কারবালা ও আশুরার পর্যালোচনা- মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দীন

কারবালা ও আশুরার পর্যালোচনা- মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দীন

কারবালা ও আশুরার অধ্যায় হচ্ছে ইসলামের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়  । ইতিহাসের গভীর থেকে বুঝতে গিয়ে অনেকেই হোঁচট খেয়েছে এ বিষয়ে। আশুরা ও কারবালা দুটিকে একত্র করে ভুল বোঝাবুঝিও হয়েছে। কেউ কেউ বলে, হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনার কারণে আশুরা ফজিলতপূর্ণ। এ ধারণা নিতান্তই ভুল। এখানে আশুরা ও কারবালা জড়িয়ে আলোচনার কিছু তত্ত্বস্পর্শ করব ইনশাল্লাহ।

মূলত আশুরা হচ্ছে হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখ। পৃথিবীর ইতিহাসের অনেক বড় বড় ঘটনা এ তারিখে সংঘটিত হয়েছে। আদম (আ.)-এর সৃষ্টি, জান্নাত থেকে তাদের পৃথিবীতে আগমন, নূহ (আ.)-এর প্লাবন পরবর্তী জমিনে অবতরণ, বনি ইসরাঈলের ফেরআউনের কবল থেকে মুক্তি ইত্যাদি। অনুরূপভাবে পৃথিবীর সমাপ্তি সংক্রান্ত বড় বড় ঘটনাও এদিনে ঘটবে বলে বিভিন্ন হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় আগমন করলেন, দেখলেন মদিনার ইহুদিরা আশুরার দিবসে রোজা পালন করছে। তাদের রোজা রাখার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলল, এই দিনটি আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই দিনে আল্লাহ তায়ালা মুসা (আ.) এবং তার সম্প্রদায় বনি ইসরাঈলকে ফেরআউনের কবল থেকে মুক্ত করেছেন এবং তার ওপর বিজয় দান করেছেন। আর তারই শুকরিয়া হিসেবে এদিনে মুসা (আ.) রোজা রেখেছিলেন। তাই আমরাও এই দিনে রোজা রাখি। তখন রাসুল (সা.) বললেন মুসা (আ.)-এর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তোমাদের চেয়ে আমিই বেশি হকদার। তারপর তিনি নিজেও রোজা রাখলেন এবং সাহাবিগণকেও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। (মুসলিম : ২৬৫৩)।

আশুরা উপলক্ষে উপরিউক্ত আলোচনা থেকে দুটি শিক্ষা পাওয়া যায়। এক. আমাদের পূর্বপুরুষদের ওপর যে নেয়ামত দেওয়া হয়েছিল, সে নেয়ামতগুলোকে আমাদের ওপর দেওয়া হয়েছে বলে সম্মান করা। দুই. নেয়ামতের শোকর আদায় করা। এ থেকে আরও বোঝা গেল, আশুরার দিন হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনা জড়িত বলে তাৎপর্যপূর্ণ নয়। কারণ হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনা ঘটেছে শরিয়তের বিধানাবলি পরিপূর্ণ হওয়ার পর ৬১ হিজরির দিকে। আশুরা দিবসের ফজিলতের সঙ্গে হুসাইন (রা.)-এর বিদায়ের ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি হুসাইন (রা.) নিজেও এ উদ্দেশ্যে আশুরা পালন করতেন না। বরং মুসা (আ.)-এর আদর্শ হিসেবে পালন করতেন, যেমনটা রাসুল (সা.) বলেছেন। তাই রাসুল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম যে উদ্দেশ্যে আশুরা পালন করেছেন, সে উদ্দেশ্যেই আমাদের আশুরা পালন করা উচিত। আশুরার তাৎপর্য এবং শিক্ষা বলতে গিয়ে কারবালার ঘটনাকে জোর করে আনা যাবে না। তবে কাকতালীয়ভাবে আশুরার বরকতপূর্ণ দিনেই হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনা ঘটেছিল। এটা ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ। হৃদয়বিদারক একটি ঘটনা। এদিনে শাহাদাতের ফলে হুসাইন (রা.)-এর মূল্য ও মর্যাদা অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে।

