আজ মধ্যরাত থেকে লকডাউন শুরু - কন্ট্রোল রুম চালু, বন্ধ হচ্ছে উত্তর কাট্টলীর ২০ প্রবেশপথ

আজ মধ্যরাত থেকে লকডাউন শুরু - কন্ট্রোল রুম চালু, বন্ধ হচ্ছে উত্তর কাট্টলীর ২০ প্রবেশপথ
আজ মধ্যরাত থেকে লকডাউন শুরু - কন্ট্রোল রুম চালু, বন্ধ হচ্ছে উত্তর কাট্টলীর ২০ প্রবেশপথ

মোরশেদ তালুকদার ।।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে নগরের উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডে ২১ দিনের লকডাউন শুরু হচ্ছে আজ রাত ১২টা থেকে। লকডাউন শতভাগ কার্যকরে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং স্থানীয় বাসিন্দারা। চসিকের পক্ষে ওর্য়াডটিতে ঢোকার ২০টি প্রবেশপথ চিহ্নিত করে তা বন্ধ করার কাজ শুরু হয়েছে। একইসঙ্গে সাধারণ মানুষকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। প্রস্তত করা হচ্ছে মহল্লা ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক টিম। গতকাল দিনভর মাইকিং করে চালানো হয়েছে প্রচারণা।

এদিকে ওয়ার্ডের বাসিন্দারা অবরুদ্ধ দিনকে সামনে রেখে নিত্যপণ্যের বাজার সংগ্রহ শুরু করেন। গতকাল দিনভর কাঁচাবাজার, মাছ-মাংসের দোকানের পাশাপাশি মুদি দোকানে ভিড় করেন তারা। কিনেছেন যে যার মতো। তাদের কথা-বার্তায় মনে হয়েছে, ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দাদের বেশিরভাগই লকডাউনকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। তবে ওয়ার্ডটির এক তৃতীয়াংশই শিল্পজোন এলাকায় হওয়ায় সেখানকার সিংহভাগ বাসিন্দাই অন্য জায়গার। যারা বিভিন্ন বাসায় ভাড়ায় থাকেন। লকডাউনের দিনগুলোতে এদের বেশিরভাগই কর্মহীন হয়ে পড়বে। ফলে এসময় খাদ্য সরবরাহ কে করবে সেটা নিয়ে এখন থেকেই দুশ্চিন্তা ভর করেছে তাদের।

চার বর্গমাইল আয়তনের উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডটির কিছু অংশ পাহাড়তলী এবং কিছু অংশ আকবর শাহ থানায় পড়েছে। ওয়ার্ডের পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল সড়ক, উত্তরে কালির ছড়া এবং দক্ষিণে সাগরিকা সড়ক। তবে এ ওয়ার্ডের প্রবেশপথ আছে ২০টি। যার সবগুলোই বন্ধ করে দিবে চসিক। গতকাল থেকে এর কাজ শুরুও হয়েছে। প্রবেশপথগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কর্নেল টোল রোড, ঈশান মহাজন রোড, মোস্তফা হাকিম কলেজ রোড, সাগরিকা বিটেক রোড, কৈবল্যধাম রোড, নিউ মনছুরাবাদ রোড, সিডিএ আবাসিক রোড, সাগরিকা আলিফ রোড।

এদিকে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। এলাকার মানুষের সার্বিক সহায়তার জন্য মহল্লাভিত্তিক সেচ্ছাসেবক টিম কাজ করবে। কন্ট্রোল রুমে এর নম্বর ০৩১-৪৩১৫১৩৬৮, ০৩১-৪৩১৫১৩৬৯, ০৩১-৪৩১৫১৩৭০, ০৩১-৪৩১৫১৩৭১, ০৩১-৪৩১৫১৩৭২, ০১৮১৯-০৫৬৮৪৪ এবং ০১৮১১-৮৮৭০৮৪। লক ডাউন কার্যকর থাকাকালীন সময়ে স্থানীয় বাসিন্দারা যে কোন সমস্যা এসব নম্বরে ফোন করে জানাতে পারবেন।

চসিকের ব্যবস্থাপনায় কোভিড ও নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা ও হাসপাতালে প্রেরণের জন্য সার্বক্ষণিক এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। হতদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের পরিবারসমূহের জন্য সেচ্ছাসেবক টিমের মাধ্যমে খাদ্য সহায়তা প্রদান করবে এবং সামর্থ্যবানদের জন্য নির্দিষ্ট ভ্যানে বা ই-কমার্সের আওতায় প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও জরুরি ওষুধ ন্যায্যমূল্য সরবরাহ করা হবে।

উল্লেখ্য, কাট্টলী ওয়ার্ডে মোট জনসংখ্যা ৭৮ হাজার। গত ১৩ জুন পর্যন্ত সর্বশেষ ১৪ দিনে এ ওয়ার্ডে ১৪৫ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন এবং মারা যান সাতজন। করোনা প্রতিরোধে সেন্ট্রাল কমিটির সিদ্ধান্ত ছিল, চট্টগ্রাম ও ঢাকা শহরে প্রতি লাখ জনগোষ্ঠির মধ্যে সর্বশেষ ১৪ দিনে ৬০ জন সংক্রমিত হওয়া এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সে হিসেবে রেড জোনের আওতায় আসে উত্তর কাট্টলী। এ ওয়ার্ডে প্রায় ১৫০ টি কলকারখানা আছে। চট্টগ্রাম সিটি গেট, কৈবল্যধাম মন্দির এবং জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামও এ ওয়ার্ডে অবস্থিত। কৈবল্যধাম রেলস্টেশন ও ক্রিকেট স্টেডিয়াম রেলওয়ে স্টেশন নামে দুটি রেলস্টেশন আছে ওয়ার্ডটিতে।

ভিড় ছিল বাজারে :
ওয়ার্ডটিতে থাকা বড় বাজারগুলোর মধ্যে রয়েছে সাগরিকা বিটাক বাজার, ইশান মহাজন রোডস্থ বটতল (ভ্যানগাড়ি করে পণ্য বিক্রি হয় এখানে), কর্নেলহাট বাজার এবং কর্নেলহাট বাজারের পশ্চিম দিকে কমিউনিটি সেন্টার মোড় বাজার। গতকাল দিনভর এসব বাজারে জমজমাট ছিল বিকিকিনি। সাধারণ সময়ের তুলনায় ভিড় ছিল তীব্র। তবে হঠাৎ করে চাহিদা বাড়ায় পণ্যমূল্যের দাম বেশি নেয়ারও অভিযোগ পাওয়া যায়।

গতকাল দুপুরে উত্তর কাট্টলী এলাকার বাসিন্দা মুহাম্মদ শওকত ওসমান এরশাদ বাজার করতে আসেন কর্নেলহাট বাজারের পশ্চিম দিকে কমিউনিটি সেন্টার মোড়স্থ বাজারে। তিনি বলেন, হঠাৎ করেই বাজারে ক্রেতার উপস্থিতি বেড়েছে। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। লকডাউনে তো দোকানপাট খোলা থাকবে না। তাই মজুদ করা ছাড়া উপায়ও নেই। তবে বাজারে ক্রেতা বাড়ার সাথে সাথে জিনিসপত্রের দামও বেড়ে যাচ্ছে। ঘন্টাখানেকের ব্যবধানে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের দাম কেজি প্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকাও বেড়ে গেছে। সবজিরও দাম বেড়েছে। স্থানীয় এই বাসিন্দা এও বলেন, বেশিরভাগ মানুষ লকডাউন কড়াভাবে পালন হোক সেটা চায়। এতোদিন বিকেল চারটায় দোকানপাট বন্ধের নির্দেশনা থাকলেও ভেতরের বিভিন্ন এলাকায় রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত খোলা থাকতো। বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এবার লকডাউন কার্যকরে প্রশাসনের কড়া নজরদারি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

উত্তর কাট্টলীর বাসিন্দা ও নগর যুবদলের সহ-সভাপতি শাহেদ আকবর  বলেন, সকাল থেকে কাট্টলীর বিভিন্ন বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। মুরগী পর্যন্ত পাচ্ছি না। খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত না হলে লকডাউন কার্যকর কঠিন হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা শিল্প এলাকা। বেশিরভাগ শ্রমিক এখানে ভাড়া থাকে। এদের হার প্রায় ৬০ শতাংশ। লকডাউনে তারা কর্মহীন হয়ে পড়বে। অনেক প্রতিষ্ঠান দেখা যাবে কাজ না করলে বেতন দিচ্ছে না। সেক্ষেত্রে তারা কিভাবে চলবে। বিত্তশালীদের হয়তো সমস্যা হবে না। কর্মহীন হয়ে পড়া লোকগুলোর কিন্তু অনেক সমস্যা হবে। সহযোগিতা না পেলে তাদের উপোস থাকতে হবে।

লকডাউনে যা মানতে হবে :
লকডাউন কার্যকর থাকাকালীন সময়ে এলাকায় কেউ প্রবেশ ও বের হতে পারবে না। সরকারি-বেসরকারি অফিস থাকবে সাধারণ ছুটির আওতায়। খাবার ও ওষুধসহ সবধরণের দোকানপাট বন্ধ থাকবে। চলবে না গণপরিবহন, থাকবে না স্টপেজও।

এ বিষয়ে গতকাল সিটি কর্পোরেশনের এক গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রধান সড়কে কোন প্রকার যাত্রী ওঠা-নামা চলবে না, তবে রাত ১২ টা থেকে ভোর ৬ টা পর্যন্ত পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল উম্মুক্ত থাকবে। এলাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দোকান-পাঠ, অফিস, কল-কারখানা, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প বন্ধ থাকবে। লকডাউন এলাকায় কোনভাবেই ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না। কোন ধর্মীয় উপাসনালয়ে না গিয়ে নিজ নিজ গৃহে প্রার্থনা /উপাসনা করতে হবে।

লকডাউন এলাকায় অবস্থানকারী সকল সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারী সাধারণ ছুটির আওতায় থাকবেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তারা যাতে কোন ধরণের সমস্যার সম্মুখীন না হন সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ বিষয়ে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, লকডাউন মানে লকডাউন। সবাইকে অবশ্যই ঘরে থাকতে হবে। বাইরে বের হওয়া যাবে না। ইতোমধ্যে আমরা মাইকিং করেছি। প্রতিটি ঘরে ঘরে নির্দেশনা দিয়ে লিফলেট পৌঁছে দিবো। সবকিছু মনিটরিং করার জন্য কেন্দ্রের ফরম্যাট অনুযায়ী, স্থানীয় কাউন্সিলরক আহবায়ক করে কমিটি হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, ই-কমার্স এসোসিয়েশনের প্রতিনিধি, সমাজ কল্যাণ সমিতির প্রতিনিধি, এনজিও প্রতিনিধি ও স্থানীয় মসজিদের ইমাম সদস্য আছেন।

লকডাউন কার্যকরে নেয়া প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু বলেন, ওয়ার্ডে প্রবেশের প্রায় ২০টি পয়েন্ট বন্ধ করার কাজ করছি। আজ স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে কমিটি করবো। আসলে লকডাউন কার্যকর কঠিন, সহজ না। মানুষকে কতটা সেবা দিতে পারবো সেটার উপর নির্ভর করবে এটা। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। অবশ্য আমাদেরও তো কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। তবে সবাই সহযোগিতা করলে করোনামুক্ত ওয়ার্ড উপহার দিতে পারবো।

লকডাউন কার্যকর থাকা অবস্থায় অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে তাদের খাদ্য সরবরাহের বিষয়টি কিভাবে নিশ্চিত হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিগত তিন মাস ধরে এ বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। এর আগে সাধারণ ছুটি চলাকালীন সময়ে অনেককে আমরা সরকারি এবং ব্যক্তিগতভাবে খাদ্য সহায়তা দিয়েছি। তাদের তালিকা আমাদের কাছে আছে। যাদের প্রয়োজন হবে সরবরাহ করবো। লকডাউনে ওষুধের দোকান বন্ধ থাকবে, তবে কারো জরুরি ওষুধের দরকার হলে হোম ডেলিভারি সার্ভিস দেয়া হবে। ভ্যানগাড়ি করে যারা শাকসবজি বিক্রি করে তাদের দিয়েও হোম ডেলিভারি সার্ভিস দেয়ার পকিল্পনা আছে।