সমুদ্র সৈকতে সাগরলতা সংরক্ষণের মাধ্যমে কক্সবাজার বালিয়াড়ি তৈরির উদ্যোগ
কক্সবাজার প্রতিনিধি।।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে সাগরলতার বনায়নের মাধ্যমে নতুন বালিয়াড়ি তৈরি ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। প্রাথমিকভাবে শহরতলীর দরিয়ানগর থেকে দক্ষিণে এক কিলোমিটার পর্যন্ত সৈকত এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে সাগরলতার বনায়ন করা হবে। গতকাল শুক্রবার বিকালে দরিয়ানগরে প্রস্তাবিত সংরক্ষিত সৈকত পরিদর্শন শেষে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক এ তথ্য জানান।
জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, সাগরলতা যে বালিয়াড়ি সৃষ্টি করে- এ ঘটনা আমরা স্বচক্ষে দেখেছি এবং বিস্মিত হয়েছি। প্রকৃতিকে হস্তক্ষেপ না করে নির্বিঘ্নে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেয়া হলে তারা যে কত বড় সেবা পরিবেশে দিতে পারে, তার প্রমাণ ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে।
তিনি জানান, প্রাথমিকভাবে শহরতলীর দরিয়ানগর থেকে দক্ষিণে এক কিলোমিটার পর্যন্ত সৈকত এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে সাগরলতার বনায়ন করা হবে। পাশাপাশি বালিয়াড়ির পেছনের অংশে সৃজন করা হবে নারিকেল বাগানও। এরআগে গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টায় দরিয়ানগরে প্রস্তাবিত সংরক্ষিত সৈকত এলাকা পরিদর্শন করেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক। এসময় কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আশরাফুল আফসার, পর্যটন সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইমরান জাহিদ, সাগরলতা ও বালিয়াড়ি গবেষক সাংবাদিক আহমদ গিয়াস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। আহমদ গিয়াস তার রোপণ করা সাগরলতার বন কিভাবে বালিয়াড়ি তৈরি করেছে তা সরকারি প্রতিনিধিদের কাছে সরেজমিনে উপস্থপন করেন। জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন দরিয়ানগরের পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সৈকতেও সাগরলতা ও বালিয়াড়ি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান।
বাস্তুশাস্ত্র বা পরিবেশবিদ্যায় বালিয়াড়িকে সমুদ্র সৈকতের রক্ষাকবচ, আর সাগরলতাকে বালিয়াড়ি তৈরির কারিগর বলা হয়। সাগরে ঝড়-তুফান বা ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস উপকূলে ঠেকিয়ে রাখে বালিয়াড়ি। আর সমুদ্র সৈকতে মাটির ক্ষয়রোধ এবং শুকনো উড়ন্ত বালুরাশিকে আটকে বড় বড় বালির পাহাড় বা বালিয়াড়ি তৈরি করে সাগরলতা। কিন্তু পর্যটন শিল্পের কারণে দখল ও দূষণের শিকার হয়ে গত প্রায় ৩ দশকে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতের বড় বড় বালিয়াড়িগুলো প্রায়ই হারিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে সমুদ্র তীর ভাঙনের শিকার হয়ে হাজার হাজার একর ভূমি সাগরগর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। আর সেই বিধ্বস্ত প্রকৃতি আপনাআপনি পুনর্গঠিত হচ্ছে করোনা নিষেধাজ্ঞার নির্জনতার সুযোগে।
মাত্র এক দশক আগেও কক্সবাজার শহর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতজুড়ে গোলাপী-অতিবেগুণী রঙের ফুলেভরা সৈকতে এক অন্য রকমের সৌন্দর্যময় পরিবেশ ছিল। সেই পরিবেশের কথা ভেবে শহরের অনেক বাসিন্দা ও পর্যটক এখন কেবলই আক্ষেপ করেন। সেই হারিয়ে যাওয়া পরিবেশ ফের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
সৈকতের পরিবেশগত পুনরুদ্ধারে সাগরলতার মতো দ্রাক্ষালতার বনায়নের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ফ্লোরিডা এবং অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সৈকতের হ্যাস্টিং পয়েন্টসহ বিশ্বের বিভিন্ন সৈকতে বালিয়াড়ি সৃষ্টিতে সফল হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের দেখানো পথে সৈকতের মাটির ক্ষয়রোধ ও সংকটাপন্ন পরিবেশ পুনরুদ্ধারে বিশ্বের দেশে দেশে কাজে লাগানো হচ্ছে সাগরলতাকে। উন্নত বিশ্বের গবেষণালব্দ ফলাফলে সাগরলতার মত দ্রাক্ষালতা সৈকত অঞ্চলে পরিবেশগত পুনরুদ্ধার ও মাটির ক্ষয়রোধের জন্য একটি ভাল প্রজাতি বলে প্রমাণিত হয়েছে। সাগরলতা ন্যূনতম পুষ্টিসমৃদ্ধ বেলে মাটিতে বেড়ে ওঠতে পারে। তার পানির প্রয়োজনীয়তাও কম হয়। উচ্চ লবণাক্ত মাটিও তার জন্য সহনশীল। এর শিকড় মাটির ৩ ফুটের বেশি গভীরে যেতে পারে। এটি দ্রুতবর্ধনশীল একটি উদ্ভিদ। বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ না হলে লতাটি চারিদিকে বাড়তে থাকে এবং সর্বোচ্চ সামুদ্রিক জোয়ারের উপরের স্তরের বালিয়াড়িতে জাল বিস্তার করে মাটিকে আটকে রাখে। এরপর বায়ু প্রবাহের সাথে আসা বালি ধীরে ধীরে সেখানে জমা হয়ে মাটির উচ্চতা বৃদ্ধি করে। এতে সাগরলতার ও সৈকতের মাটির স্থিতিশীলতা তৈরি হয়।
সাগরলতাকে স্থানীয়ভাবে ডাউগ্গা লতা, ডাউঙ্গা লতা ও পিঁয়া লতা নামে পরিচিত। এর ইংরেজি নাম রেলরোড ভাইন, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় রেলপথ লতা। আসলেই রেলপথের মতোই যেন এর দৈর্ঘ্য। একটি সাগরলতা ১শ ফুটেরও বেশি লম্বা হতে পারে। এর বৈজ্ঞানিক নাম ওঢ়ড়সড়বধ ঢ়বং পধঢ়ৎধব.
স্থানীয়ভাবে এর ওষুধী ব্যবহারও রয়েছে। জেলিফিশ এর আঘাতে সৃষ্ট বিষক্রিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে জেলে সমাজ সাগরলতার রস ব্যবহার করে। এই ঐতিহ্যগত এথনো মেডিসিন জ্ঞান থেকে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্টিং রোগের প্রতিষেধক তৈরি করা হচ্ছে।