বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কর্মী হওয়া অনেক কষ্টের ও অনেক গৌরবের!- মিজানুর হক খান

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কর্মী হওয়া অনেক কষ্টের ও অনেক গৌরবের!- মিজানুর হক খান
জার্মানিতে পরিবার নিয়ে সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে অনেকে অনেক বিশেষণে সম্বোধন করেন। কিন্তু তিনি যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা, এটাই তার সবচাইতে বড় পরিচয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করা প্রধানমন্ত্রী তিনি। কিন্তু আমার মনে হয় এই বাংলার একজন দুঃখী মানুষের নাম শেখ হাসিনা।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তার বাবা, মা, ভাই, আত্মীয়-স্বজনকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। পৃথিবীতে অনেক রাষ্ট্রনায়ককে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নিকট আত্মীয়সহ যেভাবে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে, এমন ঘটনা পৃথিবীতে ইতিহাসে বিরল। একটি জাতির আদর্শকে, তার জাতীয় চেতনাকে, জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিলুপ্ত করার জন্যই ইতিহাসের নৃশংসতা হত্যাকাণ্ড। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সময় জাতির জনকের দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে যান।

১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই শেখ হাসিনা তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীর কর্মস্থল জার্মানিতে আসেন। তাদের ইচ্ছা ছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে দেখবেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ই আগস্ট বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হক শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার সম্মানে এক নৈশভোজের আয়োজন করেন। এরপর তারা ওই বাসাতেই রাত্রি যাপন করেন। পরদিন বেলজিয়াম থেকে তাদের প্যারিস যাবার কথা ছিল। বাংলাদেশের সাথে জার্মানির সময় ব্যবধান ৪ ঘণ্টা।

১৫ ই আগস্ট জার্মান সময় রাত ৩:৩০ মিনিটে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী একজন সাংবাদিকের টেলিফোন পান এবং জানতে পারেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের কথা। ঘণ্টা খানেক তিনি বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করে ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত হন। ভোর ৬ তার দিকে সানাউল হকের সাথে কথা হয়। সব শুনে সানাউল হক তাদের বাসায় রাখতে অপারগতা প্রকাশ করেন। হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী সানাউল হককে বলেন আজকেই বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে বেলজিয়াম সীমান্তে পৌঁছানর ব্যবস্থা করতে, সীমান্ত থেকে তাদের জার্মানিতে নিয়ে আসবেন বলে জানান। বিকাল ৪ টার দিকে তারা হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর বাসায় পৌঁছান।

হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর স্ত্রীর কাছ থেকে জানা যায়, তারা তিন তলা একটি বাড়িতে থাকতেন। বাড়ির তিন তলা থেকেই দূরের কান্নার শব্দ পাচ্ছিলেন তারা। সে কি কান্না! ২৪শে আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনা জার্মানিতেই ছিলেন। তখনো পর্যন্ত জানতেন না কতটা লাশের শোক তাকে বহন করতে হবে। আশায় ছিলেন পরিবারের কেউ না কেউ বেঁচে আছে। এই সময় তিনি এতটাই শোকাহত ছিলেন যে কারও সাথে কথা বলা বা কোন সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব ছিল না। হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শেখ হাসিনার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন এবং ১৮ই আগস্ট নিজেই ইন্দিরা গান্ধির সাথে কথা বলেন এবং সার্বিক অবস্থার কথা তাকে জানান। ইন্দিরা গান্ধি তাৎক্ষনিক ভাবেই তাদের ভারতে চলে আসতে বলেন।

২৪ সে আগস্ট ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে একটি বিশেষ বিমানে তারা দিল্লি চলে যান। এ সময় সবাইকে হারানো এই শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে আশ্রয়, নিরাপত্তা দিয়ে সাহস যোগালেন ইন্দিরা গান্ধী। দীর্ঘ ৬ বছর দুঃসহ জীবন কাটিয়ে, তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তির বাংলাদেশ সরকারের বাঁধা ছিন্ন করে ১৯৮১ সালের ১৭ই মে বিকাল ৪ টায় বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বিমান বন্দরে অঝোরে কাঁদলেন এবং লক্ষ লক্ষ নেতা কর্মীকে কাঁদালেন। সেদিন তার পরিবারের সদস্যদের রক্তে রঞ্জিত ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাড়িতে প্রবেশ করতে চাইলেও তাকে নিজ বাড়িতে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। বাসার সামনের রাস্তায় বসেই তিনি পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেন এবং পরিবারের জন্য দোয়া করেন। পরে ছোট ফুপুর বাসায় তিনি আশ্রয় নেন।

