করোনায় দেশের শিক্ষাসূচি লন্ডভন্ড , শিক্ষার বেহাল দশা

করোনায় দেশের শিক্ষাসূচি লন্ডভন্ড , শিক্ষার বেহাল দশা
করোনায় শিক্ষাসূচি লন্ডভন্ড, শিক্ষার বেহাল দশা

এম মামুন হোসেন ।।

প্রাণঘাতী মহামারী কড়োনা ছড়ানোয় দেশের শিক্ষাসূচি লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। দেশে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষাস্তরে পড়ুয়া ৫ কোটি শিক্ষার্থী পড়েছে বিপাকে। এক দশক ধরে পূর্বনির্ধারিত শিক্ষাসূচি পুরোটা এলোমেলো হয়ে গেছে। ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও করোনাভাইরাসের কারণে এই পরীক্ষাসূচি স্থগিত রয়েছে। বিলম্বে শুরু হয়েছে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি কার্যক্রম। এইচএসসির ফল প্রকাশ শেষে কলেজ ও বিশ^^বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় শিক্ষার্থীরা। প্রতিবছর যথাযথভাবে সিলেবাস শেষ করেই নেওয়া হয় বিভিন্ন শ্রেণির পরীক্ষা। বিশ^^বিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট নেমে এসেছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ৫ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাসূচি এলোমেলো হয়ে গেছে। অন্যদিকে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির এবারের সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করতে প্রস্তাব যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সরকারপ্রধানের অনুমোদন পেলে এবার প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা নেওয়া হবে না।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা আছে। তবে এরপরও স্বাভাবিক ক্লাসে ফেরার পরিবেশ হবে কি না, সে নিশ্চয়তা নেই। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) সংসদ টেলিভিশনে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ক্লাস সম্প্রচার করা হচ্ছে। একইভাবে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের ক্লাস টেলিভিশন ও বেতারে সম্প্রচার করা হচ্ছে।

ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ৮৪টি দেশে পাবলিক বা এ ধরনের পরীক্ষা বাতিল বা স্থগিত করা হয়েছে।

একাধিক শিক্ষার্থী-অভিভাবক বলছেন, সিলেবাস অনুযায়ী স্কুলে পড়ানো হয়। এরপর প্রত্যেক শিক্ষার্থীই একাধিক প্রাইভেট-কোচিংয়ের দ্বারস্থ হয়। তারপরও ঠিকমতো প্রস্তুতি হয় না। অথচ এবার স্কুল বন্ধ, প্রাইভেট-কোচিং বন্ধ। তারপরও পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। আর স্কুল খোলার পর কোনো রকমে তাড়াহুড়ো করে সিলেবাস শেষ করা হলেও শিক্ষার্থীরা তা আত্মস্থ করতে পারবে না।

করোনার প্রাদুর্ভাবে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে সব বিশ^^বিদ্যালয়। বন্ধ রয়েছে পরীক্ষাও। এমনকি বছরজুড়েই থাকে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের নানা পরীক্ষা। কিন্তু করোনার কারণে সব পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। বেসরকারি বিশ^বিদ্যালগুলোয় সামার সেমিস্টারের ভর্তি প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। জুলাই মাসে এইচএসসির ফল প্রকাশের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়। নভেম্বরে ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু এবার যথাসময়ে ভর্তি প্রক্রিয়া ও ক্লাস শুরু করা সম্ভব হবে না।

এতে করে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত ৩০ লাখ শিক্ষার্থীও সঙ্কটে রয়েছে। অনেক বেসরকারি বিশববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস চালু করেছে। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ^^বিদ্যালয়ে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, শিক্ষার্থীদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা হবে। শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
অতিরিক্ত ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নেবেন বলে তিনি জানান।

টানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে সরকারি ও এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে না হলেও দিশাহারা হয়ে পড়েছে ১০ লাখ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী। বেতনের সঙ্গে প্রাইভেট টিউশনিও বন্ধ হওয়ায় সঙ্কট আরও বেড়েছে। শিক্ষক বলে সমাজে একটা ভিন্ন অবস্থান থাকায় কারও কাছে হাতও পাততে পারছে না, আবার নিজেও চলতে পারছে না। প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক বেতনের বাইরে বেসরকারি শিক্ষকদের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল প্রাইভেট-টিউশনি। কিন্তু করোনার প্রভাবে সেই প্রাইভেটও বন্ধ। তবে রাজধানীতে দু-চারজন শিক্ষক যারা অনলাইনে পাঠদান করাচ্ছে তারা মূলত এমপিওভুক্ত বা ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষক। আর শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির বিষয়ে খুব বেশি সাড়া দিচ্ছে না অভিভাবকরা। ফলে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই তাদের ফান্ড থেকে মার্চ মাসের বেতন দিলেও এপ্রিল মাসের বেতন ও ঈদ বোনাস অনেকটাই অনিশ্চিত। এমনকি সরকারের কাছে বেসরকারি শিক্ষকদের একাধিক সংগঠন প্রণোদনার আবেদন করলেও তাতে সাড়া মেলেনি।

