আনোয়ারার বধ্যভূমি ধ্বংস হতে চলেছে অযত্ন-অবহেলায়  

আনোয়ারার বধ্যভূমি ধ্বংস হতে চলেছে অযত্ন-অবহেলায়  
আনোয়ারার বধ্যভূমি ধ্বংস হতে চলেছে অযত্ন-অবহেলায়  

আনোয়ারা প্রতিনিধি ।।

স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫০ বছর পরও অযত্ন আর অবহেলায় মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো ধ্বংস হতে চলেছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর বর্বরতার চিহ্নও ধ্বংস হচ্ছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আনোয়ারা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে দেশের স্বাধীনতার জন্য শত্রুর সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। এসময় শতশত নিরিহ এলাকাবাসীকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে তারা। অথচ তাঁদের এসব গণকবর গুলো পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। স্বাধীনতার স্মৃতি বিজড়িত ১২ টি স্থানের মধ্যে মাত্র ২ টি স্থানে স্মৃতিস্তম্ব নির্মিত হলেও বাকী স্থান গুলো পড়ে আছে অযতেœ- অবহেলায়। স্বজন হারানোদের দাবী এসব স্থান গুলোতে স্মৃতিস্তম্ব তৈরী করে চিহ্নিত করে রাকা হউক।

আনোয়ারা উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানাযায়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদারদের সাথে আনোয়ারার ১২ স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখ সমর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এসব যুদ্ধে ৪ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ও নিরিহ লোক শহীদ হয়। এসব স্থান গুলো হল বারশত রাঙ্গাদিয়া ১৫ নং কর্ণফুলী ঘাট, বরুমচড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গন, বটতলী রুস্তম হাট, বারশত সুরমা পুকুর পাড়, আনোয়ারা থানা,বারখাইন তৈলারদ্বীপ আতাউর রহমান খান কায়সার সাহেবের বাড়ী, বারখাইন সঙ্খ নদীর পাড়, আনোয়ারা জয়কালী বাজারের ভরা দিঘীর পাড়,পূর্ব বারখাইন প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গন, পরৈকোড়া উচ্চ বিদ্যারয় পুকুর পাড়, খিলাপাড়া ও দক্ষিণ বন্দর।

সরেজমিনে উপজেলার জয়কালী বাজার বধ্যভূমিতে গিয়ে দেখাযায়, শহীদদের জন্য নির্মিত স্মৃতিসৌধটি দোকান ও ঝোপঝাড়ে আবদ্ধ করে রেখেছে। ভেতরে প্রবেশের মুখে কাটা দিয়ে বন্ধ করে রেখেছে। স্মৃতিসৌধের চারপাশে আগাছা ও পানিতে বর্তি। ভেতরে ডুকার চেষ্ঠা করেও সম্ভব হয়নি।

মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে প্রতিদিন আনোয়ারার লোকজন পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে মিছিল ও সভা করার খবর স্থানীয় রাজাকার ও মুসলিম লীগের নেতারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্তাদের কাছে পৌঁছালে তারা আনোয়ারার বিভিন্ন স্থানে গণ হত্যা চালালে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ শুরু করে। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সামনাসামনি যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর অনেক সদস্য নিহতও হয়।

জানা যায়, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা বিরোধী ফজলুল কাদের চৌধুরী(ফকা চৌধুরী) পরাজয় নিশ্চিত জেনে ১৪ ডিসেম্বর পরিবার নিয়ে বার্মা পালিয়ে যাওয়ার সময় ১৫নং ঘাটে (বর্তমানে সিইউএফএল ঘাটে) বোট আটকিয়ে গেলে লোক মারফত মুক্তিযোদ্ধারা সংবাদ পান এবং ৫০/৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা উক্ত স্থানে গিয়ে দুপুর ১২ টায় পরিবারসহ ফকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করেন।
২১ শে মে বেলা ২ টায় পরৈকোড়া উচ্চ বিদ্যালয় পুকুর পাড়, বাথুয়া পাড়া ও পূর্ব কন্যারা এলাকায় পাকবাহিনী, রাজাকার, আলবদর বাহিনী স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধিদের সহযোগিতায় ১৭৬ জন এলাকাবাসিকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে।

৭১ এর সেপ্টেম্ব-অক্টোবরে বরুমচড়া ইউনিয়নের শীলপাড়া ও শরীয়ত উলা মাষ্টারের বাড়ীতে রাজাকার আলবদর বাহিনী আগুন দিলে বারখাইন ও তৈলারদ্বীপ থেকে ২০-২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা এসে রাজাকারদের উপর আক্রমন চালায়। রাজাকারেরাও পাল্টা আক্রমন করে ,পরে রাজাকারেরা নলদিয়া গ্রাম হয়ে বরুমচড়া ত্যাগ করে।

৭১ এর ২৯ নভেম্বর দুপুর ২ টায় প্রায় ১৭০ জন রাজাকার বটতলী রুস্তমহাটে আসলে মুক্তিযোদ্ধারা চারপাশ থেকে আক্রমন শুরু করে, রাজাকারেরাও পাল্ট আক্রমন চালায়। এখানে একজন রাজাকার মরা যায় ও রাজাকার কমান্ডার আহমদ ছফাসহ অনেক রাজাকারকে গ্রেফতার করা হয় এবং পরে তাদের ফাইয়ারিং স্কয়ার্ড দেওয়া হয়। এ সময় অনেক রাজাকার পালিয়ে যায়।

