জীবনটা যে কত সুন্দর তা নতুন করে বুঝেছি : মাশরাফি

জীবনটা যে কত সুন্দর তা নতুন করে বুঝেছি : মাশরাফি
জীবনটা যে কত সুন্দর তা নতুন করে বুঝেছি : মাশরাফি

ক্রীড়া ডেস্ক ।।

মাশরাফি বিন মুর্তজা । প্রায় দুই দশকের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে অসংখ্য চোট-আঘাতের সঙ্গে লড়েছেন । ডেঙ্গুতে ভুগেছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েছেন। এবার তার পুরো ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা হলো কোভিড-১৯ রোগের সঙ্গে। ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ ক্যারিয়ারে যিনি হয়ে উঠেছেন হার না মানা মানসিকতার প্রতীক, সেই মাশরাফি তুলে ধরলেন তার করোনাকালের দিনলিপি।

অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি : ২০ জুন দুপুরের দিকে পেলাম রিপোর্ট, কোভিড-১৯ পজিটিভ। শুরুতে গা ব্যথা ছিল। তখন শঙ্কা হয়নি, ভেবেছিলাম জিম করার কারণে ব্যথা হচ্ছে। পরে জ্বর হওয়ার পর যা বোঝার বুঝে গেলাম। দ্রুত পরীক্ষা করালাম। ফল আসার আগেই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম। একরকম নিশ্চিতই ছিলাম যে অনাকাঙ্ক্ষিত এই অতিথি চলে এসেছে আমার ঘরে। রিপোর্ট পাওয়ার পর তাই ধাক্কা খাইনি। ভেতরটা একটু খালি খালি লাগছিল, মুহূর্তের জন্য। দ্রুতই সামলে নিয়েছি। করণীয় ঠিক করে নিয়েছি। আইসোলেশনে ছিলাম আগে থেকেই। সেখানেই লম্বা সময়ের বন্দোবস্ত করে নিলাম। এক রুমে বন্দি জীবনের প্রস্তুতি নিতে হলো।

বিষাদময় বিদায় : বাচ্চাদের বিদায় জানালাম ২১ জুন। এর চেয়ে কষ্টের অনুভূতি বুঝি আর নেই। ওদেরকে নিরাপদে রাখতেই এই সিদ্ধান্ত নিতে হলো। ঢাকার বাসায় রাখা ঝুঁকিপূর্ণ হতো। নড়াইল পাঠিয়ে দিলাম। ক্রিকেট খেলতে সফরে যাওয়ার সময় ওদেরকে বিদায় জানানোর অভিজ্ঞতা তো অনেক আছে। এবার পুরো ভিন্ন। দেশেই আছি কিন্তু ওদের কাছে থাকতে পারব না!

বিরক্তিকর বিপত্তি : রাতে ভালো ঘুম হয়নি। শারীরিক অস্বস্তি তো আছেই, সঙ্গে নানা দুর্ভাবনা। ভালো থাকার চেষ্টা করছি। বাসায় যারা আছে, তারাও আমাকে ভালো রাখার চেষ্টায় কমতি রাখছে না। তারপরও রাতের নির্জনতায় অনেক ভাবনা পেয়ে বসে। ঘুম এলো ফজরের নামাজ পড়ার পর। বলছি ২২ জুনের কথা। রাতের ঘুম সব পেয়ে বসেছিল দিনে। ঘুমাচ্ছিলাম টানা। একটু উঠে খেয়ে টেয়ে আবার ঘুম। দুপুরে একটু ঘুম ভেঙে দেখি ফোনে অনেক মিসড কল, অসংখ্য ম্যাসেজ। জানতে পারলাম, সব জায়গায় নাকি খবর ছড়িয়ে পড়েছে, আমার অবস্থা খারাপ, হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে নাকি সিট পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এসব তোলপাড় যখন চলছে, আমি তখন আরাম করে ঘুমাচ্ছি! বাধ্য হয়ে ফেইসবুকে সবাইকে জানাতে হলো যে এসব খবর ভিত্তিহীন, আমি ভালো আছি। ওইদিন সন্ধ্যায় হাসপাতালে গেলাম বটে, তবে স্রেফ এঙ-রে করাতে। যেহেতু আমার অ্যাজমার সমস্যা পুরনো, ডাক্তারের পরামর্শে একটু চেক-আপ করালাম। সেই রিপোর্টও ভালোই এলো।

নতুন থাবা : ছোট ভাই সিজারের কোভিড পরীক্ষার ফল পজিটিভ এলো ২৩ জুন। ছেলেটার নতুন সংসার। এর মধ্যেই দুর্যোগ শুরুর পর নড়াইলে যত ত্রাণ ও সহায়তা কার্যক্রম নিয়েছি, সবগুলোয় সে সক্রিয়ভাবে মাঠে থেকে দেখভাল করেছে। শেষ পর্যন্ত নিজেও আক্রান্ত হলো। ওকে সাহস দিয়ে বললাম, আল্লাহ চাইলে আবার দেখা হবে। দুদিন পর আরেকটা খারাপ খবর এলো আমাদের পরিবারের জন্য। সুমির (স্ত্রী সুমনা হক) যেসব উপসর্গ ছিল, তাতে একরকম নিশ্চিতই ছিলাম, ও আক্রান্ত। ধারণামতোই ওর রিপোর্ট পজিটিভ এলো ২৫ জুন। সব প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা আগেই নেওয়া ছিল। এবার ওর লড়াইও শুরু হলো।

