ইপুয়েট থেকে আজকের বুয়েট

আলী আজম ।।

ইপুয়েট থেকে আজকের বুয়েট
বুয়েটের ইতিহাস

জরিপ শিক্ষালয়  থেকে ‘ঢাকা সার্ভে স্কুল'।
১৯০৮ সালে  'আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল ।
১৯৬২ সালের ১ জুন এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করে নাম দেয়া হয় পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও কারিগরী বিশ্ববিদ্যালয় ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)’।

 
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (Bangladesh University of Engineering and Technology) (সংক্ষেপে বুয়েট, BUET) বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। রাজধানী ঢাকার পলাশীতে ৭৬.৮৫ একর জমি নিয়ে অবস্থিত এ বিশ্ববিদ্যালয়টি।


আজকের বুয়েটের ইতিহাস
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জরিপকারদের জন্য একটি জরিপ শিক্ষালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় বর্তমানের বুয়েট। ১৮৭৬ সালে এটি 'ঢাকা সার্ভে স্কুল' নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তৎকালিন ব্রিটিশ ভারত সরকার তাদের কাজের সুবিধার জন্য এটি প্রতিষ্ঠা করে। ১৯০৫ সালে ঢাকার তৎকালীন খাজা আহসানউল্লাহ এ স্কুলের প্রতি আগ্রহী হন। মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষার অগ্রগতির জন্য তিনি স্কুলে ১ লাখ ১২ হাজার টাকা দান করেন। তার মহৎ অনুদানে এটি পরবর্তীতে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষালয় হিসেবে প্রসার লাভ করে।

 

তৎকালিন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল।

তৎকালিন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল।

এরপর ১৯০৮ সালে এ বিদ্যালয়টি তার নামানুসারে 'আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল' হিসেবে নামকরণ করা হয়। এ সময় এখানে তিন বছর মেয়াদি পুরকৌশল, তড়িৎকৌশল এবং যন্ত্রকৌশল এ তিনটি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স পড়ানো হতো। শুরুতে একটি ভাড়া করা ভবনে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম চলত। ১৯০৬ সালে সরকারি উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের কাছে এর নিজস্ব ভবন নির্মিত হয়। পরে ১৯২০ সালে এটি বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তরিত হয়।

শুরুতে বিদ্যালয়টি ঢাকা কলেজের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। পরবর্তীতে এটি জনশিক্ষা পরিচালকের অধীনে পরিচালিত হতে থাকে। মি. এন্ডারসন এর প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এরপর ১৯৩২ সালে শ্রী বি সি গুপ্ত ও ১৯৩৮ সালে হাকিম আলী অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এই অঞ্চলে দক্ষ জনশক্তির অভাব ছিল। এই অভাব দূর করতে সরকার নিযুক্ত একটি কমিটি যন্ত্র, তড়িৎ, কেমি ও কৃষি প্রকৌশলে ৮ বছর মেয়াদি ডিগ্রি কোর্সে ১২০ জন ছাত্রের জন্য ঢাকায় একটি প্রকৌশল কলেজ স্থাপন এবং আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলকে তৎকালীন পলাশী ব্যারাকে স্থানান্তর করার সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে এই স্কুলে পুর, যন্ত্র, ও তড়িৎ কৌশলে ৩ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে ৪৮০ জন ছাত্র ভর্তির সুপারিশও করা হয়।
 

১৯৪৭ ভারত- পাকিস্তানের দেশবিভাগের ফলে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের মুষ্টিমেয় কয়েকজন শিক্ষক ছাড়া বাকি শিক্ষকদের সবাই ভারতে চলে যান। অন্যদিকে ভারত থেকে ৫ জন শিক্ষক এ স্কুলে যোগদান করেন। ১৯৪৭-এর আগস্ট মাসে এটিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের অধীনে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ রূপে উন্নীত করা হয়।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এই কলেজটিকে অনুমোদন দেয়। ১৯৫৬ সালে কলেজে সেমিস্টার প্রথা চালু হয় ও নতুন পাঠ্যক্রম অনুমোদিত হয়। ১৯৫৭ সালে ডিগ্রি কোর্সে আসন সংখ্যা ১২০ থেকে বাড়িয়ে ২৪০ করা হয়। ১৯৫৮ সালে কলেজ থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স বন্ধ করে দেওয়া হয়।

