করোনা ওলোটপালট করে দিয়েছে দেশের অর্থনীতি,ঘুরে দাঁড়ানোর আশা মহামারির খাদ থেকে

করোনা ওলোটপালট করে দিয়েছে দেশের অর্থনীতি,ঘুরে দাঁড়ানোর আশা মহামারির খাদ থেকে
করোনা সব ওলোটপালট করে দিয়েছে দেশের অর্থনীতি,ঘুরে দাঁড়ানোর আশা মহামারির খাদ থেকে

অর্থনীতি ডেস্ক ।।

বাংলাদেশ ২০২০ সালে রাজনৈতিক স্থিতির সঙ্গে অর্থনীতিতে যে স্বস্তি নিয়ে শুরু করেছিল, প্রথম প্রান্তিক না পেরোতেই করোনা ভাইরাস মহামারি সব ওলোটপালট করে দিয়েছে। শেষ প্রান্তিকে এসে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ জাগিয়ে রেখেছে শঙ্কা। সেই উদ্বেগ সঙ্গী করেই ২০২১ সালে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ।

আশার কথা হলো- এই মহামারি যতটা বিপদে বাংলাদেশকে ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল, সরকারের সময়োচিত বিভিন্ন পদক্ষেপে তা অনেক ক্ষেত্রে এড়ানো গেছে। সোয়া লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বড় ভূমিকা রেখেছে।

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো এ বছরই পূর্ণ অবয়ব পেয়েছে। সেই সঙ্গে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স সরকারকে যোগাচ্ছে সাহস।

পুরো বছরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, এই মহামারির প্রেক্ষাপটে ‘পৃথিবীর যে কোনো দেশের চেয়ে ভালো অবস্থায়’ রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।

‘সবাইকে অবাক করে দিয়ে এই মহামারিকালেও বেশি বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়ে চলেছেন আমাদের প্রবাসী ভাই-বোনেরা। এর উপর ভর করে ৪২ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে রিজার্ভ। রপ্তানি আয় এখনও ইতিবাচক। মূল্যস্ফীতি সহনীয়। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর পূর্ণ অবয়ব দেশবাসীর মতো আমাদেরও (সরকার) সাহসী করে তুলেছে। এই সাহস দিয়েই আমরা কোভিড-১৯ মোকাবেলা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব; জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘স্বপ্নের সোনার বাংলা’ গড়ে তুলব’।

করোনা ভাইরাসের টিকা আসার খবরও টিকে থাকার সাহস যোগাচ্ছে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের। পরিস্থিতি কতোদিনে স্বাভাবিক হবে, তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না। তবে দেশের অর্থনীতিকে আবার পথে ফেরানোই যে ২০২১ সালের মূল কথা হবে, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত।

আর সেজন্য অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের দিকেও মনোযোগী হওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যে ওষুধ খাওয়ানো প্রয়োজন, সেগুলো করতে হবে। অর্থাৎ যে রিফর্মসগুলো (সংস্কার) জোরালোভাবে চালানো দরকার, সেগুলো করতেই হবে। বিশেষ করে, রজস্ব আদায় বাড়াতে ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতেও জোরালো পদক্ষেপ দরকার’।

জিডিপিতে হোঁচট

ধারাবাহিক অগ্রগতির পথ ধরে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা বাংলাদেশ ২০১৯-২০ অর্থ বছরের জন্যও ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিল। কিন্তু মহামারির মধ্যে দুই মাসের লকডাউন আর বিশ্ব বাজারের স্থবিরতায় তা বড় ধাক্কা খায়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে আসে, যদিও এই অংক আরও কম হওয়ার কথা বলে অনেক বিশ্লেষকের ধারণা।

মহামারির বাস্তবতার মধ্যেই চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে সরকার। তবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অতটা আশা দিতে পারছে না।

গত অক্টোবরে বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, মহামারির ধাক্কায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসতে পারে। আর আগামি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে এই দাতা সংস্থাটি।

আর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এ কারণে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। 

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ভাষায়, বিশ্ব ব্যাংক যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তা ‘বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে’। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুঁরে দাঁড়িয়েছে। সবগুলো সূচকই এখন ভালো। আমার ধারণা, এবার আমাদের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের উপরে থাকবে’।খবর বিডিনিউজের

