মজুদ রেখেই ২৪ চাল ব্যবসায়ী বাজার থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা

মজুদ রেখেই ২৪ চাল ব্যবসায়ী বাজার থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা
মজুদ রেখেই ২৪ চাল ব্যবসায়ী বাজার থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন।।

 

চালের বাজার করোনোভাইরাস আতঙ্কে এক সপ্তাহ ধরে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠেছে । বস্তাপ্রতি চালের দাম অন্তত ৫শ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে নগরীর চাক্তাই ও পাহাড়তলী বাজারের ২৪ ব্যবসায়ী-আড়তদারের নাম ওঠে এসেছে। এসব নিয়ন্ত্রক ব্যবসায়ীরা এক সপ্তাহে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বাজার থেকে। একাধিক সূত্রে এসব ব্যবসায়ীদের নাম এসেছে। তবে ব্যবসায়ী নেতাদের দাবি, দেশের চালের বাজার উত্তরবঙ্গের মিলার ও মজুদদারদের নিয়ন্ত্রণে।

চট্টগ্রাম রাইস মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘চালের মূল্যবৃদ্ধিতে চট্টগ্রামের মিলারদের কোনো কারসাজি নেই। উত্তরবঙ্গের মিলার ও মজুদদাররা কারসাজি করে চালের দাম বাড়িয়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে সারাদেশের চালের বাজারে।’ বাজারে ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়ায় কিছু ব্যবসায়ী দাম বাড়িয়েছে বলে জানান তিনি।

চট্টগ্রামে চালের সবচেয়ে বড় মোকাম হচ্ছে চাক্তাই ও পাহাড়তলী বাজার। এই দুটি বাজার থেকেই চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থানে চাল সরবরাহ করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাক্তাইয়ে আট ব্যবসায়ী-আড়তদার ও ৬ মিলারের কাছে প্রচুর চাল মজুদ ছিল। উত্তরবঙ্গের মিলার ও চাল মজুদদারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চট্টগ্রামের বাজারও অস্থির করে তুলেছে তারা। তাদের মধ্যে অনেকের রয়েছে একাধিক গুদাম। ব্যবসায়ীভেদে গুদামে গুদামে ২০ থেকে ৫০ হাজার বস্তা পর্যন্ত চাল মজুদ থাকে। চাক্তাই এলাকার আড়াই শতাধিক দোকান অনেকটা তাদের নিয়ন্ত্রণে। তাদের কাছ থেকে চাল কিনে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন এসব ব্যবসায়ীরা।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মক্কা এন্টারপ্রাইজ, আল্লাহর দান, হাজি মাহমুদুল হক, চৌধুরী রাইস এজেন্সি, মক্কা ট্রেডার্স, মক্কা রাইস এজেন্সি, দরবার স্টোর, গফুর এন্ড সন্স-এসব বড় ব্যবসায়ীদের হাতে রয়েছে চাক্তাইয়ের চাল ব্যবসা। এছাড়াও চাল মিল মালিকদের মধ্যে আশা ও বি. বাড়িয়া রাইস মিল, রফিক উল্লাহ অটো রাইস মিল, ইসহাক রাইস মিল, কর্ণফুলী অটো রাইস মিল, শাহ আমানত অটো রাইস মিল, ইউনিট অটো রাইস মিলও চালের বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে। এই ছয় রাইস মিলের অনেকের বড় গুদাম রয়েছে। এসব গুদামে প্রচুর ধান-চাল মজুদ থাকে। সুযোগ মতে তারাও বাজার অস্থির করে তোলে।

চট্টগ্রাম চাল মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম বলেন, হঠাৎ করে চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে দাম কিছুটা বেড়েছে। এছাড়াও মৌসুমের শেষ পর্যায়ে এসে ধানের দাম মণপ্রতি দেড় থেকে দুইশ টাকা বেড়েছে। এতে চালের দামও কিছুটা বেড়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চাক্তাইয়ের ব্যবসায়ীরা এক-দুই দিন বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। উত্তরবঙ্গের ব্যবসায়ীদের হাতে পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা রযেছে।