এটা সত্য যে, ইমাম হুসাইন (রা.)-এর নির্মম শাহাদাতের ঘটনা মুসলিম উম্মাহর জন্য অনেক বড় শোকের কারণ। আশুরার তাৎপর্যপূর্ণ দিনে তার শাহাদাতের ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় এটা প্রাসঙ্গিক। এ প্রসঙ্গে যেতে হলে প্রথমে বুঝতে হবে ইমাম হুসাইন (রা.) কী উদ্দেশ্যে কারবালা প্রান্তরে উপস্থিত হয়েছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে ইতিহাস কখনও এ কথা স্বীকার করে না তিনি যুদ্ধের জন্য সেখানে গিয়েছিলেন। যদি তিনি যুদ্ধের জন্য যেতেন তাহলে অবশ্যই যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে যেতেন। তা তিনি করেননি। অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়েও যাননি। যুদ্ধ উদ্দেশ্য হলে নারী-শিশুদের সঙ্গে নিতেন না। সর্বোপরি উদ্দেশ্য যদি যুদ্ধই হতো তাহলে ইয়াজিদের বাহিনী কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের যুদ্ধের প্রস্তাবে তিনি যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানালেন কেন? এবং সীমান্তবর্তী কোথাও চলে যাওয়ার আবেদন এবং ইয়াজিদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতে অনুরোধ করলেন কেন?

এ থেকে বুঝে আসে হোসাইন (রা.) কারবালায় গমন যুদ্ধের জন্য নয়। যদি যুদ্ধের উদ্দেশ্যেই গমন করতেন তাহলে হুসাইন (রা.) মক্কা থেকে কুফার দিকে রওনাকালে বিজ্ঞ সাহাবায়ে কেরাম আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, ইবনে জুবায়ের ইবনে ওমর, (রা.) যারা জিহাদ ও যুদ্ধের জন্য সর্বক্ষণ উদগ্রীব থাকতেন, তারা কেন তাকে যেতে বাধা দিলেন? তদুপরি কারবালার উদ্দেশ্যে গমনকালে তাকে যখন বারণ করা হচ্ছে, তখন তিনি এ কথা কেন বললেন না আমি জিহাদের মতো মহান কাজে যাচ্ছি, আপনারা কেন আমাকে বাধা দিচ্ছেন? পক্ষান্তরে তিনি তাদের উত্তরে বলেছিলেন, কুফা থেকে শত শত চিঠির মাধ্যমে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাদের ইচ্ছা ও দাবি, আমি যেন তাদের খলিফা নিযুক্ত হই!

এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে তিনি কোন উদ্দেশ্যে গমন করেন? এ প্রশ্নের উত্তরে ইতিহাস একথাই বর্ণনা করে, ইয়াজিদের শাসনে কুফাবাসী অসন্তুষ্ট ছিলেন। জনগণ রাসুল (সা.)-এর পৌত্রকে খলিফা দেখতে চান। তাই হুসাইন (রা.) আজিমত ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সফর শুরু করেন। আর ‘আজিমত’ ও নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠার জন্য যেহেতু সংগ্রাম ও জিহাদে কাজ চলে না, তাই ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ তাকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বললে তিনি অস্বীকৃতি জানান। এই ছিল হোসাইন (রা.)-এর কারবালায় গমনের রহস্য। কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা থেকে সত্যকে সত্যের জায়গায় বহাল রাখা, হকের ক্ষেত্রে আপোস না করা, আজিমত ও নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা করা প্রকাশ পায়। কারবালা প্রান্তরে রক্তের বিনিময়ে এটাই উচ্চকিত হয়েছে। তাই আমরা কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা থেকে এ শিক্ষা নিতে পারি, ব্যক্তি থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র থেকে পুরো ভ‚খÐের মাঝে আজিমত, নিষ্ঠা, দৃঢ়তা ও অবিচলতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পরিশেষে স্মরণ করি, কারবালার দুঃখ গাথা ইতিহাস। হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত চির অমর সে শাহাদাত! তার শাহাদাতের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পাক। আমিন। (তথ্যসূত্র : তারিখ : আকবরশাহ নাজিববাদী। আহকামে সুলতানিয়া : আবুল হাসান। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসির। আল কামেল ফিত তারিখ : ইবনে আসির)

শ্রুতিলিখন : কাওসার আইয়ুব