পুরোনো ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে অনলাইনে গুজব, বাড়ছে সহিংসতার ঝুঁকি

পুরোনো ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে অনলাইনে  গুজব, বাড়ছে সহিংসতার ঝুঁকি
পুরোনো ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে অনলাইনে গুজব, বাড়ছে সহিংসতার ঝুঁকি

আবদুল্লাহ আল মামুন ।।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অনলাইনে পুরোনো ছবি-ভিডিও শেয়ার করে অপতথ্য বা গুজব প্রচারের ঘটনা বহু দিন ধরে চলছে। তবে নির্বাচন, রাজনৈতিক দলের বড় আন্দোলন, ধর্মীয় উৎসব বা কোনো উপলক্ষকে কেন্দ্র করে এ ধরনের অপতথ্য বা গুজব প্রচারণা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

আসন্ন নির্বাচন ও রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ঘিরে অনলাইনে শুরু হয়েছে অপতথ্য ও গুজব প্রচার। ফলে এ ধরনের গুজব কাজে লাগিয়ে ফের সহিংসতা ছড়ানোর আশঙ্কা করছেন অনেকে। তবে গুজব রটনাকারী যেই হোক তাকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে পুলিশ।

তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও আইন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২২ সালেই প্রায় ১৪০০ গুজব শনাক্ত করেছে একটি ফ্যাক্ট চেক প্রতিষ্ঠান। সাইবার অপরাধের অভিযোগে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩০০টির বেশি মামলায় ১ হাজার ৭০০ জনের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শুধু গুজব ছড়ানোর ঘটনায় গত প্রায় ৩ বছরে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন থানায় শখানেক মামলা হয়েছে।

অন্যদিকে ২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ১ হাজার ৪০০টির বেশি ক্ষতিকর লিংক অপসারণে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অনলাইনে গুজব ও সব ধরনের অপতথ্য প্রচার বন্ধসহ সাইবার জগৎ মনিটরিংয়ে পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটকে প্রযুক্তিগতভাবে শক্তিশালী করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা না গেলে গুজব বা অপতথ্য প্রচার বন্ধ করা যাবে না বলে মনে করেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা।

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তানভীর হাসান জোহা সময়ের আলোকে বলেন, মানুষ কোনো বিষয়ে জানতে গিয়ে সঠিক তথ্য না পেয়ে ফেসবুকের বিভিন্ন পেজ বা গ্রুপে যায়। আবার সেসব গ্রুপ বা পেজ নিজেদের ভিউ বাড়াতে ফেক বা অপতথ্য প্রচার করে থাকে। তার মতে, সমাজে তথ্যের অবাধ প্রবাহ থাকলে মানুষ গুজবে আশ্রয় নেবে না এবং বিশ্বাস করবে না। একই সঙ্গে গুজব রটনাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করলে অন্যরা ভবিষ্যতে সাহস করবে না।

গত রোববার তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাব সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে অপতথ্য ছড়ানোর চিত্র তুলে ধরে নিজেদের ওয়েবসাইটে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তারা এ ধরনের অন্তত আটটি নজির পেয়েছে, যেখানে একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তিও ভুয়া তথ্য শেয়ার করেছেন। প্রতিষ্ঠানটি দেখতে পেয়েছে, গত ২৮ ও ২৯ জুলাই রাজধানীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুরোনো ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটারসহ অনলাইনে শেয়ার করে মিথ্যা প্রচার চালায়। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ঢাকা-১৭ সংসদীয় আসনের সদ্যনির্বাচিত সংসদ সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমও পুরোনো ছবি বর্তমান সময়ের বলে শেয়ার করেছেন।

ডিসমিসল্যাবের তথ্যে আরও দেখা গেছে, ফেসবুকে বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের রক্তাক্ত ছবি শেয়ার করে সেটি বর্তমান সময়ের বলে দাবি করা হয়। অথচ রক্তাক্ত সেই ছবিটি ২০১৮ সালে কেরানীগঞ্জে বিএনপির গণসমাবেশ চলাকালে তোলা হয়েছিল।

তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই ধরনের গুজব আছে। একটি নির্দোষ গুজব-যা কোনো অপরাধের আশঙ্কা সৃষ্টি করে না। অন্যটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার-যার মাধ্যমে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ ব্যক্তি, সরকার ও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়াও কিছু অনলাইন পোর্টালকে এ ধরনের গুজব প্রচার করতে দেখা যায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আসন্ন নির্বাচন ও রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুরোনো ছবি বা ভিডিও ছড়ানো হলে সরকারসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা বিভ্রান্ত হয়ে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়তে পারেন। এ ছাড়া এমন অপপ্রচারে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিসহ রাজনীতিবিদ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বড় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। এর আগে সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া তথ্য প্রচার করে গুজব ছড়ানোর কারণে কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, রংপুরের গঙ্গাচড়ায় গুলি ও মৃত্যুর মতো নৃশংস ঘটনা ঘটেছে।

গত ১৭ জুলাই নির্বাচনি গুজব মোকাবিলায় কতটুকু প্রস্তুত বাংলাদেশ-শিরোনামের একটি অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় ইউল্যাবের অধ্যাপক ও ফ্যাক্টওয়াচ সম্পাদক ড. সুমন রহমান বলেছেন, নির্বাচনি গুজব মোকাবিলায় বাংলাদেশ একেবারেই তৈরি না এবং তৈরি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। একই অনুষ্ঠানে ব্লগার ও অ্যাকটিভিস্ট আরিফ জেবতিক বলেছেন, আমাদের এখানে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত প্রপাগান্ডা সবচেয়ে বেশি। এই প্রপাগান্ডা থেকে গুজবের উৎপত্তি।

ফ্যাক্ট চেক সংগঠন রিউমার স্ক্যানারের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে তারা অন্তত ১ হাজার ৪০০টি গুজব শনাক্ত করেছে। এর মধ্যে ধর্মীয় বিষয়ে গুজব ছিল ২০৬টি। রাজনীতিবিষয়ক ৯২টি, জাতীয় ইস্যুতে ১১৫টি, খেলাধুলা নিয়ে ১৫৬টি এবং শিক্ষা বিষয়ে ৩৮টি গুজব ছড়ানো হয়। এর বাইরে কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে ১১১টি গুজব এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় দেশে ছড়িয়ে পড়া ৬৬টি ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর তথ্যও শনাক্ত করা হয়।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার ক্রাইম ইউনিট, ডিবি এবং র‌্যাবের সাইবার ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে এখন পর্যন্ত সাইবার অপরাধের অভিযোগে ১ হাজার ৩০০টির বেশি মামলা ও ১ হাজার ৭০০ জনের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুধু গুজব ছড়ানোর ঘটনায় গত প্রায় ৩ বছরে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন থানায় অন্তত ৯৮টি মামলা হয়েছে। অন্যদিকে ২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ১ হাজার ৪০০টির বেশি ক্ষতিকর লিংক অপসারণের জন্য বিটিআরসিকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

পুলিশ ও গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, গুজব ঠেকাতে পুলিশের কয়েকটি বিশেষায়িত ইউনিটে সাইবার ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে একেকটি ল্যাব স্থাপনে ৮ কোটি থেকে ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেন বলেন, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত অন্যান্য সংস্থা গুজব প্রতিরোধে কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে গুজব রটনাকারী যেই হোক কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না এবং ভবিষ্যতেও তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া অব্যাহত থাকবে। সময়ের আলো

খালেদ / পোস্টকার্ড ;