বাস্তু সংকটে সীতাকুণ্ড

বাস্তু সংকটে সীতাকুণ্ড
বাস্তু সংকটে সীতাকুণ্ড

মেজবাহ খালেদ।।

সীতাকুণ্ডের কুমিরার কৃষক সমিউল হক । বয়স প্রায় ৭৫ ছুঁই ছুঁই । তার প্রায় ২০০ নারিকেল গাছ আছে । সেই গাছ থেকে ডাব আর নারিকেল বিক্রি করে সংসারের খরচ চালাতেন । পাশাপাশি অন্যের কাছ থেকে ডাব , নারিকেল কিনে সে বিক্রি করে থাকেন। কিন্তু হঠাৎ করে গত বছর থেকে তার নারিকেল গাছের মধ্যে প্রায় গাছেই ফুল , ফল আসছে না । কিছু কিছু গাছে প্রাথমিক আকারে ছোট ছোট কলি আসলেও ঝরে যাচ্ছে । তার গাছের ফলন আগের মতো না হওয়ায় তার সংসারের দেখা দিয়েছে অভাব অনটন । এ বয়সে যেন বড় ধাক্কা খেলেন তিনি । বিকল্প কোন আয়ের উৎস খুঁজে না পেয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন। তাছাড়া তাঁর সাথে কথা বলে জানা যায় , শুধু তাঁর গাছে না সে যাদের কাছ থেকে ডাব বা নারিকেল কিনে বিক্রি করতো তাদের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা দেখা দিয়েছে ।

এদিকে গত শীতে খেজুর রস তেমন পাওয়া যায়নি বলে জানান বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের হাতিলোটা এলাকার গাছি রহিম উল্ল্যাহ । তিনি শীতের শুরুতেই নিজের ও চুক্তিতে নেওয়া শতাধিক খেজুর গাছ পরিষ্কার করেন এবং গাছে রসের হাঁড়ি বসানোর দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা পর কাক ডাকা ভোরে এসব গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য ছোটেন গ্রামে গ্রামে। তাতে বাড়তি আয় হওয়ায় পরিবারে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসে। তিনি আফসোস করে বলেন, এক সময় প্রচুর খেজুর গাছ ছিল। কিন্তু এখন গাছ কমে গেছে। তাছাড়া আগের মতো গাছে রস পাওয়া যায়না। চাহিদার তুলনায় রস পাওয়া যায় না। তাতে তিনি বেশ হতাশ ।

অন্যদিকে, সীতাকুণ্ডের বাড়বকুন্ডের কৃষক রফিকুল ইসলাম জানান, তাঁর জমির রোপা আমনের চারায় ফাটল দেখা দিয়েছে । পাশাপাশি মৌসুমি ও বারোমাসি সবজি খেতে ফাটল । তিনি বলেন, শুধু আমি না, তীব্র তাপদাহে পুড়ছে যেন সীতাকুণ্ডের কৃষকের কপাল। একদিকে তীব্র পানি সংকট অন্যদিকে অত্যাধিক তাপদাহে রোপণ করা রোপা আমনের চারায় ফাটল ধরেছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বীজতলা ।

উপজেলার একাধিক কৃষকের সাথে কথা বলে জানা যায়, অত্যাধিক তাপদাহে ঘর থেকে বের হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। নদী–নালাগুলোয় পানি থাকার কথা থাকলেও তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। গত বছর আগস্টের পর থেকে নিয়মিত বৃষ্টি না হওয়ায় এ অবস্থা বলে জানান তাঁরা । আর তাই জমির ধান নষ্ট হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মৌসুমের আবাদ এখন অনিশ্চিত।

তিনি বলেন, একদিকে তীব্র পানি সংকট অন্যদিকে অত্যাধিক তাপদাহে আমরা বিপর্যস্ত । তাছাড়া এলাকার নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছেনা । যে ক'টাতে পাওয়া যাচ্ছে তা দিয়ে সেচ করে চাষাবাদ করলে খরচ বেড়ে যাবে। ঘন ঘন সেচ আর অতিরিক্ত খরচ করে চাষাবাদের ফলাফল শূন্য।