১৮ই মে ছোট্ট একটা লঞ্চ ভাড়া করে নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশে রওনা হন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে শুরু হয় শেখ হাসিনার নতুন পথচলা।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নিষ্ঠুরতম রাজনীতির নেতিবাচক কঠোরতম সময় আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। তিনি তখন কর্মীদের হৃদয়ের স্পন্দন। যখন শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে বুক আগলে দাঁড়িয়েছে তার নেতাকর্মীরা। তার ওপর অনবরত হামলা, নির্যাতনের পাশাপাশি চলে হত্যা চেষ্টা।

১৯৭৫ সালের পর শেখ হাসিনা ৭বার জার্মানি সফর করেন। দুইবার বার্লিনে, দুইবার মিউনিখে, দুইবার ফ্রাঙ্কফুর্টে এবং একবার হামবার্গে আসেন। আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে ৭ বারই আমি শেখ হাসিনার খুব কাছেই ছিলাম। তার সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাবার সুযোগ হয়েছিল।

শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম জার্মানিতে আসেন ২৪শে এপ্রিল ১৯৮৯। তার সাথে ছিলনা কোনো নিরাপত্তাবাহিনী। ছিলনা কোন রাজনৈতিক সফর সঙ্গী। তিনি হল্যান্ড থেকে তার ফুপাত বোন শেলি আপা (শেলি জামান) ও তার স্বামী সেলিমউজ্জামানকে সাথে নিয়ে ট্রেনে করে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে আসেন। শেখ হাসিনাকে কাছে পেয়ে আমার মনে হয়েছিল আমাদের প্রিয়জন, পরিবারের আপনজন 'বড় বোন'কে আমরা কাছে পেয়েছি। এই সময় তিনি কোনও হোটেলে ছিলেন না। জার্মান আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের বাসাতেই ছিলেন। সেসময় ফ্রাঙ্কফুর্ট আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতৃবৃন্দের বাসাতেই তিনি গিয়েছেন। খুব অল্প সময়েই স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে তিনি সবাইকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। আমার মনে হয়েছিল কোন নেতা নয়, আমি আমার বড় বোনকে কাছে পেয়েছি। 'আপা' শব্দটি শুধু তার জন্যই। কিছু স্মৃতি মানুষের জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধুর এই কন্যার সঙ্গে কিছু স্মৃতি আমার কাছে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি ফ্রাঙ্কফুর্টে নেতাকর্মীদের স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শহিদ নূর হোসেনের পরিবারের সাহায্যের জন্য একটি তহবিল গঠনের কথা বলেন। এরপর শেখ হাসিনা নিজেই সর্ব প্রথম ১০০ DM (তৎকালীন জার্মান মুদ্রা) সাহায্য দিয়েছিলেন। যা দেখে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণ।

বঙ্গবন্ধু বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে কাছ থেকে দেখে মনে হয়েছিল আমি বঙ্গবন্ধুকেই দেখছি। বাবার মতই বাঙ্গালী জাতীর ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যই তার জন্ম। প্রবাসী বাংলাদেশিদের তিনি অনেক ভালবাসেন। যেখানেই যান নিরাপত্তা বাঁধা অতিক্রম করে ছুটে যান প্রবাসীদের কাছে। কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরেন প্রবাসী শিশুদের। এই দৃশ্য দেখলে মনে হয় তিনি প্রবাসীদের পরিবারেরই একজন। প্রবাসীরাও পাগলের মত তাকে ভালবাসেন। বিদেশের মাটিতে যেখানেই শেখ হাসিনা আসেন নিরাপত্তার কারণে অনেক সময়ই তার কাছে যাওয়া সম্ভব হয় না। তারপরেও শুধু একনজর তাকে দেখার জন্য হাজার হাজার প্রবাসী ছুটে যান এখনো। শেখ হাসিনা প্রবাসীদের গর্ব ও অহংকার। ৮০ ও ৯০ দশকে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের কেউ চিনত না, চিনলেও ভাবত গরীব একটি দেশের নাগরিক। আজ শেখ হাসিনার জন্যই আমরা প্রবাসে মাথা উঁচু করে গর্ব করে বলতে পারি, 'আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশ আজ আর শুধু দারিদ্র, ক্ষুধা ও বন্যা পীড়িত দেশ নয়।'

লেখক: সাবেক সভাপতি বার্লিন আওয়ামী লীগ