১৯৫১ সালে টি এইচ ম্যাথুম্যান এবং ১৯৫৪ সালে ড. এম এ রশিদ কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। এ সময়ে এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড মেকানিক্যাল কলেজ অব টেক্সাস ও আহসানউল্লাহ কলেজের সঙ্গে যৌথ ব্যবস্থাপনার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে সেখান থেকে অধ্যাপকরা এদেশে এসে শিক্ষকতার মান, ল্যাবরেটরি ও পাঠ্যক্রম উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষকদের মানোন্নয়নের জন্য কিছু শিক্ষককে স্নাতকোত্তর পড়াশোনার জন্য ওই কলেজে পাঠানো হয়। এ সময় এশিয়া ফাউন্ডেশন কিছু প্রয়োজনীয় বইপত্র দান করলে কলেজে রেন্টাল লাইব্রেরি প্রথা চালু করা হয়। কলেজ থাকা অবস্থায় ছাত্রদের জন্য কেবল দুটি ছাত্রাবাস ছিল-মেইন হোস্টেল (বর্তমান ড. এম. এ. রশীদ ভবন) ও সাউথ হোস্টেল (বর্তমান কাজী নজরুল ইসলাম হল)

 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন হোস্টেল ।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন হোস্টেল ।

প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী পাকিস্তান আমলে ১৯৬২ সালের ১ জুন তারিখে এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করে নাম দেয়া হয় পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও কারিগরী বিশ্ববিদ্যালয় (East Pakistan University of Engineering and Technology, or EPUET)।  তৎকালীন কারিগরী শিক্ষা পরিচালক ডঃ এম. এ. রশিদ প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন। অধ্যাপক এ. এম. আহমেদ প্রকৌশল অনুষদের প্রথম ডীন নিযুক্ত হন। খ্যাতনামা গণিতজ্ঞ এম. এ. জব্বার প্রথম রেজিস্ট্রার ও মমতাজউদ্দিন আহমেদ প্রথম কম্পট্রোলার নিযুক্ত হন। ডঃ এম. এ. রশিদের যোগ্য নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়টি দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)’।

 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি সংগৃহিত

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি সংগৃহিত

বিশ্ববিদ্যালয়রূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে ছাত্রদের জন্য তিনটি নতুন আবাসিক হল তৈরি করা হয়। অধ্যাপক কবিরউদ্দিন আহমেদ প্রথম ছাত্রকল্যাণ পরিচালক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬২ সালেই প্রথম স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদে স্থাপত্য বিভাগ গঠন করা হয়। এই বিভাগের জন্য টেক্সাস এ. অ্যান্ড এম. কলেজের কয়েকজন শিক্ষক যোগদান করেন। এভাবে প্রকৌশল ও স্থাপত্য এই দুটি অনুষদে পুর, যন্ত্র, তড়িৎ, কেমি ও ধাতব প্রকৌশল এবং স্থাপত্য বিভাগ নিয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য ১৯৬৪ সালে আসন সংখ্যা ২৪০ থেকে ৩৬০ জনে উন্নীত করা হয়। ১৯৬৯-৭০ সালে আসন সংখ্যা ৪২০ জনে উন্নীত হয়। এ সময় স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদে ফিজিক্যাল প্ল্যানিং নামে একটি নতুন বিভাগ চালু হয়। এটিই পরবর্তীতে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগে পরিণত হয়েছে।
 

এক নজরে বুয়েট
অবস্থান : ঢাকার পলাশীতে
প্রতিষ্ঠা : ১৯৬২ সালের ১ জুন (পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে)।
আয়তন : ৭৬.৮৫ একর/ বর্তমানে ক্যাম্পাসের আয়তন হল ৭৬.৮৫ একর (৩১১,০০০ ব.মি.)।
বুয়েটে বর্তমানে ৫ টি অনুষদের অধীনে ১৮ টি বিভাগ রয়েছে।
ইনস্টিটিউট : ৪টি । আবাসিক হল : ৮টি। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা : সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, মিলনায়তন, ব্যায়ামাগার, খেলার মাঠ ইত্যাদি।

ইনস্টিটিউটসমূহঃ
জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্প্রসারণ এবং প্রকৌশল ও প্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে বুয়েটে ৪টি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলো হলঃ
১ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ইন্সটিটিউট (আইআইসিটি)
২ পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট (আইডব্লিউএফএম)
৩ এপ্রোপ্রিয়েট টেকনোলজি ইনস্টিটিউট (আইএটি)
৪ দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউট (এআরআই)


তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ইন্সটিটিউট (আইআইসিটি) Institute of Information and Communication Technology (IICT)
“Institute of Information and Communication Technology” সংক্ষেপে “IICT” নামেও পরিচিত। তথ্য প্রযুক্তির প্রসারে অবদান রাখার উদ্দেশ্যে ২০০১ সালের জুন মাসে বুয়েট সিন্ডিকেট এই ইনস্টিটিউট চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০১ সালের ২ সেপ্টেম্বর এটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়।

পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট (আইডব্লিউএফএম) Institute of Water and Flood Management (IWFM) ।
সাবেক “বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিস্কাশন গবেষণা ইনস্টিটিউট” এর নাম পরিবর্তিত হয়ে “পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট” হয়েছে। বাংলাদেশের বন্যা সমস্যা, নদী ভাঙন, ভরাট ও গতিপথ পরিবর্তন, পানি নিস্কাশন সমস্যা, সেচ ব্যবস্থা, ভূ-গর্ভস্থ ও ভূ-উপরিস্থ পানি চলাচল, সামুদ্রিক জলোচ্ছাস প্রভৃতি বিষয়ে বাস্তবমুখী গবেষণা পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে এটি গঠিত হয়েছে। বর্তমানে এই ইনস্টিটিউট পানি সম্পদ উন্নয়নের উপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রী প্রদান করছে।

এপ্রোপ্রিয়েট টেকনোলজি ইনস্টিটিউট (আইএটি) Institute of Appropriate Technology (IAT) ।
বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যথোপযুক্ত গবেষণা কার্যক্রম, প্রযুক্তি মূল্যায়ন, বাছাই, আত্মস্থকরন, বিকাশ, হস্থান্তর, উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করার নিজস্ব ক্ষমতা ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করাই এই ইনস্টিউটের মূল উদ্দেশ্য। দেশের বিভিন্ন কর্মকান্ড, বিভিন্ন প্রযুক্তিগত সমস্যা, নতুন লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রসারণ ইত্যাদির উপর বর্তমানে কাজ চলছে। গবেষণার পাশাপাশি এই ইনস্টিটিউটের সদস্যগণ বুয়েটের বিভিন্ন বিভাগে, এমনকি বুয়েটের বাইরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষকতা করে থাকেন। বুয়েটের ব্যায়ামাগারের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে এটি অবস্থিত।

দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউট (এআরআই) Accident Research Institute (ARI) ।
পূর্বে “Accident Research Centre” নামে পরিচিত বর্তমানে নাম পরিবর্তিত হয়ে “Accident Research Institute” হয়েছে। সড়ক, রেল ও পানিপথে বিভিন্ন দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান এবং এই সংক্রান্ত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালনা করাই মূলত এই ইনস্টিটিউটের কাজ। এছাড়া এই ইনস্টিটিউট দেশজুড়ে নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এই উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন স্তরের পেশাজীবি মানুষের জন্য বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করে থাকে ২০০২ শালে প্রতিষ্ঠিত এই ইনস্টিটিউট। এটি “নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা” ভবনের পূর্ব পাশে অবস্থিত। এই ইনস্টিটিউটের দুটি শাখা রয়েছে – (১)রিসার্চ এন্ড ইনভেস্টিগেশন, (২)এডুকেশন এন্ড ট্রেনিং। 

- সময়ের আলো।