চট্টগ্রাম নগরীতে গ্রাম-বাংলার সেই শীত পিঠার স্বাদ

চট্টগ্রাম নগরীতে গ্রাম-বাংলার সেই শীত পিঠার স্বাদ
চট্টগ্রাম নগরীতে গ্রাম-বাংলার সেই শীত পিঠার স্বাদ

মরিয়ম জাহান মুন্নী ।।

পিঠা আর শীত যেন একে অন্যের পরিপূরক। শীত এলেই মনে পড়ে নানা রকম পিঠা-পুলির কথা। আগে গ্রাম-বাংলায় শীতের শুরুতে নবান্নে আমন ধান ঘরে তোলেই শুরু হত নানারকম পিঠার উৎসব। সেই পিঠাগুলোর মধ্যে ভাপা পিঠা, চিতল, পাটিশাপটা, পায়েস, পুলি, পাক্কন, নারকেল পুরি, খেজুরের রস, ছই পাক্কন, নারকেলের মোয়া, চালের হালুয়া ও নারকেল পুলি পিঠা ছিল উল্লেখযোগ্য। কনকনে শীতের সকালে প্রতিদিন মা-দাদীরা এসব পিঠা তৈরি করতো। আর খেজুরের রসে ভিজিয়ে খেত সেই পিঠা। কিন্তু কর্মব্যস্ত শহরের মানুষ প্রায় ভুলে গেছে

গ্রাম-বাংলার সেই পিঠার স্বাদ। এমনি ব্যস্ত শহরে কর্মব্যস্ত মানুষদের সেই পিঠার স্বাদ মনে করিয়ে দিচ্ছে বেল্লা বেগমের মত কিছু পিঠা বিক্রেতা। যারা শীতের এ সময় নানা ধরনের পিঠা তৈরি করে বিক্রি করেন। তাদের কারণে সেই পিঠা গ্রাম ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে শহরের অলিগলিতেও। বেশ কিছু দিন ধরে শীতের আগমনের সাথে সাথে নগরীর প্রায় সবগুলো মোড়ে দেখা যায় সেই ভাসমান পিঠা দোকানিদের। যারা সকাল-বিকাল দুই বেলাই বসে পিঠা বিক্রি করে। আর লাইন ধরে সেই পিঠা খাচ্ছে পিঠা প্রেমীরা। তেমনি কিছু সিজনাল পিঠা বিক্রেতা পাঠানটুলির ৬০ বছরের বেল্লা বেগম, দুই নম্বর গেট এলাকার আমির হোসেন, চকবাজারের মতিন মিয়া ও রাহাত্তারপুল এলাকার ১৫ বছরের ছেলে মো. সাজু।

