বিস্ময়কর জীবন জিন জাতির

বিস্ময়কর জীবন জিন জাতির

মাওলানা শামসুদ্দীন সাদী ।। 

গা ছমছম করে ওঠা শব্দ ‘জিন’!। ভয়ে কুঁকড়ে যায় মন। অনেকের ধারণা, জিন-ভূত বলতে কিছু নেই; সবই মানুষের অলস মস্তিষ্কপ্রসূত মিথ। জিনে ধরা রোগী নিয়ে অনেকেই টিপ্পনী কাটে। মানতে চায় না, জিন মানুষের ওপর আছর করে এবং মানুষকে দিগভ্রান্ত করে।

আসলেই কি তাই? জিন বলতে কি কিছু নেই? এটা কি শুধুই মিথ? জিন যদি আসলেই থাকে তাহলে আমরা তাদের দেখি না কেন? জিন জাতির জীবনযাত্রা কেমন? কেমন তাদের আচার-আচরণ? কেমন তাদের জীবনযাত্রা? কেমন তাদের খাদ্যাচার? এসব নিয়েই এই প্রবন্ধের অবতারণা।

জিনের অস্তিত্ব
জিন জাতির অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো মুসলমান সন্দেহ পোষণ করতে পারে না। জিনের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করার অর্থ কোরআনের আয়াত সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা। এ জন্য মুফাসসিরগণ বলেছেন, কেউ যদি জিনের অস্তিত্ব অস্বীকার করে তাহলে তার ঈমান থাকবে না। কারণ, কোরআন ও হাদিসের অনেক স্থানে জিনদের কথা আলোচনা করা হয়েছে। কোরআন মাজিদে একটি স্বতন্ত্র সুরাই রয়েছে জিন জাতি সম্পর্কে। আল্লাহ তায়ালা কোরআন মাজিদে ইরশাদ করেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে শুধু আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা যারিয়াত : ৫৬)। এই আয়াত থেকে দুটি বিষয় পরিষ্কার বোঝা যায়। প্রথমত আল্লাহ তায়ালা মানুষ ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছেন। দ্বিতীয়ত মানুষ ও জিন জাতিকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন।

জিনের সৃষ্টি রহস্য
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। জিনকে সৃষ্টি করেছেন আগুন থেকে। আল্লাহ তায়ালা মানুষ ও জিন জাতির সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পোড়ামাটির ন্যায় মৃত্তিকা থেকে এবং জিনকে সৃষ্টি করেছেন অগ্নিশিখা থেকে।’ (সুরা আর-রহমান : ১৪-১৫)। এখানে আল্লাহ মানুষ ও জিনদের সৃষ্টি রহস্য পাশাপাশি বর্ণনা করেছেন। কাদা মাটি রোদে শুকানোর পরে যে পোড়ামাটির রূপ নেয়, তা থেকে আদমকে সৃষ্টি করেছেন। আর জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন ধোঁয়াবিহীন গাঢ় আগুনের লেলিহান শিখা থেকে। শয়তান জিন জাতিরই অংশ।

জিনের জীবনাচার
জিন জাতির জীবনাচার কিছু ব্যবধান ব্যতীত অবিকল মানুষের জীবনযাত্রার মতো। মানুষ যেমন খায়, জিনেরাও খায়। মানুষ যেমন ঈমানদার ও কাফের আছে, জিন জাতির মধ্যেও আছে ঈমানদার ও কাফের। মানুষের মধ্যে যেমন নেককার ও বদকার আছে, জিনের মধ্যেও আছে। মানুষ যেমন বিয়ে করে বংশ বিস্তার করে, জিন জাতিও বিয়ে করে বংশ বিস্তার করে। মানুষের যেমন অনুভূতিশক্তি আছে, জিন জাতিরও আছে। মানুষ যেমন সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করে, আছে সামাজিক আইন ও বিচার-আচার; জিনেরও আছে সমাজ, সামাজিক আইন ও বিচার-আচার। তবে মানুষের সঙ্গে জিনের কিছু পার্থক্য রয়েছে। মানুষের তুলনায় জিন দীর্ঘ জীবন লাভ করে। জিন মানুষকে দেখে মানুষ জিনকে দেখে না। জিন নানা আকৃতি ধারণ করতে পারে, মানুষ পারে না।

জিনের ধর্ম
আল্লাহ তায়ালা কোরআন মাজিদ নাজিল করেছেন মানুষ ও জিন জাতির জন্য। মানুষের জন্য যেমন কোরআন অনুযায়ী আমল করা জরুরি, জিনের জন্যও জরুরি। আল্লাহ ও নবীর প্রতি ঈমান রাখা মানুষের জন্য যেমন আবশ্যক, জিন জাতির জন্যও আবশ্যক। মহানবী (সা.) তায়েফ থেকে ফেরার পথে জিনদের একটি দল নবীজির খেদমতে হাজির হয়ে ঈমান গ্রহণ করে। কোরআন মাজিদে সেই ঘটনার বিবরণ দিয়ে সুরা জিন অবতীর্ণ করা হয়। আল্লাহ তায়ালা তাদের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা কোরআন মাজিদে এভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘বলুন, আমার প্রতি অহি নাজিল করা হয়েছে যে, জিনদের একটি দল কোরআন শ্রবণ করেছে। অতঃপর তারা বলেছে, আমরা বিস্ময়কর কোরআন শ্রবণ করেছি, যা সৎপথ প্রদর্শন করে। ফলে আমরা তাতে ঈমান এনেছি। আমরা কখনও আমাদের পালনকর্তার সঙ্গে কাউকে শরিক করব না। আমরা আরও ঈমান আনি যে, আমাদের পালনকর্তার মহান মর্যাদা সবার ওপরে। তিনি কোনো পত্নী গ্রহণ করেননি এবং তার কোনো সন্তান নেই।’ (সুরা জিন : ১-৩)

