পাহাড় চূড়ায় নিত্যনতুন সাইনবোর্ড , মাফিয়াদের বাণিজ্যে নিশ্চিহ্ন পাহাড়

পাহাড় চূড়ায় নিত্যনতুন সাইনবোর্ড , মাফিয়াদের বাণিজ্যে নিশ্চিহ্ন পাহাড়
পাহাড় চূড়ায় নিত্যনতুন সাইনবোর্ড , মাফিয়াদের বাণিজ্যে নিশ্চিহ্ন পাহাড়

বিশেষ প্রতিবেদক।।

ভূমিখেকোদের সবুজ পাহাড়ের দিকে চোখ থাকে সবসময়। চট্টগ্রামে পাহাড়ের বুক চিড়ে গড়ে ওঠা সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক রোডের দুই পাশের পাহাড়ে এবার চোখ পড়েছে ‘মাফিয়াদের’। ইতোমধ্যে অসংখ্য পাহাড়কে নিজেদের ব্যক্তি মালিকানাধীন দাবি করে পাহাড় চূড়া ও পাদদেশে টাঙানো হয়েছে অসংখ্য সাইনবোর্ড। নানান সিন্ডিকেট, গ্রুপ, ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের নামে ঝুলানো হচ্ছে এসব সাইনবোর্ড। মানবাধিকারের নামে বুলি ফোটানো লোকজনও জড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ে সাইনবোর্ড ঝুলানোর কাজে। যদিও চট্টগ্রামের পাহাড়ের উপর প্রভাবশালীদের লোলুপ দৃষ্টি নতুন নয়। সময় গড়ানোর সাথে সাথে বাণিজ্যের সীমাহীন লোভের অব্যর্থ শিকার হয়েছে একেকটি পাহাড়। বিশেষ করে গত দুই দশকে পাহাড় কেটে বাণিজ্য-বেসাতি অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছে। পাহাড় নিধনযজ্ঞ রুখতে পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলা-জরিমানা বা প্রশাসনের দৌড়ঝাঁপ অকার্যকর তৎপরতায় পরিণত হয়েছে। এতকিছুর মধ্যেও পাঁচ দশকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে একশ’ ২০ টিরও বেশি পাহাড়। বর্তমানে বিলুপ্তির পথে রয়েছে আরও কয়েকটি পাহাড় ।

ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও জনপ্রতিনিধিসহ প্রভাবশালীরা দশকের পর দশক ধরে অনেকটা নিয়মিতভাবেই পাহাড় নিধনযজ্ঞ চালিয়ে আসছে। এমনকি সরকারের উন্নয়ন ও সেবা সংস্থাগুলোও এ কাজে পিছিয়ে নেই। এ কারণে প্রশাসনের দৌড়ঝাঁপ ও আইনি ব্যবস্থা তাদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। আইনের ফাঁকফোকরে ঝুলে থাকে মামলা-জরিমানা। অভিযানে ধরা পড়ে কেবল দিনমজুররা। ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকেন প্রভাবশালীরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খালেদ মেসবাহুজ্জামানের গবেষণাসূত্রে জানা যায়, চার দশক আগে চট্টগ্রামে দুই শতাধিক পাহাড় ছিল। যার ৬০ শতাংশ অর্থাৎ ১২০টিই ইতোমধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ন্যাচারাল এন্ড সোশ্যাল সায়েন্সেসে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এনভায়রনমেন্টাল ডিগরিডেশন থ্রো হিল কাটিং ইন চিটাগং ডিস্ট্রিক্ট অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে গবেষণাপত্র । এই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম নগরীর দুইশ’ পাহাড়ের মধ্যে একশ’ পাহাড় কেটে আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। তারও আগে চবি’র বন ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এস এম সিরাজুল হক একটি বেসরকারি সংস্থার হয়ে ‘হিল কাটিং ইন এ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’ শীর্ষক একটি গবেষণা করেন। ওই গবেষণায় তিনি উল্লেখ করেন, চট্টগ্রাম নগরীতে বেশিরভাগ পাহাড় কাটা হয়েছে পাহাড়তলী, খুলশী, বায়েজিদ, লালখান বাজার মতিঝর্না, ষোলশহর এবং ফয়’স লেক এলাকায়। ১৯৭৬ থেকে ৩২ বছরে নগর ও আশপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয়েছে। ১৯৭৬ সালে নগরীর পাঁচ থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৪ দশমিক দুই বর্গকিলোমিটার। এ সময়ে ১৮ দশমিক তিনশ’ ৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়। যা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ। নগরীর বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালি ও পাহাড়তলী থানা এলাকায় এসব পাহাড় কাটা হয়। সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ কাটা পড়ে পাঁচলাইশে। জেলা প্রশাসনের বড় আকারের হস্তক্ষেপের পর জঙ্গল সলিমপুরে বর্তমানে পাহাড়কাটা বন্ধ থাকলেও আকবর শাহ এলাকায় উল্টোচিত্র দৃশ্যমান হচ্ছে। ওই এলাকায় একের পর এক পাহাড় কেটে প্লট তৈরি করে বিক্রি চলছে। এসব প্লটের কোনও কোনওটিতে গড়ে উঠেছে দালানও। গরুর খামারসহ নানা বাণিজ্যিক স্থাপনাও গড়ে তোলা হয়েছে। প্লটের নিরাপত্তায় সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। খাড়া পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে সড়ক। এছাড়া নগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় পাহাড় কাটাকে। পাহাড় কেটে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি গড়ে তোলার কারণে ২০০৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে বছরে পাহাড়ধসে মারা গেছে তিন শতাধিক মানুষ। সর্বশেষ গত বছরের জুন মাসে মারা যায় চারজন।

পরিবেশবিদদের মতে, পাহাড় হচ্ছে পৃথিবীতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার খুঁটির মতো। যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিহত করার পাশাপাশি মানুষ এবং জীব-বৈচিত্র্যের সুপেয় পানির আধার। ক্রমাগত পাহাড় ধ্বংস হয়ে গেলে জরাভূমিতে পরিণত হবে বিভিন্ন অঞ্চল । ক্রমবর্ধমান ইট-কংক্রিটের সৃষ্ট উত্তাপ পরিশোধন করার বিকল্প না থাকায় বেড়ে যাবে তাপমাত্রা । পাহাড় কেটে আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবন করে মানুষ আর্থিকভাবে যতটুকু লাভবান হচ্ছে বাস্তবে প্রাকৃতিক ক্ষতির পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পাহাড় নিধনসহ পরিবেশবিধ্বংসী অপরাধের ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও পরিবেশ অধিদপ্তরের তৎপরতা তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। অধিদপ্তর জরিমানার পাশাপাশি অভিযোগের ধরন বিবেচনায় মামলাও করে থাকে। কিন্তু পরিবেশ আদালতে করা পরিবেশ অধিদপ্তরের অধিকাংশ মামলার তদন্ত শেষ করতেই লেগে যাচ্ছে বছরের পর বছর। বিচারিক প্রক্রিয়ায় রয়েছে নানা সংকট। সাক্ষীর অভাবে বেশিরভাগ মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। বিভাগীয় পরিবেশ আদালতে বর্তমানে পরিবেশ সংক্রান্ত দুই শতাধিক মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বিদায়ী বছরেও বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৯০ টি মামলা আছে পাহাড় কাটা আইনে। তদন্তে ত্রুটি থাকায় পুনরায় তদন্তের জন্য পাঠানো, দেরিতে তদন্ত প্রতিবেদন আসা এবং সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারণে বছরের পর বছর ঝুলে আছে মামলাগুলো। তদন্তে শেষ না হওয়ায় শুরু করা যাচ্ছে না অনেক মামলার বিচার কার্যক্রম। পরিবেশ আদালতের অধিকাংশ মামলাই দায়ের করা হয়েছে দুষণবিরোধী, পাহাড় কাটা ও জলাশয় ভরাট আইনে।

পাহাড় চূড়ায় নিত্যনতুন সাইনবোর্ড টাঙানো প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এবিএম আবু নোমান বলেন, পাহাড়তো ব্যক্তি মালিকানাধীন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এখনই যদি পাহাড় দখল রোধ করা না যায়, তাহলে পাহাড়গুলো বেদখল হয়ে যাবে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। এ পাহাড় সমতল ভূমি বানিয়ে সেখানে একদিন বহুতল ভবন দাঁড়িয়ে যাবে। আমাদের দেশের কিছু মানুষ এগুলোর সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। এখন থেকেই যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরদারি শুরু করা উচিত।

তিনি বলেন, এখন সবুজ পাহাড়গুলোতে অবৈধ সাইনবোর্ড ঝুলানোর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা উচিত, সাইনবোর্ড সাঁটানো ব্যক্তিদের শোকজ করা উচিত, এগুলো সরানো উচিত এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। যদি তা না হয়, পাহাড়গুলো নষ্ট হবে, ভবিষ্যতে এখানে বিভিন্ন ধরণের স্থাপনা তৈরি হবে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, বিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে অধিদপ্তর সবসময় পরিবেশবিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে আসছে। তবে পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রকৃতপক্ষে সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন ও আদালতসহ সকলের কার্যকর পদক্ষেপে পরিবেশ  বিনাশী কর্মকান্ড রোধ করা সম্ভব। 

তিনি বলেন, আমরা পাহাড়ের মালিক নই। তবে দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করি। এখানকার পাহাড়ে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা তৈরি হলে, কিংবা পাহাড় কাটা হলে জড়িতের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। 

খালেদ / পোস্টকার্ড ;