আহসান এইচ মনসুর বলছেন, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস ‘মোটামুটি’ গেছে। বাকি ছয় মাসে বড় ধরনের উন্নতি না হলে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন ‘কোনোভাবেই; সম্ভব নয়। একটা বিষয় আমি স্পষ্ট করে বলছি, এই কঠিন সময়ে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি যদি ৫ শতাংশও হয়, তাহলেও সেটা হবে খুবই ভালো হবে। পৃথিবীর অনেক দেশই এই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে না।

এ বছরের একটি আলোচিত বিষয় ছিল মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে বাংলাদেশের পেছনে ফেলার পূর্ভাভাস। আইএমএফ এর ওই পূর্বাভাস নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও ব্যাপক আলোচনা হয়।

গত অক্টোবরে আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের হিসাব ধরে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৪ শতাংশ বেড়ে এক হাজার ৮৮৮ ডলারে উন্নীত হতে পারে।

অন্যদিকে লকডাউনের কারণে সংকোচনের মুখে পড়া ভারতের মাথাপিছু জিডিপি সাড়ে ১০ শতাংশ কমে ১ হাজার ৮৭৭ ডলারে নামতে পারে।

তবে আগামি বছর ভারতের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার দ্রত হবে, তাতে মাথাপিছু জিডিপি বেড়ে সামান্য ব্যবধানে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আইএমএফ।

আশা বাঁচিয়ে রেখেছে রেমিটেন্স

মহামারির অভিঘাতে পুরো বিশ্বের অর্থনীতিই টালমাটাল। অনেক দেশেই কাজ হারিয়েছেন অভিবাসী কর্মীরা। সরকারি হিসাবে গত ১ এপ্রিল থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৮ জন প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরে এসেছেন। এই প্রেক্ষাপটে রপ্তানি বাণিজ্যের মত প্রবাসী আয়েও বড় ধাক্কা লাগবে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, তবে তা ঘটেনি। বরং প্রবাসী পাঠানো অর্থই আশা বাঁচিয়ে রেখেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ী বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরের ২৪ দিনেই ১৬৬ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। সব মিলিয়ে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে রেমিটেন্স বাবদে দেশে এসেছে ২১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯ সালের পুরো সময়ের চেয়ে ১৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।

এর আগে এক বছরে বাংলাদেশে এত রেমিটেন্স আর কখনো আসেনি। ২০১৯ সালে ১৮ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এই মহামারির বছরেই প্রবাসী আয়ে আরও একটি রেকর্ড হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স এসেছিল দেশে, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।

৪৩ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলকে রিজার্ভ

রেমিটেন্সের উপর ভর করে মহামারির মধ্যেই বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন ৪৩ বিলিয়ন (৪ হাজার ৩০০ কোটি) ডলারের মাইলফলকে ছুঁতে চলেছে। বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন পাকিস্তানের দ্বিগুণেরও বেশি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ২৭ ডিসেম্বর (রোববার) দিন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪২ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার, যা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এই বছরের মধ্যেই রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করবে বলে আশা করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে প্রতি মাসে চার বিলিয়ন ডলার হিসেবে সাড়ে দশ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

রপ্তানি আয়ে ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি

মহামারির ধাক্কায় রপ্তানি খাত যতটা পিছিয়ে পড়েছে, বড়দিন ঘিরে পোশাক রপ্তানির পালে হাওয়া লাগলে তা কিছুটা হলেও সামলে নেওয়া যাবে বলে আশা করছিলেন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা। ইউরোপ-আমেরিকায় করোনা ভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ সেই আশায় বাধ সাধলেও এর মধ্যেই কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে রপ্তানি বাণিজ্য, আর তা সম্ভব হয়েছে নিট পোশাকে ভর করে।

মহামারিতে বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় গত এপ্রিলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় তলানিতে ঠেকেছিল; ওই মাসে সবিমিলিয়ে মাত্র ৫২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল মাত্র ৩৬ কোটি ডলার।

বিধি-নিষেধ শিথিলে কারখানা খোলার পর মে ও জুন মাসে রপ্তানি আয় বাড়তে শুরু করে। কিন্তু অক্টোবরে আবার হোঁচট লাগে রপ্তানি আয়ে। নভেম্বরে এসে ফের প্রবৃদ্ধির দেখা মেলে।

সবমিলিয়ে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) এক হাজার ৫৯২ কোটি ৩৫ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১ শতাংশ বেশি। এই সময়ে পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ যে আয় করেছে, তার ৪৫ শতাংশই এসেছে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে।

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও এভিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, কম দামের পোশাক, বিশেষ করে নিট পোশাক রপ্তানি বাড়ায় কিছুটা স্বস্তি থাকলেও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নতুন করে ‘লকডাউন’ শঙ্কাও জাগাচ্ছে। সব মিলিয়ে আগামি কয়েক মাসে ভালো কিছুর আশা তারা করতে পারছেন না।

তবে অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, এই দুঃসময়ে সামান্য হলেও প্রবৃদ্ধি হওয়াটাই আশার কথা।

আমদানি কমছে

২০১৯-২০ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় আগের বছরের চেয়ে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ কমেছিল। করোনা ভাইরাসের ধাক্কায় ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ভাগে তা আরও কমেছে। এর অর্থ হল, দেশের মানুষের ভোগ ব্যয় কমেছে এবং নতুন শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-অক্টোবর সময়ে ১৫ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ শতাংশ কম।

এই চার মাসে খাদ্য পণ্য ছাড়া সব পণ্যের আমদানিই কমেছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ কমেছে ৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। জ্বালনি তেল আমদানির এলসি কমেছে ৩৫ শতাংশ। আর শিল্পের কাঁচামালের আমদানি কমেছে ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ। শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

লেনদেন ভারসাম্যে বড় উদ্বৃত্ত

মহামারির মধ্যে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) উদ্বৃত্ত বেড়েই চলেছে। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) এই উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০৫ কোটি ৪০ লাখ (৪.০৫ বিলিয়ন) ডলার। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের এই সময়ে ১৫২ কোটি ১০ লাখ ডলার ঘাটতি ছিল।

আহসান এইচ মনসুর বলছেন, রেমিটেন্স উল্লম্ফন এবং আমদানির ব্যয় কমার কারণেই লেনদেন ভারসাম্যে বড় উদ্বৃত্ত রয়েছে। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয়-তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় কমলে লেনদেন ভারসাম্যসহ অর্থনীতিতে যে স্বস্তির একটা ভাব ছিল, সেটা আর থাকবে না।

মূল্যস্ফীতি ‘সহনীয়’

পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) এবার নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ, গত বছরের নভেম্বর মাসে তা ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। খাদ্য সামগ্রীর দাম বাড়ায় গত অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি যেটুকু চড়েছিল, তা কমে এসেছে এক মাস বাদে। বাজারে শীতের সবজি ওঠার পাশাপাশি আলু, পেঁয়াজের দাম কমায় নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি কমেছে বলে জানিয়েছে পরিসংখ্যান ব্যুরো।
সাত বছর পর গত অক্টোবরে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে উঠেছিল, নভেম্বরে তা ৫ দশমিক ৫২ শতাংশে নেমে এসেছে। এর অর্থ হল, ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে যে পণ্য বা সেবার জন্য ১০০ টাকা খরচ করতে হত, ২০২০ সালের নভেম্বরে সেই পণ্য বা সেবার জন্য ১০৫ টাকা ৫২ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি ৩.৫৩ শতাংশ

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ রাজস্ব আদায় কম হয়েছিল। আশঙ্কা করা হয়েছিল, মহামারির কারণে এবার রাজস্ব আদায় অনেক কমে যাবে। তবে পরিস্থিতি ততটা খারাপ হয়নি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সময়ে ৮৭ হাজার ৯২ কোটি ৭১ লাখ টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ বেশি।

তবে এই পাঁচ মাসে লক্ষ্যের চেয়ে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। এ সময়ে লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা।

তলানিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি

বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক হচ্ছে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে প্রণোদনায় ভর করে বাড়তে থাকা বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ফের তলানিতে নেমে এসেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে নেমে এসেছিল। প্রণোদনা ঋণে ভর করে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয় ৯ দশমিক ২০ শতাংশ।

