রুম্পা ‘হত্যার’ প্রতিবাদে সোচ্চার স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা, কারণ খুঁজছে পুলিশ

রুম্পা ‘হত্যার’ প্রতিবাদে সোচ্চার স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা, কারণ খুঁজছে পুলিশ

আলমগীর হোসেন ।।

রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার করুণ মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী শিক্ষার্থীরা। রুম্পাকে ‘হত্যার’ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে শুক্রবার রাজধানীর বেইলি রোড-সিদ্ধেশ^রী এলাকায় বিক্ষোভ-মানববন্ধন করেছেন সহপাঠী ও শিক্ষকরা। ব্যানার, ফেস্টুনসহ নানা স্লোগানে প্রতিবাদ জানান তারা। এ ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বইছে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড়। তবে শুক্রবার রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুলিশ জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন জড়িতদের শনাক্ত করার লক্ষ্যে রুম্পা হত্যা মামলাটি নিয়ে থানা পুলিশের বাইরেও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট কাজ করছে। রুম্পার লাশ উদ্ধারের স্থান তথা সিদ্ধেশ^রীর বিভিন্ন পয়েন্টের বাসা-বাড়ির সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেও সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে।

রুম্পা সিদ্ধেশ্বরীর ওই এলাকায় কেন গেলেন বা কার কাছে গিয়েছিলেন এসব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর বাইরেও পারিবারিক, ক্যাম্পাস, ব্যক্তি জীবন সম্পর্কেও খোঁজখবর নিচ্ছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। শুক্রবার শারমিনের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের সদর উপজেলার বিজয়নগরে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রমনা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জহিরুল ইসলাম বলেন, রুম্পার লাশ উদ্ধারের পর পরিচয় শনাক্ত হলে এ ঘটনায় রমনা থানায় অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে হত্যা মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত হিসেবে শুক্রবার রাত ৮টা পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার বা আটক করা যায়নি। তবে নিহতের পরিচয় যখন পাওয়া গেছে, শিগগিরই এ ‘হত্যাকাণ্ডের’ রহস্য উদ‌ঘাটন করা যাবে বলে আশা করা যায়। জহিরুল ইসলাম বলেন, সিদ্ধেশ্বরীর যে স্থান থেকে রুম্পার লাশ উদ্ধার করা হয় সেখানের সামনের কোনো ভবনে সিসি ক্যামেরা ছিল না। পেছনের একটি ভবনে সিসি ক্যামেরা থাকলেও দূরত্বের কারণে তা ‘কাভার’ করে না। তবে আশপাশের অন্য সম্ভাব্য বা প্রয়োজনীয় বাসা বাড়ির সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে যাচাই করা হবে। এর বাইরেও রুম্পার ক্যাম্পাসের শিক্ষাজীবন, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত বিষয়গুলো জানার চেষ্টা চলছে। সবমিলে এ ঘটনাটি ব্যাপক গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছে পুলিশ।

জানা যায়, স্টামফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী রুম্পা এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে বড়। মা ও ছোটভাইয়ের সঙ্গে সপরিবার শান্তিবাগের ২৫৫ নম্বর বাসায় থাকতেন। তার বাবা পুলিশ পরিদর্শক রোকনউদ্দিন হবিগঞ্জের একটি পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত। রুম্পা পড়াশোনার পাশাপাশি দুটি টিউশনিও করতেন। বুধবার সন্ধ্যায় টিউশনি শেষে বাসায় ফিরে কাজ আছে বলে আবার বাসা থেকে বের হন। বাসা থেকে নিচে নেমে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও পরিহিত স্যান্ডেল বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে এক জোড়া পুরনো স্যান্ডেল পায়ে দিয়েই তিনি বেরিয়ে যান। এরপর রাতে আর বাসায় ফিরে আসেননি। স্বজনরা বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও তার সন্ধান পাননি। পরে খবর পেয়ে শারমিনের মাসহ স্বজনরা রমনা থানায় গিয়ে লাশের ছবি দেখে রুম্পাকে শনাক্ত করেন। এর আগে বুধবার রাতে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় দুই ভবনের মাঝখানের গলি থেকে রুম্পার লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে লাশটি অজ্ঞাত হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে রাখা হয়। পুলিশের ধারণা, তাকে ভবনের ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়, তরুণীর মেরুদণ্ড, বাঁ হাতের কনুই ও ডান পায়ের গোড়ালি ভাঙা। মাথা, নাক, মুখে জখম এবং রক্তাক্ত অবস্থা ছিল। বুকের ডান দিকে ক্ষত চিহ্ন রয়েছে।

রমনা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম বলেন, রুম্পার মৃত্যু কীভাবে হয়েছে এবং কীভাবে সেখানে তার লাশ পড়ে থাকল এসব বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তের আগে ধারণা করে কিছু বলা যাচ্ছে না।

এদিকে শুক্রবার শারমিনের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের সদর উপজেলার বিজয়নগরে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে। তার আগে বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে রুম্পার লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়। এ বিষয়ে ঢামেক ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, লাশের শরীরে আঘাত দেখে ধারণা করা হচ্ছে ওপর থেকে পড়ে তার মৃত্যু হয়েছে। তবে কেউ তাকে ওপর থেকে ফেলে দিয়েছে কি না বা মৃত্যুর আগে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে। সেই প্রতিবেদন পেলেই এ বিষয়গুলো নিশ্চিত হওয়া যাবে।

তোদের মনে মায়া দয়া নেই

একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে রুম্পার বাবা-মা দুজনই এখন শোকে বিহ্বল। বাবা রুকন উদ্দিন নিজেকে সামলে নিতে পারছেন না কোনোভাবেই। বারবার ছুটে যাচ্ছেন মেয়ের কবরের পাশে। অসহায় বাবার অশ্রুতে কবরের মাটিও ভিজে উঠছে। অপরদিকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন রুম্পার মা নাহিদা আক্তার। আর্তনাদ করছেন আর সন্তান হারানোর বেদনায় মুষড়ে পড়েছেন। কান্না যেন থামছেই না।

কিছু বলতে চেয়েও যেন পারছেন না। হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, ‘তোরা এত্ত খারাপ’ তোদের মনে মায়া দয়া নেই। তোরা কোনো মায়ের পেট থেকে পড়িসনি, তোদের বিচার যেন দেইখ্যা যাইতে পারি। রুম্পার মায়ের বুকফাটা এমন হাহাকার গ্রামবাসীর বুকেও যেন হাতুড়ি মারছে।

নিহত রুম্পার চাচা নজরুল ইসলাম বলেন, রুম্পা টিউশনি শেষে বাসায় ফিরে ফের বের হওয়ার সময় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া তার এক চাচাতো ভাইকে ফোন করে বাসার নিচে স্যান্ডেল আনতে বলে। পরে সে স্যান্ডেল নিয়ে এলে পায়ের হিল খুলে স্যান্ডেল পরে রুম্পা। এরপর সেই ভাইয়ের কাছে রুম্পা কানের দুল, মোবাইল, ঘড়ি, হিল জুতা ও টাকাসহ ব্যাগ দিয়ে দেয়। সেগুলো ওপরে নিয়ে যেতে বলে তাকে। একই সঙ্গে মাকে বলতে বলে, তার আসতে দেরি হবে। প্রশ্ন হচ্ছে কেন সে এগুলো রেখে যাবে? আত্মহত্যার পরিকল্পনা? তা হলে তো বাড়ির ছাদ আছে। ওখানে যাবে কেন? নাকি কোনো ঝামেলা ছিল, তাই এগুলো রেখে গিয়েছিল? এসব ভালো করে তদন্ত করতে হবে।

প্রতিবাদ বিক্ষোভ মানববন্ধন : শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধেশ্বরী মূল শাখার শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বেইলি রোড হয়ে ভিকারুননেসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে যান। সেখানে তারা জড়ো হয়ে মানববন্ধন করেন। এ সময় তারা রুম্পা হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন। আধা ঘণ্টাব্যাপী ওই মানববন্ধনে শতাধিক শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকরা অংশ নেন। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমেও অনেকেই রুম্পার এমন করুণ মৃত্যুর প্রতিবাদ জানিয়ে নানা স্টাটাস দেন। এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে ব্যাপক নিন্দা ও প্রতিবাদ অব্যাহত আছে।