জিনের খাদ্য
মানুষের মতো জিনও খাদ্য গ্রহণ করে বেঁচে থাকে। তবে মানুষের খাবারের সঙ্গে তাদের খাবারের কিছু ব্যবধান আছে। জিনের প্রধান খাদ্য হলো হাড়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবীজির জন্য অজু ও ইস্তিঞ্জার ব্যবহারের জন্য পানিভর্তি একটি পাত্র নিয়ে পিছনে পিছনে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ নবীজি তাকিয়ে বললেন, কে? আমি বললাম, আমি আবু হুরায়রা। তিনি বললেন, আমাকে কয়েকটি পাথর তালাশ করে দাও। আমি তা দিয়ে ইস্তিঞ্জা করব। তবে হাড় ও গোবর আনবে না। আমি আমার কাপড়ের কিনারায় কয়েকটি পাথর এনে তাঁর কাছে রেখে দিলাম এবং সেখান থেকে কিছুটা দূরে সরে গেলাম। তিনি যখন ইস্তিঞ্জা হতে বের হলেন তখন আমি এগিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, হাড় ও গোবরের ব্যাপার কী? তিনি বললেন, এগুলো জিনের খাবার। আমার কাছে নাসিবীন নামক জায়গা থেকে জিনের একটি দল এসেছিল। তারা ভালো জিন ছিল। তারা আমার কাছে খাদ্যদ্রব্যের আবেদন জানাল। তখন আমি আল্লাহর নিকট দোয়া করলাম যে, যখন কোনো হাড্ডি বা গোবর তারা লাভ করে তখন তারা যেন তাতে খাদ্য পায়।’ (বুখারি : ৩৮৬০)

জিনের বাসস্থান
জিনেরা সাধারণত মনুষ্য-লোকালয়ে বসবাস করে না। বসবাসের জন্য তারা নির্জন জনমানবহীন এলাকা, মরুভূমি, পরিত্যক্ত বাড়ি, নোংরা ও আবর্জনাযুক্ত স্থান পছন্দ করে। বিশেষ করে বাথরুমে অনেক খারাপ জিনের অবাধ বিচরণ থাকে। তাই নবীজি (সা.) বাথরুমে প্রবেশের সময় দোয়া পড়তে বলেছেন। হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, এসব স্থানে (পায়খানায়) শয়তান উপস্থিত হয়। অতএব তোমাদের কেউ পায়খানায় প্রবেশকালে যেন বলে ‘হে আল্লাহ! আপনার নিকট পুরুষ ও মহিলা শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ (ইবনে মাজা : ২৯৬; মুসনাদে আহমাদ : ১৯২৮৬)

জিনের আকৃতি বদল
জিন জাতি মূল আকৃতি বদলে মানুষ ও পশুপাখির আকৃতি ধারণ করতে পারে। কখনও শেয়াল-কুকুরের আকৃতি ধারণ করে, কখনও মানুষের আকৃতি ধারণ করে, কখনও সাপ-বিচ্ছুর আকৃতি ধারণ করে। বেশ কিছু হাদিসে এমন ঘটনা বর্ণিত আছে। মক্কার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সুরাকা ইবনে যুশামের আকার ধারণ করে একজন জিন সাহাবি বদরযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। একটি দীর্ঘ হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে এক দুষ্টুলোকের ঘটনা বর্ণিত আছে যে, সে প্রতি রাতে জাকাতের মাল চুরি করতে আসত। আবু হুরায়রা প্রতি রাতেই তাকে ধরে ফেলতেন। কিন্তু লোকটি বিভিন্ন অনুরোধ করে মাফ নিয়ে চলে যেত। পরের রাতে আবার চুরি করতে আসত। পরপর তিন রাত সে মানুষটিকে ধরার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) আবু হুরায়রাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আবু হুরায়রা! তুমি কি জান তুমি এই তিন দিন কার সঙ্গে কথা বলেছ? তিনি বললেন, না। নবীজি বললেন, এটা ছিল শয়তান।’ (বুখারি : ২৩১১)

জিনের হাশর ও জান্নাত-জাহান্নাম
জিনও ঈমান-আমলের বিষয়ে নির্দেশপ্রাপ্ত। সুতরাং হাশরের মাঠে মানুষের মতো জিনদের আমলের হিসাবও নেওয়া হবে। ঈমানদার ও আমলদার জিনেরা জান্নাতে যাবে। কাফের ও বদকার জিনেরা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। কোরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেককে সঠিক দিক নির্দেশ দিতাম। কিন্তু আমার এ উক্তি অবধারিত সত্য যে, আমি জিন ও মানব সবাইকে দিয়ে অবশ্যই জাহান্নাম পূর্ণ করব।’ (সুরা সাজদাহ : ১৩)। অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে জিন ও মানব সম্প্রদায়! তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে নবীগণ আগমন করেননি? যাঁরা তোমাদেরকে আমার বিধানাবলি বর্ণনা করতেন এবং তোমাদেরকে আজকের এ দিনের সাক্ষাতের ভীতি প্রদর্শন করতেন? তারা বলবে আমরা স্বীয় গুনাহ স্বীকার করে নিলাম। পার্থিব জীবন তাদের প্রতারিত করেছে। তারা নিজেদের বিরুদ্ধে স্বীকার করে নিয়েছে তারা কাফের ছিল।’ (সুরা আনআম : ১৩০)

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া আম্বরশাহ আল ইসলামিয়া, কারওয়ান বাজার, ঢাকা