সীতাকুণ্ডের জাহাজ ভাঙা শিল্পে দুর্দিন, অর্ধ লক্ষ শ্রমিকের ভবিষ্যত অনিশ্চিত

সীতাকুণ্ডের জাহাজ ভাঙা শিল্পে দুর্দিন, অর্ধ লক্ষ শ্রমিকের ভবিষ্যত অনিশ্চিত
সীতাকুণ্ডের জাহাজ ভাঙা শিল্পে দুর্দিন, অর্ধ লক্ষ শ্রমিকের ভবিষ্যত অনিশ্চিত

পোস্টকার্ড ডেস্ক ।।

সীতাকুণ্ডে অবস্থিত দেশের একমাত্র জাহাজ ভাঙা শিল্প অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি এখন। দেশের ব্যাংকগুলোর ডলার সংকটের কারণে কারো এলসি খুলছে না। আর তাই নতুন করে কোন স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করতে পারছেন না শিপব্রেকিং ইয়ার্ড মালিকরা। ফলে জাহাজ সংকটে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক শিপব্রেকিং ইয়ার্ড। এতে বেকার হয়ে পড়েছে অর্ধ লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারী। যা

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সীতাকুণ্ড সাগর উপকূলে অবস্থিত দেশের একমাত্র জাহাজ ভাঙা শিল্প এখন একেবারে অস্তিত্ব সংকটে ধুঁকছে। গত প্রায় দেড় বছর ধরে বারবার লোহার দাম উঠানামার পর বিগত ৮-৯ মাসে ব্যাংকে ডলার সংকটে এলসি খোলা সম্ভব না হওয়ায় এই শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে অধিকাংশ শিপব্রেকিং ইয়ার্ড এখন বন্ধ হয়ে গেছে। যেসব ইয়ার্ডে ইতিপূর্বে বেশ কয়েকটি জাহাজ আমদানি করা ছিল কেবলমাত্র তারাই কোনক্রমে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ শিপইয়ার্ড বন্ধ থাকায় একদিকে স্ক্র্যাপ লোহার সংকট যেমন বেড়েছে তেমনি বেকার হয়ে পড়েছে এই শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক শ্রমিক। 

সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী, মাদাম বিবিরহাট, সোনাইছড়ি, জোড়ামতল ও কুমিরা পর্যন্ত শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড গড়ে উঠেছে। শিপব্রেকিং ইয়ার্ড়ে আনা একটি জাহাজে ৪০০ থেকে ৮০০ লোক কাজ করে। এই শিল্পের সাথে জড়িত প্রায় সোয়া এক লাখ শ্রমিক আর পরোক্ষভাবে জড়িত সাড়ে ৩ লক্ষ। গত কয়েক মাসে শিপ ইয়ার্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে হাজার হাজার শ্রমিক। বর্তমানে ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল ৫০ শতাংশ যোগানদাতা এই শিপব্রেকিং ইয়ার্ড। এই ইস্পাত কারখানাগুলো শিপ ব্রেকিং লৌহজাত কাঁচা মালের উপর নির্ভরশীল। এমন পরিস্থিতিতে সম্ভাবনাময় ইস্পাত খাত পড়েছে সংকটে পড়েছে চরমভাবে ।

বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স এন্ড রি-সাইক্লার্স এসোসিয়েশন (বিএসবিআরএ) সূত্র জানিয়েছে, ৬০ এর দশকে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট সাগর উপকূলে ঝড়ে আটকে পড়া স্ক্র্যাপ জাহাজ কুইন আল-পাইন ভাঙার মধ্য দিয়ে যে সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিলো তা সময়ের সাথে সম্প্রসারিত হয়ে ৮০ এর দশকে একটি লাভজনক শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে তা আরো দ্রুত ছড়িয়ে বর্তমানে কুমিরা পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে এখানে ১৬০টি শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের অনুমোদন আছে। কিন্তু বিগত দিনে করোনা মহামারীসহ নানা কারণে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হলে অনেক ইয়ার্ডে জাহাজ আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে তা আরো ভয়াবহ হয়ে উঠে।

বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইকেলার্স অসোসিয়েশন এর তথ্য মতে, গত ২০২১ সালের প্রথম আট মাসে ২০০টি স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে, যার ওজন ১৯ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫১৩ টন, ২০২২ সালে প্রথম আট মাসে অর্ধেকে নেমে ১০৩ টি জাহাজ আমদানি হয়েছে, যার ওজন ৮ লক্ষ ৩৪ হাজার ৪৫৬ টন। গড়ে বছরে ২০০টি স্ক্র্যাপ জাহাজ ভাঙ্গা হয় এই সীতাকুণ্ড শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে। বর্তমানে জাহাজ আমদানি নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়। বছরে এই শিল্প থেকে লেনদেন হয় ১৫ হাজার কোটি টাকা। তবে দেশে লোহা জাতীয় শিল্প কাঁচামাল ৫০ শতাংশ যোগানদাতা এই শিল্পের কার্যক্রমে এখন স্থবিরতা বিরাজ করছে।

সীতাকুণ্ডের প্রবীণ শিপব্রেকার্স এসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি আরেফিন এন্টারপ্রাইজ শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের মালিক আলহাজ কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিগত এক দশকে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে চলছে জাহাজ ভাঙা শিল্প। এর মধ্যে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের কার্যক্রম। কখনো অতিরিক্ত ভ্যাট আরোপ, কখনো আন্তর্জাতিক বাজারে লোহার মূল্য বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিপুল লোকসানের শিকার হয়েছেন মালিকরা। এরই মধ্যে আসে মহামারী করোনা ভাইরাস। ব্যবসা বন্ধ করে রাখতে হয়েছে দীর্ঘদিন। কিন্তু এলসির বিপরীতে ব্যাংক লোন পরিশোধ বন্ধ ছিলো না। আয় বন্ধ কিন্তু ব্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন মালিকরা। সেই ঘাটতি পূরণের আগেই এবার আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে আসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের মারাত্মক কুপ্রভাব পড়েছে সারা পৃথিবীতে। যুদ্ধের প্রথম দিকে ডলারের মূল্য অবিশ্বাস্য বেড়ে যাওয়ায় টাকার মান কমে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট। ডলার সংকট থাকায় কোন এলসি খুলছে না ব্যাংক। এর ফলে কোন মালিক বিগত ৫-৬ মাস ধরে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করতে পারছেন না। ফলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

জাহাজ ভাঙ্গা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরাম যুগ্ম আহবায়ক এ এম নাজিম উদ্দিন বলেন, ডলার সংকটে ও এলসি জটিলতার কারণে দীর্ঘ ৮ মাসেরও বেশি সময় ধরে শিপব্রেকিং এর কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অনেক ইয়ার্ড বন্ধ। বন্ধের পথে আরো অনেক ইয়ার্ড। ফলে প্রায় অর্ধ লক্ষ শ্রমিকের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইকেলার্স এসোসিয়েশন সভাপতি এম এ তাহের বলেন, বর্তমানে যে দুঃসময় নেমে এসেছে তাতে আমরা টিকে থাকতে পারবো কিনা জানি না। ব্যাংক তো এলসি দিতে পারছে না। ব্যাংকে ডলার নেই। এ রকম হলে জাহাজ আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে ইয়ার্ডও বন্ধ হয়ে যাবে। এতে মালিক, শ্রমিক-কর্মচারি সবাই চরম ক্ষতির শিকার হবেন বলে জানান তিনি ।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;