'বাকরখানি' অনন্য এক প্রেমের নিদর্শন

'বাকরখানি' অনন্য এক প্রেমের নিদর্শন
বাকরখানি অনন্য এক প্রেমের নিদর্শন

মুজাহিদ বিল্লাহ ।।

পুরান ঢাকার মানুষের সকাল অথবা বিকালের নাস্তায় সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার বাকরখানি। বাহারি খাবারের জন্য বিখ্যাত পুরান ঢাকা। সকালের নাস্তায় বাকরখানির সাথে চা হলে জমে যায় আড্ডা। বিভিন্ন নাস্তার মধ্যে এখনো বাকরখানি সর্বাধিক জনপ্রিয়।

ছোট আকৃতির রুটির মতো দেখতে খাঁজকাটা এক ধরনের গোল খাবারের নাম বাকরখানি। ময়দা দিয়ে তৈরি করা হয়। ময়দার খামির থেকে রুটি বানিয়ে তা মচমচে বা খাস্তা করে মাটির চুলোয় ভেঁজে বাকরখানি তৈরি করা হয়।

জনশ্রুতি অনুসারে, জমিদার আগা বাকের তথা আগা বাকের খাঁর নামানুসারে এই রুটির নামকরণ করা হয়েছে। ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর দত্তক ছেলে আগা বাকের। প্রখর মেধার অধিকারী আগা বাকের যুদ্ধবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। রাজধানী মুর্শিদাবাদের নর্তকী খনি বেগম এবং আগা বাকের পরস্পরের প্রেমে পড়েন। কিন্ত উজিরপুত্র নগর কোতোয়াল জয়নাল খান ছিল পথের কাঁটা। সে খনি বেগমকে প্রেম নিবেদন করলে তিনি জয়নাল খানকে প্রত্যাখান করেন।

প্রত্যাখ্যাত হয়ে জয়নাল খনি বেগমের ক্ষতির চেষ্টা করে এবং খবর পেয়ে বাকের সেখানে যান ও তলোয়ারবাজিতে জয়নালকে হারিয়ে দেন। অন্যদিকে জয়নালের দুই বন্ধু উজিরকে মিথ্যা খবর দেয় যে, বাকের জয়নালকে হত্যা করে লাশ গুম করেছে। উজির ছেলের হত্যার বিচার চায়। নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ পুত্র বাকেরকে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। অবশেষে বাকেরের হাতে মারা যায় বাঘ।

এদিকে জয়নালের মৃত্যুর মিথ্যা খবর ফাঁস হয়ে যায় ও সে জোর করে খনি বেগমকে ধরে নিয়ে যায় দক্ষিণবঙ্গে। উদ্ধার করতে যান বাকের ও খনি বেগমকে। পিছু নেন উজির জাহান্দার খান। ছেলে জয়নাল খান বাকেরকে হত্যার চেষ্টা করলে উজির নিজের ছেলেকে হত্যা করেন তলোয়ারের আঘাতে। এই অবস্থাতে জয়নাল খনি বেগমকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করে।

বাকেরগঞ্জে সমাধিস্থ করা হয় খনি বেগমকে। আর বাকের সবকিছু ত্যাগ করে রয়ে গেলেন প্রিয়তমার সমাধির কাছে– দক্ষিণবঙ্গে। বাকের খাঁর নামানুসারেই বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ (পটুয়াখালি-বরিশাল) অঞ্চলের নাম হয় বাকেরগঞ্জ।

অপর মত অনুযায়ী, মির্জা আগা বাকের ঢাকায় বাকরখানি রুটি প্রচলন করেন। তিনি বৃহত্তর বরিশালের জায়গীরদার ছিলেন। তার প্রেয়সী ছিল আরামবাগের নর্তকী খনি বেগম। তাদের মধ্যে গভীর প্রেম ছিল বলে কথিত আছে। পরবর্তীতে আগা বাকের ২য় মুর্শিদকুলী খাঁর কন্যাকে বিয়ে করেন।

কিন্তু খনি বেগমের স্মৃতি তিনি ভুলে যাননি। তার আবিস্কৃত এবং প্রিয় খাদ্য বিশেষভাবে তৈরি রুটির নাম তার প্রেমকাহিনীর ওপর ভিত্তি করেই নামকরণ করা হয়েছিল বাকের-খনি রুটি। পরবর্তীতে এই নাম কিছুটা অপভ্রংশ হয়ে বাকরখানি নাম ধারণ করে।

উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে প্রকাশিত হাকিম হাবিবুর রহমান তার 'Dhaka Pachash Barash Pahley' গ্রন্থে ঢাকার বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের তৈরি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি প্রধানত গও জোবান, শুকি এবং নিমশুকি তিন ধরনের বাখরখানির কথা বলেন।

জনশ্রুতি মেনে নিলে ধরে নিতে হয়, বাখরখানির সৃষ্টি আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে। অনেকে আবার ধারণা করেন, সিলেট জেলায় সর্বপ্রথম বাকরখানি তৈরী হয় এবং অনেকে মনে করেন এটি চট্রগ্রাম অঞ্চলের খাবার।

পুরান ঢাকার নারিন্দা, লোহারপুল, গেন্ডারিয়া, নাজিরাবাজারসহ বিভিন্ন অলি-গলিতে এই খাবার পাওয়া যায়। পুরান ঢাকা ছাড়া অন্য কোথাও এখন বাকরখানির দোকান সচরাচর দেখা পাওয়া যায় না।

আনিস নামের একজন বাকরখানি বিক্রেতা বলেন, 'আগের চেয়ে ব্যাবসা অনেকটা ভালো। বাবা-দাদারা করছে, আমরাও করতাছি। বিভিন্ন জায়গা হতে মানুষ কিনতে আসে। সব জিনিসিপত্রের দাম বাড়ে, এই জন্য আগে ৩ টাকা আছিল এখন ৫ টাকা।'

বাকরখানি ক্রেতা ফাহিম জানান, বাকরখানি খেতে ভালোই লাগে। তেল-ফ্যাটের সমস্যা নেই।সকালের নাস্তায় বেশ উপযোগী ও স্বাস্থ্যকর।

বাকরখানির দোকানগুলায় দুই ধরনের বাকরখানি পাওয়া যায়। একটি মিষ্টি ধরনের, অপরটি মিষ্টি ছাড়া। প্রতি পিসের দাম ৫-১০ টাকা হয় এবং প্রতি কেজি ১২০-১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়।