ভোটের আগে সচিবালয়ে তদবিরের চাপ, ডিও দিচ্ছেন মন্ত্রী-এমপিরা

ভোটের আগে সচিবালয়ে তদবিরের চাপ, ডিও দিচ্ছেন মন্ত্রী-এমপিরা
ভোটের আগে সচিবালয়ে তদবিরের চাপ, ডিও দিচ্ছেন মন্ত্রী-এমপিরা

ওয়াজেদ হীরা।।

নির্বাচনের আগে বছরে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে বেড়েছে তদবিরের চাপ। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক তদবিরের চাপে অনেকটা হিমশিম খাচ্ছেন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

প্রতিদিনই প্রচুর দর্শনার্থী নানা আবদার নিয়ে হাজির হন মন্ত্রী-সচিবসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছে। মন্ত্রী-এমপির আধা সরকারি পত্র (ডিও) নিয়েও কেউ কেউ আসছেন।

অনেক দফতরে এমপি, মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যানদের দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যায়। সরকারি চাকরিজীবীরা নিজেদের পদোন্নতি-বদলি নিয়েও করছেন দৌড়ঝাঁপ। সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনী বছর হওয়ায় আগের চেয়ে তদবির বেড়েছে।

গত কয়েকদিন সচিবালয়ে ঘুরে এবং খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সপ্তাহে এক দিন (সোমবার) দর্শনার্থী প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও বিভিন্ন অজুহাতে এদিনও সচিবালয়ে প্রবেশের চেষ্টা করেন দর্শনার্থীরা। ডিজিটাল পাসের বাইরেও অনেকে প্রতিদিন নানাভাবে বিভিন্নজনকে 'ম্যানেজ' করে সচিবালয়ে প্রবেশ করছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রীতিমতো বিরক্ত ও বিব্রত।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মানুষের জন্য রাজনীতি করি এ কারণে অনেকেই আসে। মানুষের প্রত্যাশা সব সময় থাকে, ন্যায়সংগত নয় সেগুলো তো আর হয় না। লোকজন আসে আমরা শুনি, নিয়ম- কানুন বুঝিয়ে বলে দিই। কেউ চাকরি চাইলেই তো আমরা দিতে পারি না, ন্যায়সংগত কিছু হলে দেখি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্ম সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এমনিতেই প্রচুর চাপ থাকে। এবার নির্বাচনী বছর। বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ আসে। আমার পাঁচটি প্রবেশ কার্ড দেওয়ার এখতিয়ার থাকলেও মন্ত্রী বা উপমন্ত্রীর জন্য উনাদের পিএসরা এসে অনেক সময় নিয়ে যান। বিভি- ন্ন স্কুল-কলেজ নিয়ে নানা তদবিরে ডেস্কে কাজ করা মুশকিল।

সচিবালয়ে নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিদিন ১৫০০-এর মতো দর্শনার্থী পাস নিয়ে প্রবেশ করেন। এর বাইরেও কোনো অনুরোধ থাকলে নানা কারণে প্রবেশ অনুমতি দেওয়া হয়।

যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব (সচিবালয় নিরাপত্তা শাখা) মোহাম্মদ রাশেদ হোসেন চৌধুরী বলেন, পাস দেওয়ার সংখ্যা কমেছে। তবে কেমন কমেছে সেটি বলতে চাননি তিনি। ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণবিধিমালা অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মচারী তার চাকরিসংক্রান্ত কোনো বিষয়ে প্রভাব খাটাতে পারেন না। তবুও অনেক সরকারি কর্মকর্তা তদবির করছেন।

জানা গেছে, বাজেটের পর থেকে সচিবালয়ে তদবিরের ভিড় বেড়েছে বেশি। শেষ মুহূর্তে কাজ বাগিয়ে নিতে আসছেন নানা তদবির নিয়ে। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এলাকার রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, মাদরাসা নির্মাণ, অনুদান, চাকরিসহ নানা তদবিরে সচিবালয়ে এলেও সরকারি কর্মচারীরা আসেন তাদের পদোন্নতির জন্য।

ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, এটা সত্য মানুষের তদবির এখন বেশি। অনেকে মনে করছেন নির্বাচনের বছর পছন্দের কর্মকর্তাদের দিয়ে, মন্ত্রীদের দিয়ে কাজটা করে নিই। পরের টার্মে যদি মন্ত্রী বা পছন্দের লোক দায়িত্বে না থাকেন। প্রতিদিন এসব মেনেই কাজ করতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমার এলাকার মানুষ আমার কাছে আসে মনে করে একটা উপকার করতে পারব। ইদানীং রাজনৈতিক তদবির বেশি বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী তদবির বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমার অফিস, বাসা-সব জায়গায় এত মানুষ এখন। সবাই মনে করছেন উনাকে আবার পাব কি না, দায়িত্বে থাকবেন কি না। এসব চিন্তা থেকে অনেক তদবির বেড়েছে।

প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, মানুষের জন্য রাজনীতি। আমরা একভাবে দেখি, তবে কর্মকর্তাদের কাছে বেশি ভিড় হলে রুটিন কাজ ব্যাহত হয়।

সচিবালয়ের বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, তদবিরবাজ হিসেবে তিনটি গ্রুপ সচিবালয়ের ভিতরে- বাইরে কাজ করে। একটি গ্রুপ ভিতরে প্রবেশ পাস ম্যানেজ করে। একটি গ্রুপ ফাইল পাস বা ছাড়ানোর চুক্তি নিয়ে কাজ করে। একটা গ্রুপ ভালো পোস্টিং নিয়ে কাজ করে। কেউ কেউ নিজেরাই নিজেদের কাজ নিয়ে তদবিরে ব্যস্ত হয়।

রাজশাহী থেকে আসা একজন সিনিয়র সহকারী সচিব বলেন, আমাকে ইউএনও হিসেবে পদায়ন করা হবে। অনেকেই সিনিয়র স্যারদের দিয়ে ফোন করিয়ে ভালো স্থানে পোস্টিং নিচ্ছেন। আমার একজন সিনিয়র স্যার আছেন সচিব হিসেবে তার কাছে এসেছি। তবে সেই সচিব কে সেটি বলেননি তিনি।

জানা গেছে, বিভিন্ন ডেস্ক ঘুরে সচিবের কাছে পৌঁছায় বিভিন্ন ফাইল। একজন সচিবকে গড়ে প্রতিদিন অর্ধশত ফাইল দেখতে হয়। তদবির এবং দর্শনার্থী বেশি থাকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ঠিকমতো দেখা হচ্ছে না বা পিছিয়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি কয়েকজন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিতে ৯ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ডিও দিয়েছেন। এর বাইরেও মৌখিকভাবে ফোনে অনুরোধ জানাচ্ছেন অনেকে। এতে অনেক সময় কর্মকর্তারাও বিরক্তি প্রকাশ করেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রীদের অনুরোধ, সিনিয়র স্যারদের অনুরোধ অনেক সময় রাখা যায় না, ফেলাও যায় না।

জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি তদবিরের চাপ সামাল দিতে হচ্ছে শিক্ষা, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, ভূমি, স্বাস্থ্য, এলজিআরডি, আইন ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে। এসব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের নানা ধরনের তদবিরের চাপ সামলাতে হচ্ছে। কেউ মন্ত্রীর লোক, এমপি, কিংবা দলীয় নেতা, এমপির আত্মীয়স্বজন প্রভৃতি পরিচয়ে সচিবালয়ে আসছেন নানা বিষয় নিয়ে।

নির্বাচনের আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনেকেই আসছেন পুলিশ রদবদলের তদবির নিয়ে। জেলার এসপি এবং থানার ওসি পরিবর্তন নিয়ে কেউ কেউ ঘুরছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। কেউ আসছেন দ্রুত অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে বা নিজ এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনের অনুরোধ নিয়ে। বিভিন্ন স্কুল- কলেজের এমপিওভুক্তি, পাঠদান অনুমতি, বর্ধিত শ্রেণি-শাখার অনুমতিসহ শিক্ষক বদলির তদবির রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। রাজনৈতিক পদ-পদবির প্রত্যাশা জানাতে কৃষিমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর দফতরে অনেকের আনাগোনা থাকছে প্রতিনিয়তই।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;