বন্দরনগরীর বাতাসে বাড়ছে বিষ

বন্দরনগরীর বাতাসে বাড়ছে বিষ

তুষার দেব ।।

বন্দরনগরীর বাতাসে বিষের উপস্থিতি দিন দিন বাড়ছে।  যদিও ভারতের দিল্লি কিংবা রাজধানী ঢাকার পর্যায়ে এখনো পৌঁছেনি । তবে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে বায়ু দূষণের হার। সারা বছর তো বটেই, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুম বা শীতকাল শুরু হতে না হতেই দূষণের মাত্রা চরম পর্যায়ে উপনীত হচ্ছে। সর্বশেষ তিন বছরে নগরীতে দূষণ বেড়েছে প্রায় দেড়শ’ শতাংশ। বর্তমানে বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার (সাসপেন্ডেন্ট পার্টিক্যুলেট মেটার বা এসপিএম) পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে চারগুণ বেশি।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, পরিস্থিতি যে হারে নাজুক হয়ে উঠছে তাতে বন্দরনগরীও বিশ্বের শীর্ষ দূষিত নগরীর তালিকায় জায়গা করে নিতে পারে সহসাই। বসবাসের উপযোগিতা হারাবে চট্টগ্রাম শহর। অবকাঠামোগত উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিরামহীনভাবে সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ধুলোবালি, রাজপথে চলাচলকারী ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত কালো ধোঁয়া, শিল্প-কারখানা ও শহরতলীতে স্থাপিত ইটভাটা থেকে অবিরাম নির্গত বিষাক্ত নানা উপাদানমিশ্রিত ধোঁয়াই বাতাসে বিষ ছড়ানোর অন্যতম উৎস হিসেবে কাজ করছে। এক্ষেত্রে, ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সেবাসংস্থা পর্যন্ত কেউই পরিবেশ আইন যথাযথভাবে প্রতিপালনের তোয়াক্কা করছে না। পরিবেশ সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থা নিজেদের কাজে উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছে। তেমনি আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান না হওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের রেকর্ডকৃত পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ধুলোর পরিমাণ দেড়শ’ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত সহনীয় মাত্রার হলেও নগরীর বাতাসে বিগত ২০১৭ সালে তা ছিল গড়ে দুইশ’ ৩২ মাইক্রোগ্রাম। পরের বছর ২০১৮ সালে তা বেড়ে দুইশ’ ৭৩ মাইক্রোগ্রাম আর চলতিবছর আরও বেড়ে এরইমধ্যে তা ছুঁয়েছে তিনশ’ ৩০ মাইক্রোগ্রামের ঘর। দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য শহরজুড়ে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি। এছাড়া, নগরের রাজপথে চলাচলকারী ফিটনেসবিহীন গাড়ির অনিয়ন্ত্রিত কালো ধোঁয়া, কলকারখানা এবং শহরতলীতে স্থাপন করা ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়াকেই এ দূষণের মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, ধুলোবালি আর ধোঁয়া বাতাসে একটি স্তর পর্যন্ত তৈরি করছে কৃত্রিম কুয়াশা-বেল্ট। বিশেষ করে, রি-রোলিং মিল, রিফাইনারী ও সিমেন্ট কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া আর ক্লিংকারের ধুলোয় ঢাকছে আকাশের নিচের স্তর। বিভিন্ন ভারী শিল্প এলাকার মত নগরীর দক্ষিণে পতেঙ্গা থেকে ও সমুদ্র তীরবর্তী লালদিয়া হয়ে মইজ্জ্যারটেক পর্যন্ত বাতাসের উপরিস্তরে কৃত্রিম কুয়াশা-বেল্ট পরিলক্ষিত হচ্ছে। ওই এলাকাটি বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের অন্যতম রুট হওয়ায় বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে বৈমানিকদের।
পরিবেশ অধিদপ্তর একটি প্রকল্পের আওতায় প্রতিদিন নগরীর বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে। তাদের ওয়েবসাইটে উল্লেখিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি মাসে গত পয়লা নভেম্বর থেকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত নগরীর বায়ুর মান-মাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে শুরু প্রথম সপ্তাহে বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার উপস্থিতি ছিল যথাক্রমে ১০৮, ১২২, ১২২, ১৪৭, ১৪৬, ২৫৬ ও ১০৬ এসপিএম। মাঝে কিছুদিন তা নিচে নেমে এলেও শেষদিকে ফের শতকের ঘর অতিক্রম করে। সর্বশেষ আটদিন বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার উপস্থিতি ছিল যথাক্রমে ১২১, ১৯২, ১৯৩, ১২৩, ১১১, ৮৭, ১০৩ এবং ১১২ এসপিএম। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআই-এ এসপিএম-এর মাত্রা ১৫১ -এর উপরে উঠলে তা সহনশীলতার বাইরে এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একিউআই ১৫০ থেকে ২০০ এসপিএম হলে ‘অস্বাস্থ্যকর’ আর ২০১ থেকে ৩০০ এসপিএম হলে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০১ থেকে ৫০০ এসপিএম হলে বাতাস ‘চরম পর্যায়ের অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বায়ু দূষণের আরেক উৎস শিল্প-কারখানা। এক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটারে প্রলম্বিত বস্তুকণা দুইশ’ মাইক্রোগ্রাম থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে নগরে মিলছে আটশ’ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত। পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানের মুখে একবোরেই হাতে গোণা কয়েকটি রি-রোলিং মিলে দূষণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হলেও শত শত কারখানা বাতাসে ভয়ঙ্কর বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বাতাস পরীক্ষা করে দেখা গেছে, যানবাহন ও কলকারখানার কালো ধোঁয়ার সঙ্গে নির্গত বস্তুকণা, সালফার ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, সীসাসহ অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান বাতাসে বিপজ্জনক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে। এরপর বাতাসে বিষ ছড়াতে অন্যতম ভূমিকা ইটভাটাগুলোর। বিশেষ করে শহরতলীর ইটভাটাগুলো থেকে নিগর্ত কার্বন সরাসরি নগরীর বাতাসে এসে মিশছে। অধিদপ্তরের হিসেবে এককভাবে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম জেলাতেই রয়েছে চারশ’ ১৮টি ইটভাটা। এর মধ্যে একশ’ ৪৬টিরই পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। আর দুইশ’ ৭১টি ইটভাটা এখন পর্যন্ত পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণ করেনি।
বিশ্বের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের সর্বশেষ গত ২১ নভেম্বর তাদের পর্যবেক্ষণ-প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় শীর্ষ স্থানটি ছয়টি শহরের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। তন্মধ্যে কোনও দিন বা সময়ে ঢাকা, আবার কখনওবা দিল্লি দখলে যাচ্ছে শীর্ষস্থান। একইভাবে ভারতের কলকাতা এবং পাকিস্তানের করাচি ও লাহোরও পিছিয়ে নেই। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে এসব শহরের নাম ওঠানামা করছে। শীর্ষ ১০ দূষিত বায়ুর শহরের তালিকা করলে চীনের বেইজিং, মঙ্গোলিয়ার উলানবাটর, উজবেকিস্তানের তাসখন্দ ও ভিয়েতনামের হ্যানয় শহরের নাম আসবে। এছাড়া, সংস্থাটির বৈশ্বিক বায়ুদূষণের ঝুঁকিবিষয়ক ‘দ্য স্টেট অব গেøাবাল এয়ার-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে, তার একটি বাংলাদেশ। আর বায়ুদূষণজনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পঞ্চম। এ কারণে ২০১৭ সালে দেশে মারা গেছে এক লাখ ২৩ হাজার মানুষ। বিশ্বে বায়ুদূষণের কারণে হৃদরোগ, শ্বাসকষ্টজনিত জটিল সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ ও ক্যান্সারের মত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষত শিশু ও গর্ভবতী নারীরা বায়ুদূষণের সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন।