তীব্র সুপেয় পানি সংকটে উপকূল

তীব্র সুপেয় পানি সংকটে উপকূল
তীব্র সুপেয় পানি সংকটে উপকূল

পোস্টকার্ড ডেস্ক ।।

দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে । এর ফলে লবণাক্ততা বেড়ে নষ্ট হচ্ছে মিষ্টি পানির আধার। যে কারণে উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। আর ভূগর্ভস্থ পানির অপরিকল্পিত উত্তোলনে এ সংকট আরো প্রকট হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে বিশ্বে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পানির চাহিদা। উন্নত জীবনযাপনের প্রয়োজনেও মানুষের দৈনিক মাথাপিছু পানির চাহিদা বেড়ে চলেছে। কিন্তু নানামুখী অপচয় ও হস্তক্ষেপের কারণে অনেক স্থানে সুপেয় পানির উৎস সংকুচিত, দূষিত ও ধ্বংস হচ্ছে। এসব কারণে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিচ্ছে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এ সংকট সর্বাধিক। ওই এলাকায় গড় হিসাবে ২৫২ জনের জন্য একটি নলকূপ থাকলেও অনেক উপজেলায় নলকূপের অস্তিত্বই নেই। সেখানে পানির জন্য পুকুর বা অন্য জলাশয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। ওই সব এলাকায় সিডর-আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক জলাশয় নষ্ট হয়েছে। ফলে সুপেয় পানির সংকটও বেড়েছে।

ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, নিরাপদ উৎস থেকে পানি সংগ্রহের সুযোগ নেই এমন ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় তিন কোটি মানুষ নিরাপদ পানি সুবিধার বাইরে। যার বেশির ভাগই বাস করে উপকূলীয় ও পার্বত্য অঞ্চলে। বিভিন্ন সংস্থার একাধিক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় আইলাদুর্গত এলাকার ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ বর্তমানে বিশুদ্ধ পানিবঞ্চিত। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি এবং খুলনা জেলার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার ১৯টি ইউনিয়নে বিশুদ্ধ পানির সংকট প্রকট। মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ মানুষ নলকূপের মাধ্যমে পানি পাচ্ছে। অন্যদের পানি সংগ্রহের জন্য গড়ে দুই থেকে ছয় কিলোমিটার পর্যন্ত পাড়ি দিতে হচ্ছে। এখনো ৭৮ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছে না। আর মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ পুকুর নোনা পানিমুক্ত।

বেসরকারি সংস্থা লিডার্সের গবেষণা প্রতিবেদনে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খাবার পানি সংকটের জন্য লবণাক্ততাকে দায়ী করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদীতে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। আর অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষে পুকুর ও অন্যান্য জলাধার লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। সব মিলিয়ে উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট বেড়েছে।

নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বাংলাদেশ ট্রাস্টের কো-অর্ডিনেটর মিজানুর রহমান বিজয় বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সংকটের অন্যতম সুপেয় পানি। উপকূলীয় এলাকায় এই সংকট সর্বাধিক। সেখানে সুপেয় পানির আধার কম। তার ওপর প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেই আধারগুলো নষ্ট হচ্ছে। ফলে সংকট প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলে সিডর, আইলা, নার্গিস, বিজলীসহ পাঁচটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। এতে মিষ্টি পানির আধার নষ্ট হয়ে নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে।

লিডার্সের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মণ্ডল জানান, উপকূলের মানুষকে খাবার পানির জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। খাবার পানি জোগাড় করতে গ্রামের মহিলাদের দুই থেকে ছয় কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। দিনের একটি বড় সময় এর পেছনে ব্যয় হয়। এই সংকট মোকাবেলায় বায়ো সেন্ড ফিল্টার, পিএসএফ (পুকুরপারে বালির ফিল্টার) ও রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং প্লান্ট এবং জলাধার সংস্কার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকেও এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।

তবে এ উদ্যোগ যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবু হেনা মোস্তফা কামাল। তিনি বলেন, উপকূলীয় এলাকায় বিভিন্ন উৎস থেকে সামান্য পরিমাণ সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এ ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা, সমন্বয়হীনতা ও মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে। ফলে এই খাতে বরাদ্দ দেওয়া হলেও তার সুফল পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা। এই সংকট মোকাবেলায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আরো বেশি পদক্ষেপ জরুরি।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;