মুরাদপুর ইউনিয়নের কৃষক খোরসেদ আলমের সাথে কথা হয় , তিনি হা হুতাস করতে করতে বলেন, সমিতি থেকে টাকা নিয়ে অনেক কষ্টে মাঠের পাশে একটি ডোবা থেকে পানি সেচে আড়াই বিঘা জমিতে ধানের চারা রোপণ করেছি। কিন্তু ১৫ দিনের মাথায় রোপণ করা ধান গাছগুলো পুড়ে গেছে। বৃষ্টি না হলে এবার আর ধান হবে না।

শুধু একজন–দুজন নয়, প্রায় সবার জমিতে একই অবস্থা। এ বছর পানির অভাবে অনেক কৃষক বীজতলা তৈরি করতে পারেননি। একই কথা জানিয়েছেন স্থানীয় মৌসুমি ও বারোমাসি সবজি উৎপাদনকারীরাও। 

স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সীতাকুণ্ডে সারাবছর সবজি উৎপাদন হতো এক সময় । হরেক রকমের সবজিতে ছেয়ে থা্কতো এ উপজেলার ফসলি জমি। এখানে উৎপাদিত সবজির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শিম, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, মিষ্টি কুমড়ো, ঝিংগা, চিচিঙ্গা, বেগুন, বরবটি, করলা, কাঁকরোল, পেঁপে, সজিনা, ঢেডস প্রভৃতি ক্ষেতে উৎপাদিত এ সবজি স্থানীয় বাজারে বিক্রয়ের পাশাপাশি পাইকারদের হাত ধরে চলে যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। কিন্তু এখানে চাষাবাদে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা বা সমস্যাও আছে। এসব সমস্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পানি সংকট। শুকনো মৌসুমে পাহাড়ি ছরাগুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। সবজি ক্ষেতে টিউবয়েল বসিয়েও পানি পাওয়া যায় না। ফলে তীব্র পানি সংকটে অনেক জমি অনাবাদী ফেলে রাখতে হয়। অথচ পানি পাওয়া গেলে সমগ্র উপজেলার এসব পতিত জমিতেও কোটি কোটি টাকার সবজি উৎপাদন হতো।

শুধু এসব বিষয় না । কথা হয় উপজেলার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের মান্দারিটোলা গ্রামের মুহাম্মদ ফারুকের  (৪৫) এর সাথে । পেশায় চায়ের দোকানদার। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, তার পরিবারসহ প্রতিদিনই এ এলাকার মানুষের ঘুম ভাঙে আতঙ্কের মধ্যে। গত বছরের বিএম কন্টেইনারে অগ্নিকাণ্ড ও ভয়াবহ বিস্ফোরণে ৫১ জনের মৃত্যুর পর নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে বঙ্গোপসাগর তীরে গড়ে ওঠা অপরিকল্পিত ১২টি গ্যাস প্লান্ট নিয়ে। এ ছাড়াও উপজেলায় এলপিজি গ্যাস প্লান্ট, শিপব্রেকিং ইয়ার্ড, সিমেন্ট ও স্টিল ফ্যাক্টরি, পাটকল ও কন্টেইনার ডিপোগুলো কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়াই এসব গড়ে উঠেছে।  

স্থানীয়দের অভিযোগ, বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের শুধু মান্দারিটোলা ও নাদালিয়া গ্রামেই অন্তত ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। সবাই এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। যেকোনো সময় বড় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলে পুরো গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে।

সীতাকুণ্ডের বাস্তু সংকট নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক রাসেল । তিনি সময়ের আলো'র সাথে দীর্ঘ আলাপচারিতায় বলেন , নারিকেল গাছ বা খেঁজুর গাছ অথবা অন্যান্য গাছের শেকড় খাদ্য পাচ্ছেনা তাই ফলন দিচ্ছেনা ।

তিনি বলেন , আগে রাস্তার দুপাশে ত্রিফলা জমি ছিল সে সব এখন কমার্শিয়াল স্পেস হয়ে জমি বিলিন হয়ে গেছে । খালি জমিতে ঘর বাড়ী হচ্ছে , শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠছে । অপরিকল্পিত শিল্পগুলো বা বাড়ীগুলো যে হারে গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি টানছে তাতে পানির লেয়ার নীচে নেমে যাচ্ছে । সংকট দেখা দিয়েছে পানির ।

এমনিতেই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও দূষণে বিপর্যস্ত সীতাকুণ্ড । একপাশে সমুদ্র ও অন্যপাশে সারিবদ্ধ পাহাড়, মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক, কাছেই দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর । এসব মিলিয়ে এই উপকূলীয় অঞ্চল। সীতাকুণ্ডজুড়ে গড়ে ওঠেছে অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজনক জাহাজভাঙা শিল্পের কারণে সীতাকুণ্ড বিশ্বব্যাপী পরিচিত ।

সীতাকুণ্ডে একে একে গড়ে ওঠেছে ভারী শিল্প, জাহাজভাঙা শিল্প, রি-রোলিং মিলসহ অসংখ্য শিল্প-কারখানা। ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক সুবিধার সুবিধাভোগী হয়েছেন ও হচ্ছেন অসংখ্য শিল্পকারখানার মালিক। বিনিময়ে সীতাকুণ্ডকে দিতে হচ্ছে অপূরণীয় পরিবেশ ও প্রতিবেশগত মূল্য। সীতাকুণ্ডের পাহাড়ি ছড়া, খাল, পাহাড় গিলে খাচ্ছে বড় বড় সব প্রতিষ্ঠান।

শিল্প-কারখানার অনিয়ন্ত্রিত পানি উত্তোলনে পানির স্তর নেমে গেছে অনেক নিচে। তিন হাজার ফুট গভীরে গিয়েও মিলছে না পানি। এভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া মানে যে কোন সময় বড় ধরনের ভূমিকম্পে ভূমিধস হওয়ার আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দেয়। এ রকম যদি কিছু হয় সীতাকুণ্ডের একটা বিশাল জায়গা ভূগর্ভে মিশে যাবে। ইস্পাত তৈরির কারখানায় পানির চাহিদা ব্যাপক। দেশের ইস্পাতের মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ পূরণ হয় সীতাকুণ্ড থেকে। সমস্যা হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি, খাল-বিল, পাহাড় এসবের উপকারিতা ভোগ করত সাধারণ মানুষ। পরিবেশের ক্ষতি করে এসব শিল্প উৎপাদনে কারখানার মালিকরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হলেও, দূষণের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে ।

সীতাকুণ্ডের সার্বিক পরিবেশের দূষণ নিয়ে তেমন কোন সরকারি জরিপ বা গবেষণা হয়নি। যদি হত তাহলে নিঃসন্দেহে উঠে আসত এ অঞ্চলের পানি, বায়ু ও মাটির বিপর্যস্ত অবস্থা। আরেক ভয়াবহ বিপদ কনটেইনার ডিপো নিয়ে। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে যেন-তেনভাবে গড়ে ওঠা এসব ডিপো ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে সীতাকুণ্ডে জনজীবনকে। বিএম ডিপোর দুর্ঘটনা , অক্সিজেন প্লান্টের দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে সীতাকুণ্ডবাসীর এ ভয় আরও বেড়ে গেছে । 

তাছাড়া জাহাজভাঙা শিল্পের ক্ষতিকর প্রভাবে ৪০ কিলোমিটার উপকূলজুড়ে সামুদ্রিক মাছ হারিয়ে গেছে। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে এরকম হাজার হাজার জেলে পেশা পরির্তন করে দৈনিক শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে ঝুঁকিপূর্ণ জাহাজাভাঙা শিল্পে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের করা এক গবেষণায় সীতাকুণ্ডের মাটিতে বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি প্রমাণ করে- কীভাবে জাহাজভাঙার দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। যার কারণে কৃষির উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।

জাহাজভাঙা থেকে নির্গত হয় প্রায় এক ডজনের বেশি বিষাক্ত পদার্থ যার মধ্যে এসবেস্টস খুবই ভয়াবহ। মূলত জাহাজের ইঞ্জিনরুমে থাকা এসব এসবেস্টস শ্রমিকের ফুসফুসে জমা হয়ে তাদের মৃত্যুকে তরান্বিত করছে। এছাড়াও জাহাজের কেবিন রুমে কাঠ দিয়ে তৈরি দেয়ালের পরতে পরতে জমা থাকে এসব বিষ। মূলত অগ্নিদুর্ঘটনার সময় যাতে আগুন ছড়িয়ে না পড়তে পারে, সে জন্য এসব এসবেস্টস রাখা হয়। কিন্তু জাহাজভাঙার পর সে এসবেস্টসযুক্ত কাঠকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে ফার্নিচারেরর দোকান। এসব দোকানেই সস্তা দরে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে বিষযুক্ত এসব ফার্নিচার। আবার দামে কম হওয়ায় ফার্নিচারগুলো বিক্রির উদ্দেশ্যে চলে যায় সারাদেশে। আর এভাবেই জাহাজভাঙার বিষ ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে সর্বত্রে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) চট্টগ্রামের নেটওয়ার্কিং মেম্বার আলিউর রহমান সময়ের আলোকে বলেছেন, প্রতিটি জাহাজে অ্যাসবেসটস, ভারী ধাতু, খনিজ তেল, জাহাজের তলা ও ব্যালাস্ট ওয়াটার, পলিসাইক্লিক অ্যারোমাটি হাইড্রো কার্বনসহ বেশ কিছু বিপজ্জনক পদার্থ থাকে। এসব পদার্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে তা পরিবেশ এবং মানুষের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

এসব দূষণ বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজ করার কথা থাকলেও প্রভাবশালীদের চাপে আইন প্রয়োগ অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। স্বাধীনভাবে কাজ করতে গিয়েও রোষানলে পড়তে হয় পরিবেশের কর্মকর্তাদের।

অন্যদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালকের সাথে কথা বলে জানা যায়, মন্ত্রী, এমপিদের ফোনে বাধ্য হয়ে জরিমানা মওকুফ করতে হয় তাদের ।

ঊনিশ শতকের যে শিল্পবিপ্লব মানুষের জীবনকে সহজ করেছে, বিংশ শতকে এসে সেটাই মানুষের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলছে। শিল্প উৎপাদনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বেড়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। ফলে বাড়ছে উপকূলীয় এলাকা সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা । 

আর এই প্রভাব থেকে মুক্ত নয় উপকূলীয় উপজেলা সীতাকুণ্ড। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার বৃদ্ধির কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার যে বেষ্টনী উপকূলের ম্যানগ্রোভ বন সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লবণাক্ততা ও ভাঙনের কারণে সীতাকুণ্ডজুড়ে শত শত একর ম্যানগ্রোভ বন হারিয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার সীতাকুণ্ড এলাকায় আট হাজার একর ম্যানগ্রোভ বন নিয়ে ইকোনমিক জোন করতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে বনবিভাগের কাছে প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে। এভাবে একদিকে শিল্প কারখানার ধকল, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সীতাকুণ্ড অঞ্চল ধুঁকছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ পরিকল্পিত শিলাঞ্চল গড়ে তোলা, পরিবেশ আইন কার্যকর করা, দূষণ বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করা।

শিল্পায়নজনিত সমস্যার এটি বৈশ্বিক দিক। জাতীয়ভাবে আমরা শিল্পবর্জ্য শোধন ও পরিবেশ রক্ষায় একাধিক আইন প্রণয়ন করলেও বাস্তবে চলছি উল্টো পথে। শুধুমাত্র উন্নয়ন কেন্দ্রিক চিন্তার ফলাফল হচ্ছে অসংখ্য নদীর দূষণে মৃত্যু, অসংখ্য বনের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, সমুদ্রে প্লাস্টিকের স্তূপ জমে বাস্তুতন্ত্রের জন্য একটা দুর্বিষহ পরিস্থিতি তৈরি করা। দিনশেষে উন্নয়ন ভরকেন্দ্রে থাকে মানুষ। মানুষের টিকে থাকার মত পরিবেশ ধ্বংস করলে, শুধু উন্নয়ন থাকবে, উন্নয়নের সুফল ভোগ করার মত কোন মানুষ থাকবে না।

সীতাকুণ্ড নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সদস্য সচিব মোহাম্মদ গিয়াসুদ্দীন বলেন,

১. কেন এই সংকট ?

