পড়ে আছে ডাক বাক্স , চিঠি নেই

পড়ে আছে ডাক বাক্স , চিঠি নেই

সাব্বির আহমেদ ।।

হঠাৎ এক সকালে বাড়ির সামনে সাইকেলের টুংটাং শব্দ। ওই চিঠি, চিঠি আছে...বলে রানারের চেনা ডাকাডাকি। তারপর প্রিয়তমা দেখল তার প্রিয় সুদূর প্রবাস থেকে চিঠি লিখেছে। ‘এই যে শুনছো... নাও পত্র, বিনিময়ে দাও প্রেম।’ তখন হলদে খামে ভরা কাগজে মোড়ানো চিঠিতে এভাবেই ভালোবাসার বাক্য বিনিময় হতো। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে এমন আবেগের আমেজ একটু একটু করে দূরে গেছে। ডাকঘরের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে চিঠির জায়গা এখন মেসেঞ্জারের দখলে।
কথাগুলো সবই উনিশ শতকের। প্রতিটি প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয়ের ডাক ছিল ‘চিঠি’। যে চিঠি আসত ডাকঘরে। আর খামেভরা কাগজের চিঠির জন্য মানুষ ডাকঘরের সামনে অপেক্ষা করত ঘণ্টার  পর ঘণ্টা কখন আসবে প্রিয়জনের চিঠি। চিঠি আসতে একটু দেরি হলে রানারের দুয়ারে ছুটত স্বজন কিংবা প্রিয়জন।
দিন পরিবর্তন হয়ে এখন রানারের দেখা মেলা ভার। কালেভদ্রে আসে দুয়েকটা চিঠি। যেখানে থাকে না আগের আওয়াজ আর আন্তরিকতা। এখন সেই ডাকবাক্সগুলোর আবেদন নেই। প্রিয়জনের চিঠির আশায় ডাকপিয়নের পথ চেয়ে থাকার দিনও ফুরিয়েছে।
মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে ই-মেইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইমো ও ভাইবারসহ কত প্রযুক্তির সুবিধা আজ সবার জন্য অবারিত। শহরের তুলনায় পিছিয়ে নেই গ্রামও। গ্রামের মানুষের কাছে এখন এসব সুবিধা পৌঁছে গেছে। কালের বিবর্তনে ডাকঘরের গুরুত্ব হারিয়ে দিনের পর দিন তা জরাজীর্ণ হয়েছে। পড়ে আছে অবহেলায়। বিবর্ণ-হতশ্রী রূপ নিয়েছে গ্রাম-বাংলার ডাকবাক্সগুলো। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে নিয়ে চলছে ডাক সেবার কার্যক্রম। বেশিরভাগ জায়গায়ই নেই ডাকঘর। গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ ডাকঘর দিনের পর দিন বন্ধ থাকছে। অনেক ডাকঘরে নেই কোনো ডাকবাক্স। দুয়েকটি থাকলেও তার মধ্যে চিঠির পরিবর্তে থাকছে বিড়ি, সিগারেটসহ ময়লা-আবর্জনা।
গাজীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম উলুসারার ডাকঘরের লাল ডাকবাক্সটি ভেঙেছে প্রায় ২০ বছর আগে। ডাকঘরের কার্যক্রম চলছে স্থানীয় বাজারের একটি কক্ষে। এ ছাড়া ডিজিটাল ই-সেন্টারের কার্যক্রম চলছে বসতবাড়িতে।
ডাকঘরের পোস্টমাস্টার মোমেনা খাতুন জানান, বর্তমানে চিঠিপত্র জমাদানের ডাকবক্স নেই। সপ্তাহের ৩ দিনই সরকারি চিঠি এলেও আসে না ব্যক্তিগত চিঠি।
খুলনার কয়রা উপজেলা সদরের ডাকঘর ছাড়া সাতটি ইউনিয়নের সবকটিরই নাজুক অবস্থা। উপজেলায় ১৮টি ডাকঘরের মধ্যে আমাদিতে একটি সাব-পোস্ট অফিস রয়েছে। উপজেলার বেদকাশি ডাকঘরের পোস্টমাস্টার বললেন, আমাদের কোনো বেতন নেই, শুধু সম্মানী ভাতা দেয় ১২শ টাকা। যাতে করে আমাদের সংসার চলে না, ফলে বাধ্য হয়ে অন্য কাজ করতে হয়।
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে দিনের পর দিন জরাজীর্ণ ভবনে ঝুঁকি নিয়ে চলছে ডাক সেবার কার্যক্রম। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় ডাকঘরটির দরজা ও জানালাগুলো ভেঙে গেছে। ছাদ ও দেওয়ালের আস্তর খসে  পড়ছে। পোস্টমাস্টারের জন্য বরাদ্দকৃত কোয়ার্টারটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। শৌচাগারে রয়েছে পানির সমস্যা।
উত্তরের জেলা গাইবান্ধার ১০৪টি শাখা ডাকঘরের নিজস্ব কোনো ভবন নেই। ডাকটিকেট, খাম বেচাকেনার কাজ চলে মানুষের বাড়ি ও মুদি দোকানে। অন্যদিকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ডাকঘরের ইডিকর্মীসহ অন্য কর্মচারী। এমনকি তারা বছরের দুই ঈদেও পান না কোনো ভাতা। উলুসারা ডাকঘরে রানারের কাজ করতেন শিহাব উদ্দিন। সংসারের টানাপড়েনে এখন পেশা বদলে স্কুলের সহকারীর কাজ করছেন।
দুই যুগ আগে থেকে সৌদি আরব থাকেন গৃহবধূ প্রিয়সী আক্তারের স্বামী। আগে তার স্বামী আমির উদ্দিন ভাঙা ভাঙা অক্ষরে চিঠি লিখতেন। মাঝেমধ্যে অডিও রেকর্ড করে ক্যাসেট পাঠাতেন। ‘যা চিঠি তুই উড়ে উড়ে যা, আমার প্রেম তুই তার কাছে নিয়ে যা’Ñ স্বামীর পাঠানো এমন আদরমাখা বর্ণগুচ্ছের চিঠিগুলো আজও শোকেসে বন্দি রেখেছেন যত্ন করে।
প্রিয়সী জানান, তার স্বামী একসময় বিবাহবার্ষিকী ও জন্মদিন উপলক্ষে চিঠি লিখতেন। এখন আর চিঠি দেন না। ইমোতে কল দেন সবসময়। সেখানেই সব কথা হয়। তার মতে, এখন চিঠি নেই, পত্র নেই তাই প্রেম হারিয়েছে তার সন্ধি।
১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াকালীন আব্দুস ছামাদের বড় ছেলে চিঠি লিখত প্রিয় বাবার উদ্দেশে। ছেলে নূর মোহাম্মদের চিঠিগুলো তিনি ট্রাঙ্কে পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছেন স্মৃতি হিসেবে। গ্রামের সুলতান মাস্টারের বয়স প্রায় ষাটের কোটায়। এককালে তিনিও চিঠি লিখতেন। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে আসত তার কাছে।
অনুভূতির কথা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, হৃদয়ে অনুরণ তোলা ডাকবাক্সগুলোয় আজ ঘুণে ধরেছে। নিখাদ আবেগ আর ভালোবাসা নেই। এই মোবাইল এসে সব কেড়ে নিয়েছে। আবেগমাখা পুরনো চিঠি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন কবি ও কথাসাহিত্যিক শেলী সেন গুপ্তা।
তিনি বলেন, প্রযুক্তি আবেগকে হারিয়েছে। চিঠির যে সুগন্ধ তা হারিয়ে গেছে। প্রেয়সীর চিঠির ভেতর অনেক সময় গোলাপ ফুল আসত। এসবই এখন অতীত। মা ছেলের চিঠির জন্য জানালার দিকে তাকিয়ে থাকত। চিঠি এখন সঙ্কুচিত হয়ে হয়েছে এসএমএস।
এই সাহিত্যিকের মতে, প্রযুক্তির বলাতে স্থায়িত্ব নেই। চিঠির বলার মধ্যে স্থায়িত্ব ছিল। তাই তিন ক্যাটাগরির ১০০ প্রেম ভালোবাসার চিঠি এক করে বই আকারে বের করবেন। যা একসময় হয়তো সাহিত্য অঙ্গনে উদাহরণ হিসেবে ঠাঁই পাবে। ভালোবাসার চিঠিগুলোর নির্যাস একটু হলেও ধরে রাখতে চান তিনি।
