আল্লাহর অলৌকিক সৃষ্টি 'আরশ ও কুরসি'

আল্লাহর অলৌকিক সৃষ্টি 'আরশ ও কুরসি'
আল্লাহর অলৌকিক সৃষ্টি আরশ ও কুরসি

মাওলানা শামসুদ্দীন সাদী ।।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অধিষ্ঠিত রয়েছে আরশে আজিমে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে ‘তিনি পরম দয়ালু, তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন।’ (সুরা তহা : ৫)। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহ, যিনি ঊর্ধ্বদেশে স্থাপন করেছেন আকাশমন্ডলীকে স্তম্ভ ব্যতীত। তোমরা সেগুলো দেখ। অতঃপর তিনি আরশের ওপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন।’ (সুরা রাদ : ২)

তবে মহাবিশ্বেরর স্রষ্টা ও পরিচালক আল্লাহ তায়ালা কীভাবে আরশের ওপর অধিষ্ঠিত রয়েছেন সেটা অজ্ঞাত। মানুষের পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। ঈমানদারের উচিত কোরআনের আয়াতের প্রতি বিশ্বাস রাখা। আরশ বিদ্যমান রয়েছে ও আরশে আল্লাহ তায়ালা অধিষ্ঠিত আছেন এ বিশ্বাস রাখা।

আরশ সবচেয়ে বড় সৃষ্টি : মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় সৃষ্টি হলো আরশ। আরশের চেয়ে অতিকায় ও পরাবাস্তব কোনো বস্তু আল্লাহ সৃষ্টি করেননি। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘অতএব সর্বশীর্ষ মহিমাময় আল্লাহ, তিনি সত্যিকার মালিক, তিনি ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই। তিনি সম্মানিত আরশের অধিপতি।’ (সুরা মুমিনুন : ১১৬)। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) উল্লেখ করেছেন, ‘কেননা তিনি আরশের অধিপতি, যা সমস্ত সৃষ্টির জন্য ছাদস্বরূপ। সমস্ত আসমান ও সমস্ত জমিন এবং উভয়ের ভেতরে যা রয়েছে ও উভয়ের মাঝখানে যা রয়েছে, সব কিছু আরশের নিচে অবস্থিত।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির : ২/৪০৫)

আরশের ব্যাপ্তি : আরশের বিশালতা ও ব্যাপ্তি সাত আসমান, সাত জমিন ও কুরসি থেকেও বড়। আল্লাহর আরশ সাত আসমান সাত জমিন ও কুরসি সবগুলোকেই বেষ্টন করে আছে। হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আসমান ও জমিনের দূরত্ব পাঁচশ বছর, প্রত্যেক আসমানের দূরত্ব পাঁচশ বছর, সপ্তম আসমান ও কুরসির দূরত্ব পাঁচশ বছর, কুরসি ও পানির দূরত্ব পাঁচশ বছর, আরশ পানির ওপর, আল্লাহ আরশের ওপর। আল্লাহর কাছে তোমাদের কোনো আমল গোপন নয়। (বায়হাকি : ৪০১ পৃষ্ঠা)
ফেরেশতাগণ আরশ বহন করেন : নিশ্চয় আল্লাহর আরশ সবচেয়ে বড় সৃষ্টি।

এই বিশাল আরশ কীভাবে স্থির আছে? কারা বহন করছেন আরশ? এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা কোরআন মাজিদে ইরশাদ করেছেন, ‘যারা আরশ বহন করে এবং যারা তার চারপাশে আছে তাদের পালনকর্তার সপ্রশংসা পবিত্রতা বর্ণনা করে, তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে হে আমাদের পালনকর্তা! আপনার রহমত ও জ্ঞান সব কিছুতে পরিব্যাপ্ত। অতএব যারা তওবা করে ও আপনার পথে চলে তাদের ক্ষমা করুন এবং জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করুন।’ (সুরা গাফির : ৭)।

কেয়ামতের দিন আরশ বিশালদেহী আটজন ফেরেশতার কাঁধের ওপর থাকবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ফেরেশতাগণ আকাশের প্রান্ত দেশে থাকবে ও আটজন ফেরেশতা আপনার পালনকর্তার আরশকে তাদের ঊর্ধ্বে বহন করবে।’ (সুরা হাক্কাহ : ১৭)। আরশ বহনকারী ফেরেশতাদের বিশালতা সম্পর্কে হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর যেসব ফেরেশতা আরশ বহন করে আছে তাদের একজনের সঙ্গে কথা বলার জন্য আমাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তার কানের লতি থেকে কাঁধ পর্যন্ত স্থানের দূরত্ব হলো সাতশ বছরের দূরত্বের সমান।’ (আবু দাউদ : ৪৭২৭)। তা ছাড়া কিছু ফেরেশতা আরশের চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে দিনরাত আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আপনি ফেরেশতাগণকে দেখবেন, তারা আরশের চারপাশ ঘিরে তাদের পালনকর্তার পবিত্রতা ঘোষণা করছে। তাদের সবার মাঝে ন্যায় বিচার করা হবে। বলা হবে সমস্ত প্রশংসা বিশ্বপালক আল্লাহর।’ (সুরা জুমার : ৭৫)

আরশের রয়েছে খুঁটি : আরশের অনেক খুঁটি রয়েছে। যেভাবে সিংহাসনের খুঁটি থাকে। এ সম্পর্কে হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন সমস্ত মানুষ বেহুঁশ হবে। অতঃপর সর্বপ্রথম আমারই হুঁশ ফিরবে। তখন আমি মুসাকে (আ.) দেখতে পাব যে, তিনি আরশের খুঁটিসমূহের মধ্যে একটি খুঁটি ধরে রয়েছেন। আমি জানি না, আমার আগেই কি তাঁর হুঁশ এলো, নাকি তুর পাহাড়ে বেহুঁশ হওয়ার প্রতিদান তাকে দেওয়া হলো।’ (বুখারি : ৩৩৯৮)

আরশের সামনে সূর্যের সেজদা : সূর্য আল্লাহ তায়ালার বিস্ময়কর সৃষ্টি। প্রতিদিন ভোরে সূর্য উদিত হয় এবং সন্ধ্যায় অস্ত যায়। সূর্য তার নির্ধারিত কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান। প্রতি ঘূর্ণি শেষ করে সূর্য মহান আরশের সামনে সেজদানবত হয় এবং পুনরায় উদিত হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘সূর্য তার নির্দিষ্ট অবস্থানে আবর্তন করে।

এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ।’ (সুরা ইয়াসিন : ৩৮)। এই আয়াতের ব্যাখ্যা মহানবী (সা.) একটি হাদিসে উল্লেখ করেছেন। হজরত আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় নবীজি (সা.) হজরত আবু জরকে (রা.) বললেন, হে আবু জর! তুমি কি জান, সূর্য কোথায় অস্ত যায়? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসুল বেশি অবগত। নবীজি (সা.) বলেন, সূর্য চলে, অবশেষে আরশের নিচে গিয়ে সেজদা করে এবং অনুমতি প্রার্থনা করে। অতঃপর তাকে অনুমতি দেওয়া হয়। অচিরেই এমন দিন আসবে সূর্য সেজদা করবে কিন্তু তার সেজদা কবুল করা হবে না। সূর্য অনুমতি প্রার্থনা করবে কিন্তু তাকে অনুমতি দেওয়া হবে না। তখন সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হবে। (বুখারি : ৩১৯৯)

আসমান বেষ্টন করে আছে কুরসি : কুরসিও আল্লাহ তায়ালার অনেক বড় সৃষ্টি। অনেকে মনে করেন, কুরসি ও আরশ এক জিনিস। আসলে দুটি এক নয়। ভিন্ন ভিন্ন। কুরসি বলা হয় যেখানে আল্লাহ তায়ালার কুদরতি কদম মোবারক রাখেন। সেটা আরশের নিচে অবস্থিত। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘তার কুরসি সমস্ত আসমান ও জমিনকে পরিবেষ্টিত করে আছে।’ (সুরা বাকারা : ২৫৫)। এই আয়াতের তাফসিরে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘কুরসি হলো দুই পা রাখার স্থান এবং আরশের বিশালতার পরিমাণ আল্লাহ ছাড়া কেউ অনুমান করতে পারে না।’ (তাফসিরে তাবারি : ৩/১০)। হজরত আবু জর গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, নবীজিকে (সা.) কুরসি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো। তিনি বলেন, আরশের সামনে কুরসির তুলনা ভূপৃষ্ঠের কোনো ময়দানে নিক্ষিপ্ত আংটির মতো এবং কুরসির তুলনায় আরশের মর্যাদা আংটির তুলনায় ময়দানের মর্যাদার মতো।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া আম্বরশাহ আল
ইসলামিয়া, কারওয়ান বাজার, ঢাকা