বাংলাদেশ ও রানি এলিজাবেথ - এমএকে জিলানী

বাংলাদেশ ও রানি এলিজাবেথ - এমএকে জিলানী
বাংলাদেশ ও রানি এলিজাবেথ - এমএকে জিলানী

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৬১ সালে এবং স্বাধীনতার পর ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এ দুবারের সফরে তিনি এখানকার একাধিক গ্রাম ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে গ্রামীণ নারীদের জীবন বোঝার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি গ্রামবাংলার শিল্প- সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন এবং নৌ- ভ্রমণেও অংশ নেন। বাংলাদেশ সফরকালে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। আর তার সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎ হয়েছিল লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদে। গত বছর বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তিতে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।

১৯৮৩ সালে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ সফরে এসে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বৈরাগীরচালা গ্রাম দেখতে গিয়েছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। সে সময় রানিকে গ্রামের মানুষেরা ‘ঘরের মানুষ’ হিসেবে আপন করে নেন।

যুক্তরাজ্যসহ কমনওয়েলথভুক্ত ১৫টি দেশের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ গত বৃহস্পতিবার ৯৬ বছর বয়সে মারা যান। তিনি টানা ৭০ বছর ব্রিটিশ সিংহাসনে আসীন ছিলেন, যা ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসে রেকর্ড। তার ব্রিটিশ সিংহাসনে আরোহণের ৭০ বছর পূর্তি উদযাপন করা হয় চলতি বছরের জুনে। বাংলাদেশের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল তার। তিনি দুবার ঢাকা সফর করেন। এসব সফরে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি রানির গভীর ভালোবাসা প্রকাশ পায়। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের এক সফর উপলক্ষে তার সম্মানে ১০ টাকা মূল্যের একটি স্মারক ডাক টিকেট প্রকাশ করে বাংলাদেশ।

সর্বপ্রথম ১৯৬১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান আমলে ঢাকায় এসেছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। সে সময় তার স্বামী প্রিন্স ফিলিপও সফরসঙ্গী হিসেবে ঢাকায় আসেন। তখন ঢাকার রমনা পার্কের রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধায় রানির থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ওই ভবনটি এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণ ও পড়াশোনার জন্য ফরেন সার্ভিস একাডেমি হিসেবে পরিচিত। ওই সফরে রানি এলিজাবেথ বুড়িগঙ্গা নদীতে স্টিমারে চড়ে নৌবিহার করেন। বুড়িগঙ্গা নদীর দুই পারে তখন হাজার হাজার মানুষ হাত নেড়ে এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালের ১৪ থেকে ১৭ নভেম্বর চার দিনের সফর করেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তখন তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও গাজীপুরের দুটি গ্রাম পরিদর্শন করেন। 

এ সফরকে সফল করতে তখন ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিল ঢাকা। তখন রানিকে অভ্যর্থনা জানাতে রাজধানীর কুর্মিটোলার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার সড়ক ব্যানার দিয়ে মোড়ানো হয়েছিল। ব্যানারে লেখা ছিল ‘বাংলাদেশ- যুক্তরাজ্য বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক’। তখন রানির সম্মানে ১০ টাকার স্মারক ডাক টিকেটও প্রকাশ করেছিল সরকার। ওই সফরে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে ফুল দিয়ে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন রানি।

ওই সফরে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বৈরাগীরচালা গ্রাম দেখতে যান। ঢাকা থেকে রেলে চড়ে শ্রীপুর, সেখান থেকে গাড়িতে করে বৈরাগীরচালায় যান তিনি। রানির আগমন উপলক্ষে গাজীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম বৈরাগীরচালায় তখন ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। খুব অল্প সময়ে ওই গ্রামে পাকা সড়ক নির্মাণসহ গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ ঘটানো হয় এবং একটি হাসপাতালও নির্মাণ করা হয়, উদ্বোধন করেন রানি। তিনি বৈরাগীরচালা প্রাথমিক স্কুল পরিদর্শন করেন। রানি ওই গ্রামে গিয়ে গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলে সেখানে পুকুর থেকে মাছ শিকার করাসহ তাকে গ্রাম ঘুরিয়ে আরও অনেক কিছু দেখানো হয়। সে সময় রানিকে গ্রামের মানুষেরা ‘ঘরের মানুষ’ হিসেবে আপন করে নেন। ঘরের বাসিন্দা হিসেবে রুপার তৈরি প্রতীকী চাবি রানির হাতে তুলে দিয়ে গ্রামবাসী বলেছিল, তিনি এ গ্রামের প্রতিটি ঘরের মানুষ। যখন ইচ্ছা তিনি যেন এ গ্রামে ভ্রমণ করেন।

ওই সময় রানির রাজকীয় সফর শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না, ট্রেনে চড়ে তিনি চট্টগ্রামেও একটি মডেল গ্রাম দেখতে যান। সেই সফরে ধান থেকে মুড়ি বানানোর প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করেন তিনি। এ ছাড়া হাতে তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্যের প্রস্তুতপ্রণালিও দেখেন তিনি। এ সফরে ঢাকার ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ কার্যালয় পরিদর্শন করেন রানি।

এদিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রনেতা হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের কারণে ওই সাক্ষাৎ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। ব্রিটেনের দীর্ঘতম সময়ের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সিংহাসনে ৭০ বছর পূর্তি প্লাটিনাম জুবিলি উদযাপন অনুষ্ঠানমালা ছিল চলতি বছরের ২ থেকে ৫ জুন। এ উদযাপনের একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠকন্যা শেখ রেহানা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে গত বছর শুভেচ্ছা বার্তায় বাংলাদেশের জনগণকে শুভেচ্ছা জানিয়ে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ বলেন, ‘আমরা বন্ধুত্ব এবং স্নেহের বন্ধন ভাগ করি, যা আমাদের অংশীদারত্বের ভিত্তি হিসেবে রয়ে গেছে এবং এটি পঞ্চাশ বছর আগের মতো আজও গুরুত্বপূর্ণ।’

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ যখন স্বাধীন বাংলাদেশ সফর করেন তখন সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং সেনা কর্মকর্তা মো. শহীদুল হক সেনাবাহিনীর তরুণ কর্মকর্তা ছিলেন। মো. শহীদুল হক তখন সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট পদে সাভারে কর্মরত ছিলেন। শুক্রবার সময়ের আলোকে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার প্রায় ১২ বছর পর ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ বাংলাদেশ সফর করেন। তখন তার এ সফর নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল ছিল। রানি তখন রেলগাড়িতে চড়ে গাজীপুরের একটি গ্রাম দেখতে যান। সাবেক সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। ওই সময়ে রানির সম্মানে এরশাদও রেলগাড়িতে গাজীপুর যান। 

রেলগাড়িটির নাম ছিল বলাকা, যা বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়। গ্রামের মানুষজন তখন রানিকে বলেছিল তাদের যাতায়াতের জন্য রেলগাড়িটি দিয়ে দিতে। তখন রানি রাষ্ট্রপতি এরশাদকে রেলগাড়িটি ওই অঞ্চলের মানুষকে দিয়ে দেওয়ার জন্য বললে দীর্ঘদিন বলাকা নামে রেলগাড়িটি ঢাকা- গাজীপুরে চলাচল করেছে।’

খালেদ / পোস্টকার্ড ;