কথা হয় বেল্লা বেগমের সাথে, পাঁচ সন্তানের মা তিনি। তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলেকেও করিয়েছেন বিয়ে। কিন্তু সবাই যে যার মত পরিবার নিয়ে আলাদা। কেউই রাখে না তার খবর। তাই স্বামীহারা বেল্লা বেগমকে নিজের পেট নিজেকেই চালাতে হয়। দীর্ঘ সাত বছরেরও বেশি সময় এভাবেই চলছে তার জীবন। কিন্তু পিঠা বিক্রির ব্যবসাতো একটি সিজনাল ব্যবসা। তাই শীতের সময় শেষে বৌ বাজারে করেন সবজির ব্যবসা। এভাবেই চলে যাচ্ছে তার দিন। প্রতিদিনের মত গতকাল সন্ধ্যায়ও নগরীর পাঠানটুলি সোলতান কলোনি বৌ বাজারে তিনি বিক্রি করছেন পিঠা। তার হাতের পিঠা এলাকার মানুষ ও পথচারীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। তাই পিঠা খেতে ভিড় করে এলাকার মানুষ ও নানা বয়সের পথচারীরা। দেখা যায় কেউ দাঁড়িয়ে মরিচের চাটনি দিয়ে কেউ বা খেজুরের রস ও রসের মিঠাই দিয়ে খাচ্ছে পিঠা। কেউ কেউ আবার সেই পিঠা নিয়ে যাচ্ছে পরিবারের জন্য। তিনি শুধু ভাপা পিঠাই নয়, তৈরি করেন মাটির খোলায় বসানো পিঠা ও চিতল পিঠা। কথা বলে জানা যায়, মাঝেমধ্যে তেলের পিঠাও তৈরি করেন তিনি। তার নিজ ও শ^শুরবাড়ি কুমিল্লা জেলার তিতাস উপজেলায়। ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামের পাঠানটুলি সোলতান কলোনিতে থাকেন তিনি। স্বামীর হাত ধরেই এসেছেন চট্টগ্রামে। নানা উত্থান-পতনের মধ্যেদিয়েই কেটেছে জীবন। এরমধ্যে স্বামীকে হারিয়েছেন, ছেলে-মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। যে যার মত সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তাই ছেলেদের অভাবে সংসারে থেকে তাদের আর কষ্ট দিতে চাননি তিনি। একাই শুরু করেন জীবন-যুদ্ধ। প্রতিবছর শীতের এসময় এখানেই তিনি পিঠা বিক্রি করেন। খেজুরের গুড় ও চালের গুড়ি দিয়ে তৈরি ভাপা পিঠা। যা সবাই খেয়ে খুব প্রশংসা করে। একটি বসা চিতল পিঠা ও আরেকটি ডিম চিতল। এটিও মানুষ খুব পছন্দ করে।

১৫ বছরের সাজু জানায়, মা আর দুই বোনের সংসার। মা অসুস্থ, তাই সেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী সে। শীতের সময় মা থেকে শেখা পিঠা তৈরি করে বিক্রি করে। আর অন্যসময় সিটি বাসের হেল্পারি করে।

আমির হোসেন ও মতিন মিয়াও সিজনাল পিঠা বিক্রেতা। শীতের শেষে একজন রিক্শা চালায় আরেকজন রাজমিস্ত্রীর কাজ করে। তারা জানান, যেকোনো একটি পিঠা পাঁচ টাকা। প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২শ’ টাকার মত খরচ হয় কেরোসিন তেল, চালের গুড়ি, ডিম, খেজুরের রস, খেজুর মিঠাই ও মরিচ চাটনি বানানোর উপকরণের জন্য। সকাল বিকাল দুইবেলাই বিক্রি করেন। সকাল সাতটা থেকে নয়-দশটা পর্যন্ত, বিকেল চারটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। খরচ বাদে প্রতিদিন ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকার মত আয় হয়। সেই টাকায় চলে সংসার।

পাঠানটুলি বেল্লা বেগমের তৈরি পিঠা দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন আসমা, শাহাদাত ও আবুল কাশেম। তারা বলেন, খালার হাতের পিঠা খুব মজা। কাশেম একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। প্রতিদিন এপথ দিয়ে যাতায়াত করেন। তাই যাতায়াতের সময় খালার হাতের বানানো পিঠার স্বাদ গ্রহণ করেন। তিনি আরো বলেন, গ্রামে গেলে এখনো মায়ের হাতের বানানো চিতল পিঠা খাই। কিন্তু এই শীতে এখনো খেতে পারিনি। চাকরি আর আমার গ্রাম অনেক দূরে হওয়ায় চাইলেই যেতে পারিনা। আসমা, শাহাদাত বলেন, এখানে পাশেই একটি কোচিং সেন্টারে আমরা পড়ি। ক্লাস শেষে বাসায় ফেরার পথে খালার হাতের পিঠা খেয়ে যাই। আসমা বলেন, আমার মা এমন মজার পিঠা বানাতে পারেনা। তাই আমি কিনেই খাই। পিঠাগুলো আমার খুব পছন্দের। ভিড় ছিল সাজু, আমির হোসেন ও মতিন মিয়ার পিঠার দোকানের সামনেও।