সবচেয়ে বেশি বিপদে রয়েছে নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীরা। দেশে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার নন-এমপিও স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় ১ লাখ ১০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে। যাদের মধ্যে সম্প্রতি ২ হাজার ৬১৫ প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ায় ৩০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর বেতনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী।

বাংলাদেশ নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার বলেন, নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানে এমনিতেই শিক্ষকরা তেমন বেতন পায় না। বেশিরভাগ শিক্ষকই প্রাইভেট-টিউশনি করে। কিন্তু এখন সবই বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিন আমার কাছে শত শত শিক্ষকের আক্ষেপ আর হাঁ-হুতাশের খবর আসে। কিন্তু কিছুই করতে পারছি না। শর্ত শিথিল করে হলেও দ্রুততার সঙ্গে নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবি জানাচ্ছি।

দেশে প্রায় ৫০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ৬ লাখ শিক্ষক কর্মরত। এসব প্রতিষ্ঠান ভাড়াবাড়িতে চলে। আর শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর এসব প্রতিষ্ঠান শতভাগ নির্ভরশীল। টিউশন ফির টাকায়ই বাড়ি ভাড়া, নানা ধরনের বিল ও শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের সন্তানরা পড়ালেখা করায় তারা স্কুল বন্ধের সময়ে কেউ বেতন দিতে পারছে না, আবার কেউ দিতেও চাচ্ছে না। ফলে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে এসব স্কুলের শিক্ষকরা। এরই মধ্যে কিন্ডারগার্টেনের দুটি সংগঠন পৃথকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের কাছে প্রণোদনাও চেয়েছে।

করোনার মধ্যে করুণ অবস্থায় জীবনযাপন করছে ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, ৪ হাজার ৩১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২১ হাজার শিক্ষক থাকলেও বাস্তবে মাদ্রাসার সংখ্যা অনেক বেশি। এর মধ্যে মাত্র ১ হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকদের ২৫০০ টাকা ও সহকারী শিক্ষকদের ২৩০০ টাকা ভাতা দেয় সরকার। তবে চলতি অর্থবছরে এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিতে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ও বরাদ্দ থাকলেও কাজ শেষ করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

দেশে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৫টি। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। তবে কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে এই সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হবে। বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়মিত বেতন-ভাতা পরিশোধ করলেও সমস্যায় আছে ছোট ও মাঝারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। প্রায় ৭৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছে না।

বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, মাঝারি ও ছোট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশ সমস্যায় আছে। কারণ সেমিস্টার পরীক্ষার আগে সাধারণত শিক্ষার্থীরা ফি পরিশোধ করে। কিন্তু করোনার কারণে সেই ফি এখনও পাওয়া যায়নি। ফলে অনেক বিশ^^বিদ্যালয়েই শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন দিতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে। কেউ হয়তো অর্ধেক বেতন দিয়েছে। আমরা এজন্য সরকারের কাছে আর্থিক প্রণোদনা চেয়েছিলাম। কিন্তু সে বিষয়ে এখনও সাড়া মেলেনি।

বিক্রি ও বন্ধ শতাধিক স্কুল : রাজধানী ও আশপাশের অনেক স্কুল মহামারির কারণে কঠিন সময় পার করছে। এসব স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষক তাদের গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছে এবং আর্থিক সমস্যায় দিন পার করছে। এ খাতে জড়িতরা বলছে, গত কয়েক মাসে শতাধিক স্কুল বিক্রি করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সাভারের বাইপাইল এলাকার সৃজন সেন্ট্রাল স্কুল অ্যান্ড কলেজও তার মধ্যে একটি। এখানে রয়েছে প্রায় ১৫০ জন শিক্ষার্থী এবং ১৫ জন শিক্ষক। স্কুলটির চেয়ারম্যান শামীম ইকবাল বলেন, আমি এমন একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। আমার শিক্ষার্থীদের কথা ভাবলে খুব খারাপ লাগে। কিন্তু আমি আর কী করতে পারি? এই স্কুল চালানোর জন্য আমার মাসে ১ লাখ টাকা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি পাচ্ছি না একটি টাকাও। বছিলা এলাকার রাজধানী আইডিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ও রয়েছে বিক্রির তালিকায়। এর পরিচালক ফারুক হোসেন রিপন জানিয়েছেন, ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটিতে ১৭০ জন শিক্ষার্থী এবং ১৫ জন শিক্ষক রয়েছে। তিনি বলেন, বাড়ি ভাড়া ও শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকার বকেয়া আমাকে পরিশোধ করতে হবে।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল বাহার চৌধুরী জানান, প্রায় প্রতিদিনই তারা খবর পান যে স্কুল বিক্রি করে দেবেন মালিকরা। তিনি বলেন, যতদূর আমরা জানি, প্রায় ১০০টি স্কুল বিক্রি করার জন্য চেষ্টা চলছে। যদি সরকার কোনো সহায়তা না দেয় এবং করোনা সঙ্কট আরও বেশি দিন স্থায়ী হয়, তা হলে সারা দেশে আনুমানিক ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে।