে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান খান রচি সময়ের আলোকে বলেন, ‘চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আমাদের ডেকে বলে দিয়েছেনÑ কোনো আইনজীবী যেন আদালত সংশ্লিষ্ট কাউকে বকশিশের নামে ঘুষ না দেন। যেকোনোভাবেই হোক আদালতের ভাবমূর্তি নষ্ট করা যাবে না। বিচারপ্রার্থীরা যেন ভোগান্তিতে না পড়েন।’ তিনি বলেন, ‘আমরাও তার নির্দেশনা সব আইনজীবীর কাছে পৌঁছে দিয়েছি। অথচ এখনও অনেক আইনজীবী দ্রুত কাজ শেষ করতে বকশিশ দিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাচ্ছি। এ জন্য অনেক ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীরাও দায়ী। তারাও অনেক সময় বাড়তি টাকা দিয়ে দ্রুত কাজ করাতে চান।’
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি গাজী শাহ আলম বলেন, ‘সুস্থধারার আইন চর্চার জন্য বিজ্ঞ আইনজীবী এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে আইন পেশা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ঢাকা আইনজীবী সমিতি অভিযোগ শুনানি ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখছে। এখানে কোনো আইনজীবী নিয়ম বর্হিভূত কিছু করলে বার তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।’
সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু এ ব্যাপারে বলেন, ‘একজন বিচারপ্রার্থী আদালতে আসে সেবা নিতে, কিন্তু টাকা গুনতে গুনতে তাকে নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। এত জায়গায় ঘুষ বোধ হয় দেশের আর কোনো প্রতিষ্ঠানে দিতে হয় না। ঢাকা বার এ ব্যাপারে কিছু উদ্যোগ নিলেও তা তেমন কাজে আসেনি।’
আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হকও ঢাকার নিম্ন-আদালতে ‘বকশিশ বাণিজ্যের’ বিষয়টি স্বীকার করে বলেনÑ ‘সব বিচারক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বলা হয়েছে, যাতে এ ধরনের বকশিশ প্রথা বন্ধ হয়। বর্তমানে এটা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা আরেকটু সচেতন হলে এধরনের ঘটনা ধীরে ধীরে আরো কমে আসবে।’ এক্ষেত্রে কাউকে অতি উৎসাহি হয়ে বা দ্রুত কাজ সারতে বকশিশ দেওয়ার মানসিকতা পরিহার করতে পরামর্শ দেন তিনি।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে পুলিশের একজন জিআরও বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। আসার পর থেকে কারো কাছ থেকে ঘুষ বা বকশিশের বিনিময়ে কাজ করিনি। আগে কেউ করে থাকলে সেটা বলতে পারব না।’ সিএমএম আদালতের একজন পেশকারও বকশিশের বিনিময়ে কাজ করার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘এই কোর্টে বকশিশের বিনিময়ে কোনো কাজ হয় না। অন্য কোর্টের কথা আমি জানি না।’
এদিকে, আইনজীবী, আইনজীবীর সহকারী ও বিচারপ্রার্থী বা তাদের তদবিরকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, থানার এজাহার আদালতের পুলিশ প্রসিকিউশন বিভাগের জিআর (সাধারণ নিবন্ধন) শাখায় থাকে। সংশ্লিষ্ট আদালতের জিআর শাখায় পুলিশকে কমপক্ষে ২০০ টাকা দিয়ে মামলার এসব কাগজপত্র তুলতে হয়। মামলার গুরুত্ব অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রে ৫০০ বা হাজার টাকাও দিতে হয় পুলিশকে। আসামি আদালতের হাজতখানা বা কারাগারে থাকলে সেখান থেকে ওকালতনামায় আসামির সই আনতে আসামিপক্ষ থেকে ৫০-৫০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। জামিনের জন্য পুটআপ নিতে সংশ্লিষ্ট আদালতের কর্মচারী, পিয়ন ও উমেদারদের ৫০ থেকে ১০০ টাকা বখশিশ দিতে হয়। জামিন হলে সিএফের জন্য জিআরওকে ২০০ থেকে হাজার টাকাও দিতে হয়। যদি জামিন নামা দাখিল করা হয় তা হলে তা লেখা ও রিলিজ অর্ডার কারাগারে পাঠানোর জন্য ডেস্কপাস শাখায় পাঠাতে হয়। এ ক্ষেত্রেও ১০০ থেকে ২০০ বা তার বেশি টাকা জিআর শাখার মুন্সীকে (সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্য) দিতে হয়। বিশেষ ব্যবস্থায় রিলিজ অর্ডার পাঠিয়ে আসামিকে কারাগার থেকে দ্রুত মুক্ত করতে হাজারের বেশি টাকা গুনতে হয় আসামির স্বজনদের। অন্যদিকে, আসামিকে হাজিরা দিতে জিআর শাখায় সংশ্লিষ্ট থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশকে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বা তারও বেশি করে দিতে হয়। আবার বিচারাধীন মামলায়ও একই হারে টাকা দিতে হয় পেশকার ও পিয়নদের। আসামি খালাস পেলে তো কথাই নেই। ঘাটে ঘাটে বকশিশ দিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় সবাইকে। - সময়ের আলো ।