ক্যানসারের রেডিওথেরাপি মেশিন দ্বিগুণেরও বেশি দামে কেনা হচ্ছে,স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এপিএস আরিফের দুর্নীতি

⚫প্রযুক্তি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে বেশি দরে চুক্তি ⚫আগের তিন মেশিনের দুটি নষ্ট, একটি অকেজো

ক্যানসারের রেডিওথেরাপি মেশিন দ্বিগুণেরও বেশি দামে কেনা হচ্ছে,স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এপিএস আরিফের দুর্নীতি

মোস্তফা ইমরুল কায়েস।।

ক্যানসার চিকিৎসায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি যেন পিছু ছাড়ছে না। ক্যানসার হাসপাতালে বিভিন্ন মেশিন অবহেলায় ফেলে রাখার খবরের রেশ কাটতে না কাটতেই এবার দ্বিগুণ দামে ক্যানসার চিকিৎসায় তিনটি রেডিওথেরাপি মেশিন (মডেল-কোবাল্ট সিক্সটি নামে পরিচিত) কেনা হচ্ছে। সেজন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালিকের এপিএস আরিফ প্রভাব খাটিয়ে তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তি ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি মেশিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ৩২ কোটি ৬৪ লাখ ১৪ হাজার ১৮ টাকার কাজ পাইয়ে দিয়েছেন। এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রযুক্তি ইন্টারন্যাশনাল সম্প্রতি পরমাণু গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে একই মেশিন ৫ কোটিরও বেশি টাকায় সরবরাহ করেছে। আর স্বাস্থ্য অধিদফতর সেই একই মেশিন কিনছে ১০ কোটিরও বেশি মূল্যে। ফলে তিনটি মেশিন কেনায় প্রায় ১৭ কোটির বেশি টাকা গচ্চা যাবে সরকারের। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এখানে বড় ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি জানা সত্তে¦ও এপিএস আরিফের প্রভাবেই চুক্তি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আরিফুর রহমান বলেন, এসব অভিযোগ সত্য নয়, আর আমার গত ছয় মাস থেকে কারও সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগও নেই। এসব ব্যাপারে আমি জানিও না। এগুলো পুরোপুরি অসত্য। যারা এসব বলে তারা প্রমাণও দিতে পারবে না।

