অত্যন্ত ভয়াবহ হবে হাশরের মাঠের চিত্র, হাশরের মাঠে বিচার শুরুর সুপারিশ

অত্যন্ত ভয়াবহ হবে হাশরের মাঠের চিত্র, হাশরের মাঠে বিচার শুরুর সুপারিশ
অত্যন্ত ভয়াবহ হবে হাশরের মাঠের চিত্র, হাশরের মাঠে বিচার শুরুর সুপারিশ

আরিফ খান সাদ ।।

অত্যন্ত ভয়াবহ হবে হাশরের মাঠের চিত্র। সেদিন পৃথিবী সৃষ্টি থেকে শুরু করে ধ্বংস হওয়ার পর্যন্ত সব মানুষকে জমায়েত করা হবে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে ‘সেদিন পরিবর্তিত করা হবে এ পৃথিবীকে অন্য পৃথিবীতে এবং পরিবর্তিত করা হবে আসমানসমূহকে এবং লোকেরা পরাক্রমশালী এক আল্লাহর সামনে হাজির হবে।’ (সুরা ইবরাহিম : ৪৮)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন সাদা ময়দার রুটির মতো চকচকে একটি মাঠের ওপর সব মানুষকে একত্রিত করা হবে। সেখানে কারও কোনো নিশানা থাকবে না।’ (বুখারি : কিতাবুত রিকাক)

হাশরের এই ভয়াবহ অবস্থায় সবাই অস্থির ও উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়বে। লোকজন বলাবলি শুরু করবে ‘ফয়সালা যাই হোক না কেন, হিসাব-নিকাশ ও বিচার শুরু যাক, হাশরের ময়দানের এই অসহ্য অবস্থা থেকে তো মুক্তি পাব!’ পরে লোকজন নবীদের কাছে যাবেন তারা যেন আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে বিচার শুরুর ব্যবস্থা করেন।

আদম (আ.)-এর অপারগতা প্রকাশ
বুখারি ও মুসলিম শরিফের বর্ণিত রয়েছে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘হাশরের ময়দানে পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ সব মানুষকে একটি সমতল জমিনে সমবেত করা হবে। সবাই সবাইকে দেখতে পাবে। সবাই সবার চিৎকার শুনতে পাবে। সূর্য অনেক নিকটে চলে আসবে। অস্থিরতা ও পেরেশানির কারণে মানুষ পরস্পরে বলাবলি করবে এখন আমরা কী করতে পারি? এ থেকে নিস্তার পাওয়ার কী উপায় আছে আমাদের? তখন কেউ কেউ বলবে, আমাদের আদি পিতা আদম (আ.), তার কাছে যাই। তখন সবই আদম (আ.)-এর কাছে গিয়ে বলবে, হে আদম! আপনি মানবজাতির পিতা। আল্লাহ আপনাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন। নিজেই আপনার রুহ ফুঁকে দিয়েছেন।

ফেরেশতাদেরকে আপনার সামনে সেজদা করার আদেশ দিয়েছেন। তারপর আপনাকে জান্নাতে বসবাস করিয়েছেন। সব বস্তুর নামও শিখিয়েছেন। সুতরাং আপনি আজ আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। যেন আল্লাহ আমাদের এই বিপদ থেকে মুক্তি দান করেন। তখন আদম (আ.) অপারগতা প্রকাশ করে বলবেন, মহান রাব্বুল আলামিন আজ এত বেশি ক্রোধান্বিত যে, কখনও এমন ছিলেন না, ভবিষ্যতেও এমন হবেন না। আমার থেকে তো একটা বড় ভুল সংগঠিত হয়েছিল। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আমি নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে ফেলেছিলাম। তাই আমি আজ সেই শাস্তির ভয়ে ভীত। আমার সুপারিশের সাহস নেই। তোমরা বরং নুহের কাছে যাও। কেননা তিনি প্রথম নবী ও রাসুল, যাকে আল্লাহ মানুষের হেদায়েতের জন্য পাঠিয়েছিলেন।’ (বুখারি : ৪৭১২;
মুসলিম : ১৯৪; তিরমিজি : ২৪৩৪)

