সীতাকুণ্ডের গ্রামে গ্রামে অপরিকল্পিত গ্যাস প্লান্ট,স্থানীয়দের ঘুম ভাঙ্গে আতঙ্কে 

সীতাকুণ্ডের গ্রামে গ্রামে অপরিকল্পিত গ্যাস প্লান্ট,স্থানীয়দের ঘুম ভাঙ্গে আতঙ্কে 
সীতাকুণ্ডের গ্রামে গ্রামে অপরিকল্পিত গ্যাস প্লান্ট,স্থানীয়দের ঘুম ভাঙ্গে আতঙ্কে 

এসএম মিন্টু ও মেজবাহ উদ্দিন খালেদ ।।

সীতাকুণ্ডের উপজেলার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের মান্দারিটোলা গ্রামের শাহ আলম (৫০)। পেশায় চায়ের দোকানদার। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, তার পরিবারসহ প্রতিদিনই এ এলাকার মানুষের ঘুম ভাঙে আতঙ্কের মধ্যে। সম্প্রতি বিএম কন্টেইনারে অগ্নিকাণ্ড ও ভয়াবহ বিস্ফোরণে ৫১ জনের মৃত্যুর পর নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে বঙ্গোপসাগর তীরে গড়ে ওঠা অপরিকল্পিত ১২টি গ্যাস প্লান্ট নিয়ে। এ ছাড়াও উপজেলায় এলপিজি গ্যাস প্লান্ট, শিপব্রেকিং ইয়ার্ড, সিমেন্ট ও স্টিল ফ্যাক্টরি, পাটকল ও কন্টেইনার ডিপোগুলো কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়াই এসব গড়ে উঠেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের শুধু মান্দারিটোলা ও নাদালিয়া গ্রামেই অন্তত ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। সবাই এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। যেকোনো সময় বড় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলে পুরো গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড অলিনগর গ্রামে সাগরপাড়ে গড়ে তোলা বিএম এনার্জি গ্যাস প্লান্টসহ অন্তত ১২টি কোম্পানির গ্যাসফিল্ড। তবে সাগরঘেঁষা হলেও সেখানে রয়েছে বেড়িবাঁধ। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা গ্যাস প্লান্টগুলোতে সরাসরি জাহাজ থেকে লোহার পাইপের মাধ্যমে বিশাল সিলিন্ডারে ভরা হচ্ছে গ্যাস। ওই সিলিন্ডার একেকটিতে প্রায় ৪০ হাজার লিটার অপরিশোধিত গ্যাস রাখা হয়। সেখান থেকে ছোট ছোট সিল্ডিন্ডারে ভরে ট্রাক ও নৌপথে অরক্ষিতভাবে গ্যাস পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে ডিলারদের কাছে।

নদীপথে গ্যাস পরিবহন করা ট্রলারের এক মাঝি নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে বলেন, প্রতিদিন প্রায় ১২০০ এলপিজি গ্যাসভর্তি সিলিন্ডার সন্দীপ ও হাতিয়ায় পৌঁছে দেন তারা। সেখান থেকে সেগুলো নোয়াখালী, চাঁদপুর ও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলায় চলে যায়। তিনি আরও বলেন, এখানে ১২টি গ্যাস প্লান্ট রয়েছে। এর মধ্যে বিএম এনার্জি (বিডি) গ্যাস প্লান্ট, ওমেরা গ্যাস প্লান্ট, ইউনি গ্যাস, ইউরো গ্যাস এলপিজি ও সাগরপাড়ে বনের জায়গায় গড়ে ওঠা জেএমআই ইন্ডাস্ট্রিজ গ্যাস লিমিটেড অন্যতম। এ ট্রলার মাঝি বলেন, এখানে আগুনের অস্তিত পেলেই বড় বিস্ফোরণ ঘটবে। আর বিস্ফোরণ হলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। আমরা গরিব মানুষ, পেটের দায়ে বোমার মধ্যেই বসবাস করি। জানি বিস্ফোরণ হলে মৃত্যু নিশ্চিত, তবুও পেটের দায়ে এসব কাজ করতে হচ্ছে।

সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, সাগরপাড়ে বনের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে জেএমআই ইন্ডাস্ট্রিজ গ্যাস লিমিটিডে। ওই কারখানায় প্রবেশ করতে চাইলে নিরাপত্তকর্মী বলেন, অফিসাররা কেউ নেই। কর্মকর্তাদের মোবাইল নম্বর চাইলে দিতে অপারগতা প্রকাশ করে নিরাপত্তা কর্মীরা।

