সীতাকুণ্ডের এক জয়িতার গল্প 

সীতাকুণ্ডের এক জয়িতার গল্প 
সীতাকুণ্ডের এক জয়িতার গল্প 

পোস্টকার্ড ডেস্ক ।। 

রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ, রাজশাহী কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের বিলেত ফেরত ডাকসাইটে ইংরেজীর অধ্যাপক-অধ্যক্ষ, নিজে প্রতিষ্ঠা করেন বানেশ্বর ডিগ্রী কলেজ, রাণী ভবানী মহিলা কলেজসহ (দুইটি ডিগ্রী কলেজই পরবর্তীতে সরকারি হয়ে যায়) বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সরকারের প্রথম শ্রেনির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও সুনামের সাথে পালন করেন দায়িত্ব। এমন গুণী এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন মানুষের আদরের রাজকন্যা শামীমা নার্গিস । নাটোর শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে শফীউদ্দীন সরদারের রাজবাড়ীর মতো বিশাল তাদের বাড়িটিও ছিল দেখার মতো। এমনি সমৃদ্ধ এক আবহে তার জন্ম এবং বেড়ে উঠা। কিন্তু বৈবাহিক সূত্রে এসে পড়ে সীতাকুণ্ডের প্রত্যন্ত এক গ্রামে। যে গ্রামে পাকা রাস্তা তো দূরের কথা, কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে রাস্তায় একটি ইঁটও ছিল না।

নব্বইর দশকের শুরুতে সীতাকুণ্ডের যেখানে ভালোভাবে বসবাসের রাজকীয় সু্যোগ সুবিধা তো দূরের কথা, বিদ্যুতের মতো অতি সাধারণ এবং প্রয়োজনীয় জিনিসটিও ছিল অনুপস্থিত। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে গ্রামটি অন্ধকারে ডুবে যেতো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীতে অনার্সে পড়া  শামীমা নার্গিস হয়তো গ্রামটির অতি সাধারণ এক পরিবারের বউ হয়ে এসে চোখে মুখে অন্ধকার দেখেছিল। কিন্তু বিনি সুতার এক বাঁধনে আটকা পড়ে তিনি কেমোন করে যেনো সব সামলে নিচ্ছিলেন । 

অসীম ধৈর্যে জাগতিক সবকিছু তুচ্ছ করে সে গ্রামটিতে থেকে যায়। সন্ধ্যায় কেরোসিন ঢেলে হারিকেন আর কুপিবাতি জ্বালিয়ে যেখানে একরত্তি আলোর ব্যবস্থা হতো, সেই আলোয় মেয়েটি পড়তো শেক্সপিয়র, টি এস এলিয়ট, শেলী, বায়রণ, জন কীটস কিংবা রবার্ট ফ্রস্ট । ঘরের সামনের কাঁচা উঠোনে খেলা করতো জোনাকি। জোনাকির সেই মিটিমিটি আলোর ঝলকানিতে মেয়েটির স্বপ্নগুলোও বুঝি ঝিলিক দিতো। বর্ষায় চারদিকে কাদাপানি , বাড়িতে এমনকি উঠোনেও সাপের ছোটাছুটি কিংবা রাতবিরাতের ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকে ভুতুড়ে হয়ে উঠা ওই পরিবেশে কাটতো মেয়েটির দিনরাত্রি। কিছুদিন সীতাকুণ্ডের শ্বশুরবাড়ি আবার কিছুদিন নাটোরে বাপের বাড়িতে দৌঁড়ঝাপ করতে করতে সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকে শামীমা নার্গিস। এই দৌঁড়ঝাপ যে কী পরিমান ভয়ংকর ছিল তা আজ কল্পনা করাও কঠিন। সীতাকুণ্ড থেকে প্রায় ৫শ’ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে ৩০ ঘন্টাও পথে থাকতে হতো। তখনো এসি গাড়ির প্রচলন হয়নি, সরাসরি বাস সার্ভিসের কথা কেউ চিন্তাও করেনি। তিন-তিনটি ফেরি পার হয়ে এবং ঢাকায় বাস পাল্টে চট্টগ্রাম থেকে নাটোর যেতে হতো। এরমধ্যে ফেরিতে শুধু যমুনা নদী পার হতে স্বাভাবিক সময়ে লেগে যেতো তিনঘন্টা। অস্বাভাবিক কিছু হলে এমনকি কুয়াশা বাড়লেও নন-এসি বাসে পুরোরাত যমুনার পাড়ে বসে থাকার ঘটনাও কম ঘটেনি। তবুও মা-বাবা এবং ভাইবোনদের উৎসাহ তাকে দুঃসহ সেই বিবর্ণ সময়ে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে প্রাণিত করেছে। ৭দিন বয়সী কন্যাশিশুকে সাথে নিয়ে সে অনার্সের ফাইন্যাল পরীক্ষায় বসেছিল। বাচ্চার ৪০ দিন বয়সে তার পরীক্ষা শেষ হলো। অনার্সের পর একইভাবে অবর্ণনীয় কষ্ট সয়ে সে ইংরেজী সাহিত্যে এমএ-ও পাস করলো। বাপের মতো ডাবল এমএ করার শখ ছিল তার। শখ ছিল এম ফিল বা পিএইচডি করার। কিন্তু কপাল তাকে যেখানে এনে আটকে দিয়েছে সেখানে আর কিছু করার সু্যোগ ছিল না।

স্বামী, সন্তান, সংসার এবং শ্বশুরবাড়ির নানা ঝামেলা সয়ে তার এই দীর্ঘ পথচলা মোটেই সহজ ছিল না। পথের বাঁকে বাঁকে  মোকাবেলা করতে হয়েছে প্রতিবন্ধকতা। 

এম এ পাস করার পর ২০০০ সালে সে সীতাকুণ্ড মহিলা কলেজে ইংরেজী বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। গত প্রায় দুই যুগ ধরে সে ছাত্রীদের ইংরেজী পড়ায়। বরাবরই ভালো রেজাল্ট করা কলেজটিতে গ্রামের মেয়েরা পড়ে। ছাত্রীদের সে শুধু পড়ায়ই না, স্বপ্নও দেখায়। তাদের বড় হওয়ার, মানুষ হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। অভাবী ছাত্রীদের পাশে থাকা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। শুধু বই বা শিক্ষা সামগ্রীই নয়, তাদের কলেজের বেতন, পরীক্ষার ফি প্রভৃতির যোগানেও পাশে থাকে। তার বিশ্বাস সমাজের অর্ধেকেরও বেশি নারী পিছিয়ে থাকলে সমাজ এগুবেনা। তাই নারী শিক্ষায় অনেক বেশী মনযোগ এবং গুরুত্ব দিতে হবে। তার ভাবনাগুলো সে নিজের মতো করে লালন করে, ছাত্রীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাধ্যমতো পাশে থাকেন ।

আর সেই সীতাকুণ্ড সরকারি মহিলা কলেজের ইংরেজী বিভাগের প্রধান শামীমা নার্গিসকে এবছরই সীতাকুণ্ড উপজেলা প্রশাসন ও মহিলা অধিদপ্তর বেগম রোকেয়া দিবসে শিক্ষা ও চাকুরি ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে তাকে সম্মানিত করেন ।

তিনি পেলেন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নিজের একটি অবস্থান তৈরি করার স্বীকৃতি । সীতাকুণ্ড উপজেলা পরিষদ মিলনায়নে বর্ণাঢ্য এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার কেএম রফিকুল ইসলাম তার হাতে এই সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন।

শামীমা নার্গিসের স্বামী প্রখ্যাত সাংবাদিক দৈনিক আজাদীর চিফ রিপোর্টার হাসান আকবর বলেন, আজ মনে হচ্ছে তার কোন কষ্টই বৃথা যায়নি। মানুষের জন্য কিছু করলে, মানুষের পাশে থাকলে তার বিনিময় যে সাগরের ঢেউয়ের মতো কোটিগুনে ফেরত আসে আমার সেই বিশ্বাসও মিথ্যা হয়নি।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;