পাহাড়তলী বাজারে রয়েছে ১০ ব্যবসায়ী-মিল মালিক। এরমধ্যে কয়েকজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে খাদ্য বিভাগের চাল নিয়ে নয়-ছয়ের অভিযোগ রয়েছে। এক ব্যবসায়ীর কাছে প্রায় ৫০ হাজার বস্তা চাল মজুদের অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার কাছে তার নাম রয়েছে। বাজার অস্থিরতার নেপথ্যে রয়েছে খাজা ভান্ডার, আল্লাহর দান, এয়াকুব আলী ট্রেডাস ও মাহী ট্রেডার্স। চারটি দোকানই হচ্ছে এক ব্যবসায়ীর। তার কাছে প্রচুর খাদ্যশস্য মজুদ থাকে। সরকারি খাদ্য বিভাগের চাল নিয়েও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও এ কে ট্রেডার্স, ফারুক ট্রেডার্স, হাজি আমিনুল হক সওদাগর, অগ্রণী স্টোর, শাহ জালাল স্টোর, পূর্বাণী স্টোর ও হক রাইসের নিয়ন্ত্রণে থাকে চালের বাজার। কয়েকজনের বিরুদ্ধে সরকারি ডিও বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। কয়েকজন ব্যবসায়ীর রয়েছে একাধিক গুদাম। এসব গুদাম ২০-৫০ হাজার বস্তা পর্যন্ত মজুদ রাখা হয়। তবে দু-একজনের আবার তারচেয়েও বেশি পরিমাণ চাল মজুদের ধারণক্ষমতার গুদাম রয়েছে।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক সপ্তাহের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। বিশেষ করে গরিব ও মধ্যবিত্ত চাল বলে খ্যাত মোটা আতপ ও সিদ্ধ চালের দাম বেশি বেড়েছে।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, এক সপ্তাহের ব্যবধানে মোটা আতপ চাল মানভেদে ১৩-১৪ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৭-১৮শ টাকায়। মোটা সিদ্ধ ১৪শ-১৪৫০ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৮শ টাকায়। বেতি-২৯ চাল ১৭শ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৩শ টাকায়। বেতি-২৮ চাল ১৮৯০ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৪শ টাকায়। মিনিকেট আতপ দুই হাজার টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৫শ টাকায়। মিনিকেট সিদ্ধ বিক্রি হচ্ছে ২৩-২৪শ টাকা। জিরাশাইল ২৩শ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৬শ টাকায়। নূরজাহান সিদ্ধ ১৫শ টাকা থেকে বেড়ে দুই হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে দেশের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে আসছে উত্তরবঙ্গের চাল মিল মালিক ও আড়তদাররা। বিশেষ করে নওগাঁ, দিনাজপুর, আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সান্তাহার (বগুড়া), রাজশাহী, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন জেলায় তিন শতাধিক চাল মিল ব্যবসায়ী রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ৩০ জন বড় মিল মালিক ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ধান চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন।

চট্টগ্রামের বড় পাইকারি বাজার পাহাড়তলী ও চাক্তাই ব্যবসায়ীরা জানান, নওগাঁ, মহাদেবপুর, আশুগঞ্জ, দিনাজপুর, পাবনা, ঈশ্বরদীর মোকামগুলো থেকে বেশিরভাগ চাল আসে চট্টগ্রামে। আশুগঞ্জ থেকে বেতি, ইরি জাতের, দিনাজপুর থেকে মিনিকেট, পাইজাম, চিনিগুড়া, কাটারিভোগ চাতের আতপ এবং নওগাঁ, পাবনা, ঈশ্বরদী থেকে সিদ্ধ জাতের চাল আসে এখানে।সূত্র.পূর্বকোণ