শরীর ও মনের লড়াই : শুরুর কয়েকদিন শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি টের পেয়েছি নানা প্রতিক্রিয়ায়। জ্বর ও গা ব্যথা ছিল। থেকে থেকে ছিল মাথা ব্যথা। দাঁড়ালে বা ঘরে হাঁটাচলা করলে মাথা ঘোরাতো। এসব অবশ্য টুকটাক হওয়ারই কথা ছিল। ডাক্তারের সঙ্গে বলেছি। একগাদা ওষুধ খেতে হয়েছে রোজ, খুবই বিরক্তিকর।

খাবারের স্বাদ চলে গিয়েছিল কয়েক দিনের জন্য। তখন অনেকটা জোর করে খেতে হয়েছে। পরে খেতে হয়েছে বাধ্য হয়ে। ভাত খাওয়া তো বাদই দিয়েছিলাম। কিন্তু কোভিডের কারণে শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে ভাত ও জুস খেতে হয়েছে নিয়মিত। মনটা খুব খারাপ হয়েছে তাতে। অনেক কষ্ট করে ওজন কমিয়েছিলাম। লকডাউন শুরুর পর থেকে ঘরবন্দি সময় কাজে লাগিয়েছিলাম। খাওয়া নিয়ন্ত্রণে এনে, অনেক ঘাম ঝরিয়ে ওজন নামিয়ে এনেছিলাম ৭৮ কেজিতে। গত ৮-৯ বছরে মনে হয় না এতটা কম ছিল আমার ওজন। খুব ফুরফুরে লাগছিল নিজের কাছেই।

বন্ধুত্বের আশীর্বাদ : আমার সম্পর্কে যারা জানেন, সবারই জানা যে বন্ধুরা আমার জীবনের কতটা জুড়ে আছে। ভেবেছিলাম, ওদের নিয়ে নতুন করে বোঝা ও বলার আছে সামান্যই। কিন্তু এবারের বিপদে আবারও উপলব্ধি করেছি, বন্ধুরা আমাকে কতটা ভালোবাসে। আমার রিপোর্ট পজিটিভ হওয়ার আগেই বাবলু চলে এসেছিল বাসায়। শত অনুরোধ, যুক্তি, হুমকি, মানা করেও কোনোভাবেই তাকে বাসা থেকে ঠেলে বের করতে পারলাম না। সে বাসাতেই থাকবে, দেখভাল করবে। কোনো যুক্তি আছে? তাকে বোঝানো দায়। বন্ধুত্ব আসলে যুক্তি মানে না।

একান্ত সঙ্গী ফোন : আরেকটা বড় বন্ধু ছিল আমার ফোন। সিনেমা-নাটক দেখার অভ্যাস আমার নেই ততটা। বরাববরই খেলার ভিডিও বেশি দেখতাম। এবার অনেকটা সময় কেটেছে খেলার নানা ভিডিও দেখেই। গ্রেট ক্রিকেটারদের পুরনো খেলা, ক্লিপ, দারুণ সব পারফরম্যান্স তো সবসময় দেখি। এবার বেশি দেখেছি গ্রেটদের ইন্টারভিউ। ভিভ রিচার্ডস বলুন বা রাহুল দ্রাবিড়, তাদের কথা শুনলে নেশার মতো শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। কত কিছু যে শেখা যায়! ক্রিকেট দর্শন, জীবন দর্শন, অনেক কিছু। টেকনিক্যাল ও স্কিলের অনেক কিছুও জানা যায়। এই বয়সে, ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসেও আরও অনেক শিখতে ইচ্ছে করেছে। জানি না, আমাদের এখনকার তরুণরা কতটা দেখে এসব, কতটা আগ্রহ আর তাড়না ওদের আছে। অবসর সময়ে এসব দেখলে কেবল সমৃদ্ধই হবে ওরা, ক্ষতি নেই কোনো।

সুস্থতার স্বস্তি : উপসর্গ তেমন না থাকায় শনাক্ত হওয়ার ১০-১২ দিন পর ডাক্তার বললেন পরীক্ষা করে দেখতে। তখনও ফল পজিটিভ এলো। কয়েকদিন পর ডাক্তার আবার বললেন। তবে এবার ইচ্ছে করেই দেরি করেছি। খুব ক্লান্তিকর অপেক্ষা। তিন সপ্তাহ হওয়ার পর ১২ জুলাই পরীক্ষা করালাম। ১৪ জুলাই দুপুর থেকেই অপেক্ষা করছিলাম, কখন ফল জানতে পারব। সেই অপেক্ষা শেষ হয় না। অবশেষে সন্ধ্যার পর জানতে পারলাম। একটু অস্বস্তি তবু থেকেই গেল। আমি ও সিজার নেগেটিভ, সুমি পজিটিভ।