'নিখোঁজ জিডি' তদন্তে অনীহা কেন পুলিশের?

'নিখোঁজ জিডি' তদন্তে অনীহা কেন পুলিশের?

নিজস্ব প্রতিবেদক।।

মানুষ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন কোনো স্বজন নিখোঁজ হলে, কিংবা কোনো কিছু হারিয়ে গেলে। আর থানা পুলিশ তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রমেরও জিডি করেন। সাধারণ মানুষের জিডির তদন্তে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশের অনীহা কাজ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, কাজের চাপে হারিয়ে যাওয়া ছোটখাটো কিছু বিষয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্ব কম দেওয়া হলেও কোনো ব্যক্তির নিখোঁজের বিষয়ে জিডি হলে সেটি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হয়। সন্ধানের চেষ্টা করা হয়। সবক্ষেত্রে সাধারণের অভিযোগ সঠিক নয়। অপরদিকে, মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, কোনো ব্যক্তি নিখোঁজের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স¤পৃক্ততার অভিযোগ থাকলে তদন্তের ধারা বদলে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলোর দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা কিংবা সফলতা দেখতে পাওয়া যায় না।

শেখ মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন তপু। রাজধানীর রামপুরা থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। তপু নিখোঁজ হন ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি রাতে। ওই রাতে বাড্ডার একটি বাসা থেকে কয়েকজন সাধারণ পোশাকধারী ব্যক্তি তাকে তুলে নিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে না পেয়ে ২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি ভাটারা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। দু’দিন পর ১ ফেব্রুয়ারি (২০১৬) অপহরণের অভিযোগ এনে একটি মামলা করেন তার মা সালেহা বেগম। ওই বছরের ৮ ফেব্রæয়ারি ছেলের সন্ধান চেয়ে তপুর মা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেদিন তিনি তার ছেলেকে তুলে নেওয়ার বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু গোয়েন্দা পুলিশ কিংবা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউই তাকে তুলে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেনি। তার সন্ধানও দিতে পারেনি তারা। তপুর নিখোঁজের দীর্ঘ ৫ বছর পার হতে চলেছে। আজও অপেক্ষায় আছেন তার মা ও স্বজনরা।
ছাত্রলীগ নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন তপুর নিখোঁজের বিষয়ে জানতে চাইলে তার মামা ও বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের নেতা ইঞ্জিনিয়ার নূর নবী পাঠান বলেন, ‘ভাগিনার সন্ধানে সহযোগিতা চাইতে আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে অন্তত ৩৫ বার দেখা করেছি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি তিন দফায়। তিনি সংশ্লিষ্টদের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশও দিয়েছেন। কিন্তু তপুর সন্ধান পাইনি আজও। অপেক্ষায় আছি। বর্তমানে তপুর নিখোঁজ ও অপহরণের মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করছে। তাদের মধ্যেও গাছাড়া ভাব’।

এক সময় বঙ্গবন্ধুর দেহরক্ষী ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট (অব.) কাজী আবদুল মতিন। তার ছেলে কাজী রকিবুল হাসান শাওন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পরে তিনি যুবলীগ করতেন। ২০১৪ সালের ২৯ মার্চ ভোরে কুমিল্লা শহরের মুন্সেফ কোয়ার্টারের বাসা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। এরপর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন তিনি। ঘটনার দু’দিন পর ৩১ মার্চ শাওনের স্ত্রী ফারজানা আক্তার কুমিল্লা কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। পরের মাসে ২৭ এপ্রিল (২০১৪) কুমিল্লার আদালতে শাওনের মা আনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে র‌্যাব ১১ এর ১৫ সদস্যের বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগে মামলা করেন। শাওনের বাবা কাজী আবদুল মতিন ছেলের সন্ধানে হাইকোর্টেও রিট করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সাবেক রেলমন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ র‌্যাব-পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কিন্তু ছেলের সন্ধান পাননি এখনও। তিনি বলেন, ‘আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সাবেক সেনা সদস্য। অথচ আজও আমার ছেলের সন্ধান পেলাম না। শাওনের একমাত্র মেয়ের বয়স এখন ১১ বছর। মেয়েটি এখনও বাবার অপেক্ষায় আছে’।

২০১৬ সালের ৪ আগস্ট সাতক্ষীরার কুকড়ালি গ্রাম থেকে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক শেখ মোখলেছুর রহমান জনিকে আটক করে পুলিশ। এরপর ৫, ৬ ও ৭ আগস্ট জনিকে থানায় গিয়ে ভাতও খাইয়ে আসেন তার মা এবং স্ত্রী। কিন্তু পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থাতেই ৮ আগস্ট থেকে জনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। জনির স্ত্রী জেসমিন নাহার থানা থেকে তার স্বামীর নিখোঁজের বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা সদর থানার পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, জনি থানায় নেই। তিনি কোথায় আছেন সেটাও তারা জানেন না। এ ঘটনায় থানা পুলিশের সহায়তা না পেয়ে জনির বাবা শেখ আবদুর রাশেদ হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। হাইকোর্ট বিষয়টি খতিয়ে দেখতে নির্দেশও দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো সন্ধান মেলেনি আজও। এ বিষয়ে পুলিশেরও কোনো তৎপরতা নেই।

নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান চেয়ে জিডি বা মামলার তদন্তে পুলিশের অনীহার অভিযোগটি ভিত্তিহীন বলে মনে করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা বলেন, কে কি বললো সেটা বিষয় না। আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধানে কার্যক্রম চালাই।

নাটোর জেলার নলডাঙ্গা থানার স্বরকুতিয়া গ্রামের মো. শামীম রেজা ওরফে স্বপন (৩৫) নামের এক এনজিও কর্মী নিখোঁজ হন চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর। তিনি স্থানীয় দ্বীপ শীখা নামের একটি এনজিও থেকে সকাল ৯ টায় ঋণের টাকা কালেকশনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আর ফিরে আসেননি। তার বিষয়ে স্বজনরা গত ১ অক্টোবর নাটোর থানায় জিডি করেন। - পূর্বদেশ ।