বিএম এলপি গ্যাস বা বিএম এনার্জি (বিডি) লিমিটেড কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে গেটে বিশাল আকারের একটি সাইনবোর্ড লাগানো। তাতে লেখা রয়েছে, ‘লাইসেন্সধারীর নাম মোস্তাফিজুর রহমান। বিস্ফোরক লাইসেন্স নম্বর ১৮০-২ (ঙ)-০০০৪।’

ফায়ার সার্ভিস ও বিস্ফোরক অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হলে তারা সময়ের আলোকে বলেন, এখানে সবাই নিয়ম-কানুন মেনেই এলপি গ্যাস সিলিন্ডারজাত করছে। তবে ওই প্রতিষ্ঠানের একজন শ্রমিক নাম প্রকাশ না করে বলেন, এখানে সঠিক নিয়মে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরা হয় না। যেকোনো সময় বড় বিপদ ঘটতে পারে। যদি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে তাহলে এ গ্রামের সবাই মারা যাবে। এখানকার একেকটি গ্যাস ফিল্ড যেন বোমা তৈরির কারখানা। পুরোটাই যেন মরণফাঁদ। তিনি আরও বলেন, একসময় এ গ্রামে শুধু মাছ চাষ ও বিভিন্ন শস্য উৎপাদন হতো। গ্রামের সবাই চাষাবাদ করে স্বাবলম্বী ছিলেন। পরে কৃষিজমি নষ্ট করে প্রভাবশালীরা গড়ে তুলেছে শিল্প। তারা জমিগুলো জালিয়াতি করে কাগজপত্র বানিয়ে কারখানার জন্য দখল করে নেয়।

সীতাকুণ্ড হেলথ অ্যান্ড এডুকেশন ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সময়ের আলোকে বলেন, পুরো উপজেলাই এখন মরণফাঁদ। উপজেলায় এলপি গ্যাস প্লান্ট, শিপব্রেকিং ইয়ার্ড, সিমেন্ট ও স্টিল ফ্যাক্টরি, পাটকল ও কন্টেইনার ডিপোগুলো কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়াই জমজমাট ব্যবসা করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, প্রভাবশালীরা অপরিকল্পিতভাবে শুধু ব্যবসা গড়ে তোলেনি, গাছ কেটে সরকারি জায়গা দখল এবং বঙ্গোপসাগর থেকে অবৈধভাবে মাটি উত্তোলনের মাধ্যমে তারা গ্রামের কৃষিজমি নষ্ট করে গড়ে তুলেছে এসব শিল্প।

গিয়াস উদ্দিন বলেন, গ্যাস ফিল্ডগুলোয় অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম আছে কিনা তা জানা নেই। তবে এখানে গ্যাসের আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। এখন ফায়ার সার্ভিসের দুটি ফায়ার স্টেশন নির্মাণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। যাতে কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক আগুন নির্বাপণ করা হয়।

হেলথ অ্যান্ড এডুকেশন ট্রাস্টের এ কর্মকর্তা জানান, পাঁচ লাখ জনসংখ্যার ২৭৩ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার এলাকার এ উপজেলায় মোট ১২৬টি শিপব্রেকিং ইয়ার্ড, প্রায় দুই ডজন এলপি গ্যাস প্লান্ট, তিনটি কন্টেইনার ডিপো এবং ১৫৫টি অন্যান্য শিল্প রয়েছে ছোট ও বড়। এসব শিল্পের বেশিরভাগই আবাসিক এলাকায় অবস্থিত। উপজেলার মাত্র দুটি গ্রামেই ১২টির মতো এলপি গ্যাস প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। ফলে গ্রামবাসী তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। গত ছয় বছরে সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা শিল্পে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৩৫ জন নিহত হয়েছে।

সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন বলেন, বড় ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটলে এসব গ্যাস কারখানায় আগুন লাগার কোনো আশঙ্কা নেই। তবে এ শিল্পগুলোয় পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা আছে কিনা তা আমরা বলতে পারি না, কারণ শিল্প স্থাপনের জন্য প্রায় ১৯টি সরকারি সংস্থার অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। তাই আমরা সরাসরি সেগুলো পর্যবেক্ষণ করতে পারি না।

এত কাছাকাছি এলপি গ্যাস প্লান্ট নির্মাণ ঝুঁকিপূর্ণ কিনা জানতে চাইলে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আশরাফ উদ্দিন বলেন, শিল্প কারখানা স্থাপনে দূরত্বের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু আইন অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা যাবে না। তিনি আরও বলেন, এসব শিল্পে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার এখনই সময়। আমরা সেগুলো ভালোভাবে যাচাই করে দেখছি। -সময়ের আলো

খালেদ / পোস্টকার্ড ;