৭১ এর ৭ জুলাই বারশত ইউনিয়নের সুরমা পুকুর পাড় স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে রাজাকার, আলবদরদের আক্রমন, পাল্টা আক্রমন হওয়ায় রাগের বশবর্তী হয়ে পাকবাহিনীসহ রাজাকার আলবদর বাহিনী একত্রে আসিয়া উক্ত স্থানে ৩০ জন নিরিহ লোককে ধরে লাইন করে গুলি করে হত্যা করে। পরে সেপ্টেম্ব-অক্টোবরে যুদ্ধকালীন গ্রুপ নং- ৩২,৩৩,৩৪,৩৫,৩৬ এর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে রাজাকার, আলবদর, আলশামস এর সম্মুখ যুদ্ধ হলে মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম আলী শহীদ হয় এবং উক্ত স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

২৩ সেপ্টেম্বর ভোর ৫ টায় আনোয়ারা থানা দখল করতে যুদ্ধকালীন গ্রুুপ নং- ৩২,৩৩,৩৪,৩৫,৩৬ এর মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ব পরিকল্পনা নিয়ে শত্রুবাহিনীকে চারপাশ থেকে আক্রমন করে। সম্মুখ যুদ্ধে বেশ রাজাকার ও তাদের দোসর নিহত হয় এবং ১৫/২০জন রাজাকারকে গ্রেফতার করে ফাইয়ারিং স্কয়াডে হত্যা করা হয়।

১৭ এপ্রিল সকাল ১১ টায় পাক হানাদার বাহিনী আওয়ামীলীগ নেতা সাবেক এম.সি.এ আতাউর রহমান খান কায়সারের বারখাইন তৈলারদ্বীপ এলাকার বাড়ী গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষ ভাগে বারখাইন সঙ্খ নদীর পাড় ভাঙ্গারমুখ এলাকায় পাকহানাদর বাহিনী ও রাজাকারদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়।

৪ অক্টোবর বেলা ১১ টায় জয়কালী বাজার পশ্চিম পার্শ্বে ভরা দিঘীর দক্ষিণ পাড়ে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরেরা বাজারের নিরিহ দোকানদারদের ধরে এনে একই স্থানে ৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে।

সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে পূর্ব বারখাইন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা এলাকার ৭ জন লোককে ধরে একসাথে ব্রাসফায়ার করে হত্যা করে।

২১ শে এপ্রিল খিলপাড়া, ১নং ওয়ার্ডে স্থানীয় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা এলাকার লোকজনের উপর এলোপাতাড়ি গুলি করে ৯ জনকে হত্যা করে।

২০ শে মে সকাল ৭ টা থেকে ৯টায় বৈরাগ ইউনিয়নের দক্ষিণ বন্দর এলাকয় স্থানীয় রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী এলাকার লোকজনকে উক্ত স্থানে জড়ো করে লাইন করে দাঁড় করে ব্রাস ফায়ার করে ১৫৬ জনকে হত্যা করে। পরে কয়েকটি গর্ত করে তাঁদের মাটি চাপা দেওয়া হয়।

সম্প্রতি আনোয়ারার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দক্ষিণ বন্দর ও সুরমা পুকুর পাড় এলাকায় বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ নির্মান করলেও অন্য স্থান গুলোতে কোন চিহ্নও নেই। নির্মানকৃত স্মৃতি সৌধ গুলোও ঝোপঝাড়ে অযতেœ অবহেলায় পড়ে আছে। শুধু কোন জাতীয় দিবস আসলেই পরিস্কার করা হয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী বলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন সময়ে দক্ষিণ বন্দর বধ্যভূমিতে ১৫৬ জন নিরিহ মানুষকে হত্যাকরে একটি কবরে দাফন করা হয়েছে। দীর্ঘদিন অরক্ষিত থাকার পর মুক্তিযোদ্ধার অন্যতম সংগঠক মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরীর প্রচেষ্ঠায় এখানে একটি বধ্যভূমি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়।

উপজেলা মুক্তিযুদ্ধা কমান্ডার আবদুল মান্নান জানান, ১৯৭১ সালে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্দিষ্টস্থান চিহ্নিত করে স্মৃতিসৌধ নির্মানের দাবী জানাচ্ছি।

আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, বধ্যভূমি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আনোয়ারার বধ্যভূমি গুলো চিহ্নিত করে স্মুতিস্তম্ব নির্মাণের জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে একটি তালিকা পাঠানো হয়েছে। তৎমধ্যে ২টি স্থানে স্মৃতিস্তম্ব নির্মাণের টেন্ডারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। বাকী স্থানেও পর্যাক্রমে স্মৃতিস্তম্ব নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষনের ব্যবস্তা করা হবে।

এ বিষয়ে আনোয়ারা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক চৌধুরী বলেন, ৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানিরা আনোয়ারার বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চালিয়েছে। আমাদের প্রয়াত নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এসব গণকবর ও বধ্যভূমি রক্ষনাবেক্ষনের জন্য দক্ষিণ বন্দর ও সুরমা পুকুর এলাকায় ২ টি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে ছিলেন। পর্যায়ক্রমে সব বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হবে।