উত্তর-সীতাকুণ্ডে বিজেএমসি ও বিটিএমসি আওতাধীন কারখানা গুলো বন্ধ হয়ে গেছে পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানাধীন অনেক জুটমিলস ও কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।সম্প্রতি অনেক শীপইয়ার্ড বন্ধ হয়ে গেছে।ফলে অধিকাংশ শ্রমিক/কর্মচারী তাদের পরিবার নিয়ে এখন বাস্তু সংকটে সীতাকুণ্ড।

২. এর জন্য কারা দায়ী ?

উত্তর-বিশ্বব্যাংক,আইএমএফ এর প্রেসক্রিপশন,সরকারি পলিসি ও কারখানা মালিক ।

৩. কিভাবে এত বড় বিপর্যয়ের দিকে সীতাকুণ্ড ?

উত্তর-৮০দশে শুরু আর ধীরে ধীরে এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।অভাবি লোকগুলো এখন কোথায় যাবে ?অনেকে ৪০/৫০বছর ধরে সীতাকুণ্ডে আছে।

৪. এর জন্য কি অপরিকল্পিত শিল্পায়ন দায়ী ? কেন দায়ী ?

উত্তর-আংশিক দায়ী। বাকিটা রাষ্ট্রীয় পলিসি।

৫. কেন ডিপোগুলোতে বিস্ফোরণ হচ্ছে ? এর জন্য কারা দায়ী ?

পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্হার কারণে ডিপোগুলোতে বিস্ফোরণ হচ্ছে ।অবশ্যই প্রধানত মালিকপক্ষ এরপর তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।

৬. পাহাড় কাটা , জমির টপ সয়েল কাটা , সমুদ্র থেকে বালী উত্তোলন এসব কারা করছে বলে মনে হয় ? এতে আমাদের কি ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে করেন ?

উত্তর-আপনারা সাংবাদিকেরা ভালো জানেন।তবে জনগণের আঙুল ক্ষমতাসীনদের প্রতি।সীতাকুণ্ডে চরম পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে ।

৭. ভূমি ধস কেন হচ্ছে ?

উত্তর-জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে ।

৮. ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা কেন ? উত্তোরনের পথ কি ?

উত্তর-কলকারখানার গভীর নলকূপ বন্ধ করতে হবে ।পানির বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে।

৯. কৃষি উৎপাদনের অব্যবস্থাপনা জন্য কাকে দায়ী করেন ?

উত্তর-কৃষি জমিইতো দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্রকৃত কৃষকদের সহযোগিতা এবং প্রণোদনা দিতে হবে তাহলে সীতাকুণ্ড আবার সবজির ভান্ডারে পরিনত হবে ।

১০. পরিবেশ-প্রকৃতি দূষণ সম্পর্কে আপনার কি ধারণা ?

উত্তর- পরিবেশ-প্রকৃতি দূষণ মাত্রারিক্ত। একসময় সীতাকুণ্ডবাসী হয়তো উদ্বাস্তু হয়ে যাবে।

১১. ভূমিকম্পের ঝুঁকি কতটুকু ?

উত্তর-চট্টগ্রামতো এমনিতেই ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে আছে ।

১২. এসব থেকে উত্তোরনের পথ কি ?

ব্যাপক বনায়ন আর পরিবেশ বিপর্যয় হতে সীতাকুণ্ডকে রক্ষা করতে হবে ।

পরিবেশ নিয়ে কাজ করছেন ইঞ্জিনিয়ার কামরুদ্দৌজা । তিনি  বলেন, পুরো উপজেলাই এখন মরণফাঁদ। উপজেলায় এলপি গ্যাস প্লান্ট, শিপব্রেকিং ইয়ার্ড, সিমেন্ট ও স্টিল ফ্যাক্টরি, পাটকল ও কন্টেইনার ডিপোগুলো কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়াই জমজমাট ব্যবসা করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, প্রভাবশালীরা অপরিকল্পিতভাবে শুধু ব্যবসা গড়ে তোলেনি, গাছ কেটে সরকারি জায়গা দখল এবং বঙ্গোপসাগর থেকে অবৈধভাবে মাটি উত্তোলনের মাধ্যমে তারা গ্রামের কৃষিজমি নষ্ট করে গড়ে তুলেছে এসব শিল্প।

তিনি আরো বলেন, গ্যাস ফিল্ডগুলোয় অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম আছে কিনা তা জানা নেই। তবে এখানে গ্যাসের আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। এখন ফায়ার সার্ভিসের দুটি ফায়ার স্টেশন নির্মাণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। যাতে কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক আগুন নির্বাপণ করা হয়।

উল্লেখ্য যে, পাঁচ লাখ জনসংখ্যার ২৭৩ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার এলাকার এ উপজেলায় মোট ১২৬টি শিপব্রেকিং ইয়ার্ড, প্রায় দুই ডজন এলপি গ্যাস প্লান্ট, তিনটি কন্টেইনার ডিপো এবং ১৫৫টি অন্যান্য শিল্প রয়েছে ছোট ও বড়। এসব শিল্পের বেশিরভাগই আবাসিক এলাকায় অবস্থিত। উপজেলার মাত্র দুটি গ্রামেই ১২টির মতো এলপি গ্যাস প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। ফলে গ্রামবাসী তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। গত ছয় বছরে সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা শিল্পে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৪৫ জন নিহত হয়েছে।

সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে সারা পৃথিবীই এখন বাস্তু সংকটে । সীতাকুণ্ডে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে তাছাড়া অনেক শীপইয়ার্ড বন্ধ হওয়ার উপক্রম ।।ফলে অধিকাংশ শ্রমিক / কর্মচারী তাদের পরিবার নিয়ে এখন বাস্তু সংকটের মুখোমুখি ।

তিনি বলেন, উপজেলার ভাগ্যাহত মানুষগুলো বেকারত্ব, সেচসঙ্কট, জলাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। অনিয়ন্ত্রিত পানি উত্তোলনে পানির স্তর নেমে গেছে অনেক নিচে। তাছাড়া উপকূলীয় উপজেলা সীতাকুণ্ড। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার বৃদ্ধির কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার যে বেষ্টনী উপকূলের ম্যানগ্রোভ বন সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লবণাক্ততা ও ভাঙনের কারণে সীতাকুণ্ডজুড়ে শত শত একর ম্যানগ্রোভ বন হারিয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার সীতাকুণ্ড এলাকায় আট হাজার একর ম্যানগ্রোভ বন নিয়ে ইকোনমিক জোন করতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে বনবিভাগের কাছে প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে।

মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, পানির বিকল্প উৎস সন্ধানের জন্য আমরা সীতাকুণ্ডের ছোটদরগারহাট সেচ প্রকল্প বা পাহাড়ি ঝরনা ও ছড়াতে বাঁধ দিয়ে অথবা পাহাড়ে বাঁধ দিয়ে বর্ষাকালে রিজার্ভারে পানি সংরক্ষণ করে তা জনগণ ও শিল্প-কারখানায় সরবরাহ কিভাবে করা যায় সে চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং এ বিষয়ে একটি প্রকল্প পক্রিয়াধীন আছে । তাছাড়া বাস্তু সংকট থেকে উত্তোরনের জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান তিনি ।

লেখক. সম্পাদক ও প্রকাশক- পোস্টকার্ডবিডি.কম , সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি - দৈনিক সময়ের আলো ।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;