নুহ (আ.)-এর অপারগতা প্রকাশ
আদম (আ.)-এর কাছে ব্যর্থ হয়ে সবাই হজরত নুহ (আ.)-এর কাছে হাজির হয়ে বলবে, হে নুহ! আপনি পৃথিবীর বুকে প্রথম রাসুল। আল্লাহ স্বয়ং আপনার নাম দিয়েছেন ‘আবদান শাকুরা’, শোকরগোজার বান্দা! আপনি আমাদের জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করুন। তখন নুহ (আ.) বলবেন, মহান রাব্বুল আলামিন আজ এত বেশি ক্রোধান্বিত যে, কখনও এমন ছিলেন না, ভবিষ্যতেও এমন হবেন না। আমার আমার একটি ভুল হয়েছিল। আমার ছেলে প্লাবনে ডুবে যাওয়ার সময় আমি আল্লাহর আদবের প্রতি লক্ষ না করে ছেলের মুক্তির জন্য প্রার্থনা করেছিলাম। তখন তিনি আমাকে ধমক দিয়েছিলেন। তাই আমি এই ভুলের জবাবদিহিতার ভয় করছি। আমার সুপারিসের সাহস নেই। তবে তোমরা ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে যেতে পার। আল্লাহ তাকে খলিল ও বন্ধু বলেছেন।’ (বুখারি : ৪৭১২; মুসলিম : ১৯৪; তিরমিজি : ২৪৩৪)

ইবরাহিম (আ.)-এর অপারগতা প্রকাশ
নুহ (আ.)-এর কাছে ব্যর্থ হয়ে সবই ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে এসে বলবে, আল্লাহ আপনাকে খলিল ও বন্ধু উপাধি দিয়েছেন। আপনার জন্য আগুনকে শীতল করে দিয়েছিলেন। সুতরাং আজ আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। যেন আমরা এই বিপদ থেকে রক্ষা পাই। তখন ইবরাহিম (আ.) বলবেন, মহান রাব্বুল আলামিন আজ এত বেশি ক্রোধান্বিত যে, কখনও এমন ছিলেন না, ভবিষ্যতেও এমন হবেন না। আমার থেকে তিনবার এমন কথা প্রকাশ পেয়েছিল যাতে মিথ্যার সম্ভাবনা রয়েছে। ১. একবার ঈদের দিন সবই মূর্তির জন্য খাবার সাজিয়ে ইবাদত করতে গেলে আমি না যাওয়ার জন্য বলেছিলাম, ‘আমি অসুস্থ বোধ করছি।’ ২. সবাই ঈদগাহে চলে গেলে আমি মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলি। সবাই আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আমি বলেছিলাম, তোমরা ভাঙা মূর্তিগুলোকে জিজ্ঞাসা কর, এরা নিজেরাই জবাব দেবে। অর্থাৎ আমি ভেঙেও এক রকম অস্বীকার করেছিলাম। ৩. আমার স্ত্রীকে নিয়ে মিসরে গেলে সেখানের অসৎ বাদশাহের দৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষার জন্য আমার স্ত্রীর পরিচয় হিসেবে বলেছিলাম, ‘সে আমার বোন।’ আমি এসব ভুলের জবাবদিহিতার ভয় করছি। সুতরাং আমার সুপারিশ করার সাহস নেই। (বুখারি : ৪৭১২; মুসলিম : ১৯৪; তিরমিজি : ২৪৩৪)

মুসা (আ.)-এর অপারগতা প্রকাশ
এরপর সবাই মুসা (আ.)-এর কাছে এসে বলবে, হে মুসা! আপনিই সেই ব্যক্তি যার সঙ্গে আল্লাহ সরাসরি কথা বলেছেন এবং তার কুদরতি হাতে আপনার তাওরাত লিখে দিয়েছিলেন। সুতরাং আপনি আমাদের জন্য সুপরিশ করুন। তখন তিনি উত্তর দেবেন, মহান রাব্বুল আলামিন আজ এত বেশি ক্রোধান্বিত যে, কখনও এমন ছিলেন না, ভবিষ্যতেও এমন হবেন না। আমি একবার আমি আল্লাহর অনুমতি ও নির্দেশ না নিয়ে নিজ সিদ্ধান্তেই এক কিবতি ব্যক্তিকে হত্যা করে ফেলেছিলাম। আমি সেই ঘটনার জবাবদিহিতার ভয় করছি। তোমরা বরং ঈসা (আ.)-এর কাছে যেতে পার।

ঈসা (আ.)-এর অপারগতা প্রকাশ
মুসা (আ.)-এর কাছেও ব্যর্থ হয়ে সবাই ঈসা (আ.)-এর কাছে এসে বলবে, হে ঈসা! আল্লাহ আপনাকে ‘রুহ’ বলেছেন, দোলনায় কথা বলিয়েছেন এবং ‘কালিমা’ বলেছেন। আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। তখন তিনি বলবেন, মহান রাব্বুল আলামিন আজ এত বেশি ক্রোধান্বিত যে, কখনও এমন ছিলেন না, ভবিষ্যতেও এমন হবেন না। আমার উম্মত আমাকে খোদা বানিয়েছে, খোদার পুত্র বানিয়েছে এবং এসব ভ্রান্ত ধারণা আমার দিকে সম্পৃক্ত করেছে। আমি এসব বিষয়ে জবাবদিহিতার ভয় পাই। বরং তোমরা মুহাম্মদের কাছে যাও।

অবশেষে মুহাম্মদ (সা.)-এর সুপারিশ
হজরত আবু হুরায়রা (সা.) বলেন, আমি এক দাওয়াতে রাসুল (সা.)-এর কাছে ছিলাম। রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি কেয়ামতের দিন সবার সরদার হব। সেই কঠিন দিনের কষ্ট সইতে না পেরে মানুষ অস্থির হয়ে যাবে এবং যার দ্বারা সুপারিশ করালে আল্লাহ কবুল করবেন এমন কাউকে খোঁজ করতে থাকবে। তারা অন্যান্য নবীর কাছ থেকে ব্যর্থ হয়ে সবশেষে সবাই আমার কাছে এসে বলবে, আপনি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, আমাদের কষ্ট তো আপনি দেখছেন, এখন দরবারে ইলাহিতে আমাদের জন্য সুপারিশ করুন, যাতে আমাদের পরিত্রাণ দেওয়া হয়।

নবীজি (সা.) বলেন, আমি তখন আল্লাহর আরশের নিচে এসে সিজদায় পড়ে কান্নাকাটি করতে থাকব। তখন আল্লাহ আমার কাছে একজন ফেরেশতা পাঠাবেন। তিনি এসে আমার বাহু ধরে ওঠাবেন। আল্লাহ বলবেন, আপনি মুহাম্মাদ? আমি বলব, জি, তিনিই ভালো জানেন। তখন আল্লাহ বলবেন, আপনার কী প্রয়োজন? আমি বলব, হে আমার রব! আপনি আমাকে সুপারিশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আপনার সৃষ্টির ব্যাপারে আমি সুপারিশ করছি, বিচার শুরু করুন। আল্লাহ বলবেন, আপনার সুপারিশ কবুল করা হলো, আমি আসব এবং বিচার করব।’ (মেশকাত : ৫৫৭২; তাফসিরে ইবনে কাসির : ২/২৯৬; তাবরানি : ২৯৬; মুসনাদে ইসহাক : ৬০৫)

নবীজির (সা.) সুপারিশের মাহাত্ম্য
সুপারিশের এই এখতিয়ার রাসুল (সা.) নিজেই পছন্দ করে নিজের জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে জিবরাইল (আ.) এসে জানালেন, আল্লাহ তায়ালা আমাকে দুটি প্রস্তাব দিয়ে পাঠিয়েছেন। যেকোনো একটি গ্রহণ করতে হবে। প্রস্তাব দুটি হলো, আমার অর্ধেক উম্মতকে বিনা হিসেবে বেহেশত দেওয়া হবে অথবা আমি যেকোনো উম্মতের জন্য আমার ইচ্ছেমতো সুপারিশ করতে পারব। আমি সুপারিশ করার ক্ষমতাটিই গ্রহণ করেছি। কাজেই আমি মুশরিক ব্যতীত সবার জন্য শাফায়াত করব।’ (ইবনে মাজাহ: ৪৩১৭)। অন্য একটি হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা সব নবীকেই একটি বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছেন। তা এই যে, তাদের একটি দোয়া অবশ্যই কবুল করা হবে। সব নবীই প্রয়োজন মোতাবেক এক-একটি জিনিস চেয়ে নিয়েছেন এবং তারা সবাই পার্থিব জিনিস চেয়েছেন। কিন্তু আমি এ সুযোগ পৃথিবীতে গ্রহণ করিনি। রোজ হাশরে আমি আমার প্রাপ্য আদায় করব এবং তা হবে আমার উম্মতের নাজাতের জন্য সুপারিশ করা।’ (বুখারি : ৫৮৬৩)

অন্যত্র এসেছে হাশরের ময়দানে কয়েক ধরনের সুপারিশ হবে। নবীজির প্রথম সুপারিশ হবে হাশরের মাঠে সব মানুষের বিচার শুরুর জন্য। দ্বিতীয় সুপারিশ হবে প্রথম পর্যায়ের মুমিনদের হিসাব-নিকাশ ছাড়াই বেহেশতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য। তৃতীয় সুপারিশ হবে যেসব মুমিন জাহান্নামে প্রবেশ করবে তাদের জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য। (আল-বুহুরুজ জাখিরাহ : ৬৩৮)