কর্ণফুলীর তীরে ভাসছে হাজার হাজার কেজি পচা পেঁয়াজ

কর্ণফুলীর তীরে ভাসছে হাজার হাজার কেজি পচা পেঁয়াজ

চউকের ডাস্টবিনে সাড়ে ২২ লাখ টাকার পচা পেঁয়াজ , চাক্তাই খাল ও কর্ণফুলী নদীতে নিক্ষেপ করা হল! কর্ণফুলীর তীরে ভাসছে হাজার হাজার কেজি পচা পেঁয়াজ। এগুলোর মধ্য থেকে অপেক্ষাকৃত ভাল পেঁয়াজ সংগ্রহ করে তা আবার কম দামে বিক্রি করছে অনেকে। যেগুলো জনস্বাস্থ্যে মারাত্মক বিষক্রিয়া সৃষ্টি করবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কর্ণফুলী নদীতে এসব নষ্ট পেঁয়াজ ফেলার কারণে এখানকার পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে বাজারে পেঁয়াজ সরবরাহে মারাত্মক সংকটের মধ্যে নগরীতে ভোগ্যপণ্যের পাইকারী বাজার খাতুনগঞ্জের আড়ত থেকে ডাস্টবিন, চাক্তাই খালের পাড়ে ও কর্ণফুলী নদীতে ফেলা হচ্ছে বস্তায়-বস্তায় পচা পেঁয়াজ। তবে ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা বলছেন, মিয়ানমার থেকে নৌকা করে পেঁয়াজের চালান আনার সময় নীচের অংশে থাকা অধিকাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে। পানির কারণে এটা হয়েছে জানিয়ে তারা বলেন, এসব পচা পেঁয়াজ ফেলে দেয়া ছাড়া কোন গতি নেই। এদিকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা জানিয়েছেন, গত তিনদিন ধরে খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন মার্কেটের গুদাম থেকে ফেলা ১৫ থেকে ১৬ মেট্রিকটন পচা পেঁয়াজ তারা অপসারণ করেছেন। যদি পেঁয়াজের কেজি ১৫০ টাকা করেও ধরি তাহলে ১৫ টনের দাম হবে সাড়ে ২২ লাখ টাকা। পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা আরো বলছেন, তাদের গুদামে কোনো পেঁয়াজ মজুদ নেই। মিয়ানমার থেকে যেসব পেঁয়াজের চালান আসছে, সেখানেও পচা পেঁয়াজ আছে। সেগুলো ফেলে দেওয়া হচ্ছে। গতকাল শনিবার নগরীর খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন মার্কেটে পেঁয়াজের গুদাম ও পাইকারী বিক্রয় প্রতিষ্ঠানে বস্তায় বস্তায় পচা পেঁয়াজ দেখা গেছে। আবার পচা পেঁয়াজের বস্তা বিক্রি হতেও দেখা গেছে। এর আগে বৃহস্পতিবার রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত খাতুনগঞ্জ সংলগ্ন চাক্তাই খালপাড় ও কর্ণফুলী নদীতে এবং পাড়ে ফেলা হয় শতশত পেঁয়াজের বস্তা। রাতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা সেই পেঁয়াজ নিয়ে বায়েজিদ বোস্তামি থানার আরেফিননগরে আবর্জনাগারে ফেলছেন। এছাড়া নদী ও এর পাড় থেকে অনেকে পচা পেঁয়াজ কুড়িয়ে রোদে শুকাতে দেখা গেছে।
এ বিষয়ে নগরীর ৩৫ নম্বর বক্সিরহাট ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক আহমদ ছফা জানান, খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মার্কেটে, সামনের রাস্তায়, চান মিয়া বাজার ও মধ্যম চাক্তাই এলাকায় পচা পেঁয়াজ পেয়েছি। চারটি ট্রাকে করে আমরা সেগুলো আরেফিননগরে ময়লার ভাগাড়ে ফেলেছি।
এ বিষয়ে হামিদুল্লাহ মার্কেট কাঁচামাল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিচ জানান, মিয়ানমার থেকে নৌকায় করে পেঁয়াজ আসছে। যেসব পেঁয়াজ নৌকার তলায় থাকে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। গুদামে আসার পর সেগুলো ফেলে দিতে হচ্ছে। যেসব পচা পেঁয়াজ ফেলে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো মিয়ানমারের পেঁয়াজ।
ক্যাবের কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন জানান, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ তদারকির অভাবে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা মজুতদারির সুযোগ নিয়েছে। মজুদের মাধ্যমে বাজারে সরবরাহ সংকট তৈরি করে বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। মজুদ করা যেসব পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারেনি, পচে গেছে, সেগুলো এখন ভাগাড়ে ফেলা হচ্ছে। এটা ‘কোলর পোয়া কোলত মারি ফেলাইয়ুম, ত ফুইসসইন নইদ্দম’ (কোলের ছেলে কোলেই মেরে ফেলব, তবু দত্তক দেব না) এর মতো।
এদিকে ব্যবসায়ীরা জানান, মিয়ানমার থেকে শুক্রবার ১৬৮ টন পেঁয়াজ খাতুনগঞ্জে এসেছে। পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতার মধ্যে গতকাল শনিবার একদিনেই চট্টগ্রামে ১৯৮ টন পেঁয়াজ এসেছে। এর মধ্যে চীন ও মিশর থেকে আনা ১১৪ টন পেঁয়াজ বন্দরে খালাস হয়েছে এবং মিয়ানমার থেকে আসা ৮৪ টন পেঁয়াজ বন্দরনগরীর পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন আড়তে এসেছে। চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক আসাদুজ্জামান বুলবুল জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে শনিবার মিশর থেকে আনা ৫৮ টন এবং চীন থেকে আনা ৫৬ টন পেঁয়াজ খালাস হয়েছে। সংকট সৃষ্টির পর পেঁয়াজ আমদানিতে ৬৬ হাজার টনের এলসি’র বিপরীতে এসেছে ৬ হাজার টন। আড়তদারদের নেতা ইদ্রিচ বলেন, এখন মিয়ানমার থেকে যে পেঁয়াজ আসছে সেটাই বিক্রি হচ্ছে। শনিবার খাতুনগঞ্জের পাইকারী বাজারে প্রতিকেজি মায়ানমারের ভালো পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছিল ২৩০ টাকায়। কিছুটা নিম্নমানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২১০ টাকায়। খুচরা বাজারে গতকাল পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২৪০ টাকা করে।
গত সেপ্টেম্বরে ভারত আকস্মিকভাবে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয়। মুহূর্তের মধ্যে বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করে। পাইকারিতে কেজিপ্রতি ৩০ টাকার পেঁয়াজ দিনশেষে দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে বিক্রি হতে শুরু করে। আর খুচরা বাজারে সেটা ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
এই অবস্থায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন খাতুনগঞ্জসহ বিভিন্ন পাইকারী ও খুচরা বাজার, আমদানিকারকের আড়তে অভিযান শুরু করে। পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকও করে প্রশাসন। প্রতিবার অভিযানের পর পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৫-১০ টাকা কমলেও এক-দুইদিন পরই তা আবারও বেড়ে যায়। এ অবস্থায় হাল ছেড়ে দিয়েছে প্রশাসনও। বর্তমানে এ পেঁয়াজ যেন গলার কাটা।
অভিযোগ রয়েছে, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন মিয়ানমারের ১২-১৫ জন ব্যবসায়ী। আমদানিকারকদের সঙ্গে কারসাজি করে খাতুনগঞ্জে যেসব কমিশন এজেন্ট ও আড়তদার পেঁয়াজের দাম বাড়াচ্ছে তারা তা বেশি দামে বিক্রি করতে কমিশন এজেন্টদের বাধ্য করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে নৌকায় বাংলাদেশে আসতে বেশি সময় লেগে যাওয়ায় গরমে পেঁয়াজ পচে যাচ্ছে। যেগুলো ভালো থাকছে সেগুলোরও মান কমে যাচ্ছে। এতে আমদানিকারকরা লোকসানে পড়ছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, খাতুনগঞ্জে ১৫ থেকে ২০টি পেঁয়াজের আড়ত আছে। মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ এখানে আসতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লেগে যায়। এরপর আড়তে রাখা পেঁয়াজ দ্রুত পচে যাচ্ছে। প্রতিটি আড়তে প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ বস্তা করে পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে কর্ণফুলী ব্রিজ ঘাট এলাকার স্থানীয়রা জানান, খাতুনগঞ্জ থেকে বস্তাভর্তি পচা পেঁয়াজ কম দামে কিনে কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নদীর পাড়ে শুকাতে দেন। এরপর অধিকাংশ নষ্ট পেঁয়াজ সেখানে ফেলে দেওয়া হয়। তুলনামূলক ভালো পেঁয়াজ ১০০-১২০ টাকায় স্থানীয় হোটেল-রেস্টুরেন্টে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। এদিকে পচা পেঁয়াজ কর্ণফুলী নদীর জীব বৈচিত্র্যের কি ক্ষতি করতে পারে এ ধরনের প্রশ্নের জবাবে নদী বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মজনুরুল কিবরিয়া বলেন, পচা পেঁয়াজ ব্যাপক হারে কর্ণফুলীতে নিক্ষেপের ফলে এ্যামোনিয়া গ্যাসের পরিমাণ বাড়বে। ফলে অঙিজেনের মাত্রা কমে যাবে। এ পরিস্থিতি যেকোন প্রাণীকূল ও জীব বৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

সুত্রঃ আজাদী