ডাক বিভাগের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সময়ের আলোকে বলেন, ডাকঘরকে ডিজিটাল করার জন্য অনেক প্রজেক্ট চলমান আছে। সরাসরি সুযোগ ভোগের জন্য বিভিন্ন এলাকায় কম্পিউটার, ই-মেইলের আওতায় আনা। ইন্টারনেট সম্পর্কিত সেবার বিস্তার করা। গ্রামাঞ্চলের সীমিত অনলাইন সুবিধাগুলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। ইতোমধ্যে ডাক বিভাগের লেনদেন ডিজিটাল করার জন্য ‘নগদ’ কাজ করছে।
তিনি বলেন, অনেক মানুষই আসলে জানে না। তাদের ধারণা-চিঠিপত্র নাই তো ডাকঘরের প্রয়োজনীয়তা মনে হয় ফুরিয়ে গেছে। আসলে বাস্তবতা মানতে হবে সবাইকে। ব্যক্তিগত চিঠি আমরা কবে লিখেছি, কেউ স্মরণ করতে পারব না।
পাশর্^বর্তী দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পোস্টমাস্টাররা আর্থিকভাবে অবহেলিত উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে ডাক বিভাগের আয় নেই। পোস্টমাস্টারদের বেতন দেওয়া হয় না, এটা সম্মানী। ব্রিটিশ আমল থেকে ডাক বিভাগের এই প্রথা এখনও রয়ে গেছে। এ থেকে এখনও বের হতে পারেনি ডাক। তবে বর্তমান সরকার মাস্টারদের টাকা বাড়িয়েছে।
ডাকঘরের সার্বিক অবস্থা নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সময়ের আলোকে বলেন, প্রযুক্তি এসে ডাকঘরের পুরনো সবই তছনছ করেছে। এখন যোগাযোগের ঐতিহ্যের মাধ্যম হিসেবে কাগজ আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। কাগজভিত্তিক তথ্যের আদান-প্রদান এখন মৃতপ্রায়। তবে বর্তমানে ডাকঘরের বড় সম্পদ হলো দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক। ডাকঘরের সঙ্কট বাড়ছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ডাকঘরকে ডিজিটাল করার যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তা বছর তিনেক আগে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের আদলে ডাকঘরকে ডিজিটাল করার প্রয়াস ছিল। ডাকঘরের কর্মকাণ্ডের চেয়ে উদ্যোক্তাদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল ওই প্রজেক্টে। তবে তা পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। সম্পূর্ণ পরিকল্পনাহীনভাবে কাজ হয়েছে। লজিস্টিক সাপোর্ট দেওয়ার পরও দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনার অভাবে তা ভেস্তে গেছে বলা যায়। প্রকল্পের তদারকিতে নেওয়া একাধিক রিপোর্টের একটিও সম্পূর্ণ ছিল না। গলদ ও বিশৃঙ্খল ছিল নানা অংশে। এখন অসুখ সারাতে পারব কাকে দিয়ে, সেটিই মাথায় আসছে না। আরও ভয়ঙ্কর হলো ডাক বিভাগের পিয়নদের বেতন কাঠামো। যার জন্য ডাক পৌঁছে দেওয়ার পর বকশিসের নামে ঘুষ নেন পিয়ন।
মন্ত্রী বলেন, সর্বোপরি ডাকঘরকে ডিজিটাল করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এর অপার সম্ভাবনা আছে। তা নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।