স্বাস্থ্য অধিদফতর ও ক্যানসার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মেশিন তিনটি কেনা হচ্ছে কর্মকর্তাদের পকেটভারী করার জন্য। আসলে মেশিনের আসল দাম সর্বসাকল্যে তিন সাড়ে কোটির বেশি নয়। শুধু এখানেই শেষ নয়, এই মেশিনগুলো সরবরাহের পর আরও সংযুক্তি যন্ত্রপাতির চাহিদাপত্র দেখিয়ে আরও কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও পরিকল্পনাও চলছে। তারা আরও বলছেন, এই ক্রয়ে মানা হয়নি কোনো টেন্ডারের নিয়ম। আগের মেশিনগুলো (কোবাল্ট-৬০) পড়ে থাকলেও নিজের পকেটভারী করতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালিকের এপিএস আরিফ ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের কিছু কর্মকর্তা একই ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন। কম দর দিয়েও কাজ পায়নি আরেক প্রতিষ্ঠান। ফলে কম দরের চেয়ে বেশি দামে মেশিন কেনাটা স্পষ্টত বড় রকমের দুর্নীতি বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, তিন হাসপাতালে ক্যানসারের চিকিৎসায় রেডিওথেরাপির দুটি নষ্ট ও একটি অকেজো হয়ে পড়ে ছিল। হাসপাতালগুলো হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মহাখালী ক্যানসার ইনস্টিটিউট হাসপাতাল ও বগুড়া শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। গত বছর ক্যানসারের তিনটি রেডিওথেরাপি মেশিন (কোবাল্ট সিক্সটি) কেনার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। তারই অংশ হিসেবে সে বছর সেগুলো কেনার জন্য ২৩ মে টেন্ডারও আহ্বান করা হয়। টেন্ডার আহ্বান করার পর মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান টেন্ডার ড্রপ করে। পরদিন টেন্ডারবক্স খুলে তড়িঘড়ি করে প্রযুক্তি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অভিযোগ উঠেছে, এই চুক্তি হয় অত্যন্ত গোপনে। বিষয়টি চার মাস গোপন রাখার পর তা প্রকাশ করা হয়।
টেন্ডার দাখিলকারী দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, তিনটি রেডিওথেরাপি মেশিনের জন্য প্রযুক্তি ইন্টারন্যাশনাল (মূল প্রতিষ্ঠান বেস্ট থেরাট্রনিকস লিমিটেড-কানাডা) টেন্ডারে প্রথম লটের (দুটি মেশিন) জন্য দর দেয় ১৯ কোটি ৮২ লাখ ৮৭ হাজার ২১২ টাকা এবং দ্বিতীয় লটের (একটি) জন্য ১২ কোটি ৮১ লাখ ২৬ হাজার ৮০৬ টাকা। মোট তিনটি রেডিওথেরাপি মেশিনের জন্য প্রযুক্তির দর ছিল ৩২ কোটি ৬৪ লাখ ১৪ হাজার ১৮ টাকা। অন্যদিকে আরেক প্রতিষ্ঠান এসএমই ট্রেড করপোরেশন (মূল প্রতিষ্ঠান ইউজেপি ফার্মা-চেক রিপাবলিক) দুটির জন্য ১৯ কোটি ৭৫ লাখ ২৩ হাজার ৫৪৯ টাকা এবং অন্যটির জন্য ১২ কোটি ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৫৩৯ টাকা। সব মিলিয়ে তারা তিনটির জন্য মোট দর দেয় ৩১ কোটি ৯৩ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮ টাকা। দুই টেন্ডারের দরের পার্থক্য ছিল ৭০ লাখ ৪৪ হাজার ৯৩০ টাকা। এত টাকা কম দর দেওয়ার পরও কাজ পায়নি এসএমই ট্রেড করপোরেশন নামে প্রতিষ্ঠানটি। শুধু তাই নয়, টেন্ডার ফেলার মাত্র তিন দিনের মাথায় বেশি দরদাতাকেই কাজ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এরপর সেই ফাইলপত্র স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে মন্ত্রণালয়ে নিয়ে যায় মন্ত্রীর লোকজন।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন মেশিন সরবরাহ করতে যাওয়া প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তি ইন্টারন্যাশনাল সম্প্রতি পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে একই রেডিওথেরাপি মেশিন সরবরাহ করেছে। তাতে তারা দাম ধরে ছিল সাড়ে ৫ কোটি টাকা। কিন্তু ক্যানসার চিকিৎসার জন্য সরবরাহ করতে যাওয়া একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেই একই মেশিনের দাম ধরেছে ১০ কোটির বেশি। ফলে একই মেশিন দ্বিগুণের বেশিও দামে কেনা হচ্ছে। বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদফতরের সবা জানলেও কেউ ভয়ে মুখ খুলছেন না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, এই দুর্নীতিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন মন্ত্রীর এপিএস আরিফ। কারণ প্রযুক্তি ইন্টারন্যাশালে তার শেয়ার রয়েছে। শুধু আরিফই নয়, তার সঙ্গে মন্ত্রীর ছেলে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি ও কিছু কর্মকর্তাও জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।
যে তিন হাসপাতালে মেশিন সরবরাহ করা হবে সেগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেশিনগুলোর দুটি নষ্ট আরেকটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে। দক্ষ জনবল ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মেশিনগুলো আনার পর দীর্ঘদিন পড়ে ছিল। তা ছাড়া এইসব মেশিন চালানোর মতো তেমন দক্ষ কর্মীও না থাকায় দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ওই তিন মেশিনও সরবরাহ করেছিল প্রযুক্তি ইন্টারন্যাশনাল। এখন ওই মেশিনগুলোর কেউ দায় নিচ্ছে না সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। উল্টো পকেটভারী করতে আবারও তাদের কাছে সেই মেশিনই কিনছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। জানা গেছে, চুক্তিতে আসতে যাওয়া তিন মেশিনের দুটি নতুনভাবে বসবে আরেকটি বদলি হিসেবে বসবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সাম্প্রতিককালে যে বিষয়গুলো বেশ ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে, সেগুলোর অন্যতম হলো সরকারি ক্রয়ে খাতে অনিয়ম। এমন প্রক্রিয়ায় অবাস্তব মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে এসব দুর্নীতি সংঘটিত হচ্ছে। স্বাস্থ্যখাতেও ইতোমধ্যে বেশ আলোচিত বিষয় ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যখাতে যদি আরও একটা দুর্নীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন হয় তবে সরকারি খাতে অর্থের অপচয় হবে আর সেই বোঝা পড়বে জনগণের ওপর। অন্যদিকে সরকারি খাতে সুশাসনের ঘাটতি ও দুর্নীতি এক ধরনের যে প্রাতিষ্ঠানিক লাভ করেছে তার অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে ক্রয়খাত। সেটির আরও একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে সে কারণে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অবহিত না থাকার কথা নয়। তারপরও যদি ওই প্রতিষ্ঠানকে কাজের সুযোগ দেওয়া হয় তবে প্রশ্ন উঠবে, সংশ্লিষ্ট খাত বা মন্ত্রণালয়ের যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জড়িত তারা কোনো সুবিধাভোগী কি না এবং ওই প্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষার মধ্য দিয়ে তারা কোনো অনৈতিকভাবে কোনো সুবিধা নিচ্ছেন কি না, সেটি দেখার বিষয়। ক্রয়খাতে দুর্নীতিটা এক হাতে ঘটে না, ফলে যারা এ ধরনের ব্যবসা করে তারা যেমন দায়ী, পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত তারাও যে এর অংশীদার, সেটিও কিন্তু ঘটনার সঙ্গে প্রমাণ করে। পুরো বিষয়টি উচিত হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খতিয়ে দেখা আর এটা এক ধরনের জিকে শামীমের দৃষ্টান্ত স্থাপনের ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দাখিলকৃত নথিপত্রে দেওয়া মোবাইল নাম্বারের সূত্র ধরে ফোন করা হলে একজন ব্যক্তি কলটি ধরে জানান, নাম্বারটি তার এবং তিনি একটি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এরপর তিনি প্রযুক্তির স্বত্বাধিকারী এসএম জামানের নাম্বার দিলে সেই নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়। এছাড়াও কাগজে থাকা একটি টেলিফোন নাম্বারে কল করা হলে সেটি পরিবর্তন হয়েছে বলে জানানো হয়। প্রতষ্ঠানটির উল্লেখ করা টেলিফোন নাম্বারেও ভুয়া এবং অন্যের নাম্বার দিয়ে প্রতারণা করেছে।

 স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক চিকিৎসক আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে ফোনে পাওয়া সম্ভব হয়নি। এমনকি কয়েকবার খুদে বার্তা পাঠালেও তার কোনো জবাব মেলেনি।- দৈনিক সময়ের আলো