আগস্টে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশে ওঠে। সেপ্টেম্বরে তা আরও বেড়ে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ হয়। কিন্তু অক্টোবরে দা এক শতাংশ পয়েন্ট কমে আবার সেই ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে নেমে এসেছে।

কমছে সরকারের ব্যাংক ঋণ

চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকা ধার করার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। চার মাস পার হয়ে গেলেও নিয়েছে মাত্র ৯৪৫ কোটি টাকা। ধারণা করা হয়েছিল, মহামারির এই কঠিন সময়ে সরকারকে ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ করে দেশ চালাতে হবে। তবে বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি।

সঞ্চয়পত্র বিক্রি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এবং মহামারি মোকাবেলায় বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার কাছ থেকে প্রচুর ঋণ পাওয়ায় সরকারকে ব্যাংকের দারস্ত হতে হচ্ছে না। এ কারণেই ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে।

সঞ্চয়পত্র : গত অর্থবছরের বেশি ঋণ ৪ মাসেই ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমলেও সঞ্চয়পত্র থেকে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার ৬৪২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ঋণ হয়েছে সরকারের, যা গত অর্থবছরের (জুলাই-জুন) পুরো সময়ের চেয়ে এক হাজার ২১৪ কোটি টাকা বেশি।

গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে ৫ হাজার ৫২১ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিল সরকার। এ হিসাবে অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ বেড়েছে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে তিন গুণ।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। তার ৭৮ দশমিক ২১ শতাংশ চার মাসেই নেওয়া হয়ে গেছে। গত অর্থবছরে এই খাত থেকে মোট ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকার ঋণ নিয়েছিল সরকার।

দেশি ঋণ-সহায়তা বেড়েছে ৮৩%

চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাবদ বাংলাদেশে এসেছে ১৬৫ কোটি ১০ লাখ ডলার। গত বছরের এই চার মাসে এসেছিল ৯০ কোটি ১০ লাখ ডলার। অর্থাৎ, এই চার মাসে বিদেশি ঋণ-সহায়তা বেড়েছে ৮৩ দশমিক ২৪ শতাংশ।

করোনা ভাইরাসের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে মোটা অংকের ঋণ পাওয়ার কারণে বিদেশি ঋণে এই উল্লম্ফন হয়েছে।

গত অর্থবছরে ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছিল দাতারা, যা ছিল আগরে বছরের চেয়ে ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ বেশি।

এডিপি বাস্তবায়নে গতি নেই

বিদেশি ঋণ-সহায়তা বাড়লেও সরকারের উন্নয়ন কাজে তেমন গতি নেই মহামারির মধ্যে। অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ১২ দশমিক ৭৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে বাস্তবায়নের হার ছিল ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ।

ফুরফুরে মেজাজে পুঁজিবাজার

দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশের পুঁজিবাজার চলছে ফুরফুরে মেজাজে। মূল্যসূচকের পাশাপাশি লেনদেনেও মোটামুটি চাঙাভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০১০ সালের ধসের পর নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ঘুরে দাঁড়ায়নি। মাঝে-মধ্যে এক-দুই মাসের জন্য বাজারে কিছুটা ইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা গেলেও পরে আর সেটা স্থায়ী হয়নি। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আরও একটি বড় ধসের মুখে পড়ে পুঁজিবাজার। বেশিরভাগ শেয়ারের দর তলানিতে নেমে যায়।

মার্চে দেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে লকডাউনের মধ্যে দুই মাসের বেশি সময় বন্ধ থাকে লেনদেন। ৩১ মে থেকে দেশের পুঁজিবাজারে ফের লেনদেন শুরু হয়।

মহামারি শুরুর পর গত জুনে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স যেখানে ৪ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে গিয়েছিল, সেই সূচক এখন সোয়া ৫ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে গেছে। লেনদেনও ছাড়িয়েছে হাজার কোটি টাকা।

গত মঙ্গলবার দিন শেষে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫ হাজার ৩৫৮ পয়েন্টে অবস্থান করছিল। লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা।