সন্দ্বীপসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তে জেগে ওঠেছে নতুন চর, নতুন চরের জীববৈচিত্র্য

সন্দ্বীপসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তে জেগে ওঠেছে  নতুন চর, নতুন চরের জীববৈচিত্র্য
সন্দ্বীপে জেগে ওঠা চরে অবাধে বিচরণ করছে পশুপাখি।

সারোয়ার সুমন ।।

চরের মায়াকে পল্লিকবি জসীমউদ্দীন তার বালুচর কবিতায় এভাবেই তুলে লিখেছেন,'উড়ানীর চর উড়ে যেতে চায়/হাওয়ার টানে/চারিধারে জল করে ছল ছল/কি মায়া জানে'- । কবি বলছেন, জীবনের জটিলতা, কুটিলতা সেভাবে স্পর্শ করে না চরের মানুষদের। কোনোভাবে দু'মুঠো ভাত জোটানো ছাড়া তাদের চোখে বড় কোনো স্বপ্নও থাকে না। দিনে কঠোর পরিশ্রম, রাতে ঘুম- চরের মানুষের যেন নিত্যদিনের রুটিন। কবির এ কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া গেল সাগরবেষ্টিত সন্দ্বীপের চারপাশে জেগে ওঠা নতুন চরে গিয়ে। চরের বিস্তীর্ণ ভূমিতে কেউ কৃষিকাজ করছেন, কেউ পালন করছেন পশু। নতুন এই ভূমি সমৃদ্ধ হচ্ছে জীববৈচিত্র্যেও। নানা জাতের পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকছে চর। বেড়েছে অতিথি পাখির আনাগোনাও। নতুন চর জেগে ওঠা কক্সবাজারের মহেশখালীতে তিন প্রজাতির কচ্ছপ পাওয়া গেছে, যেগুলো আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) 'ক্রিটিক্যালি এনডেনজারড' তালিকাভুক্ত। মহেশখালীর সোনাদিয়া এলাকাকে তাই প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়েছে। তবে সন্দ্বীপের চারপাশে জেগে ওঠা নতুন চরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এমন কোনো ঘোষণা আসেনি এখনও।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও আইইউসিএনের সাবেক কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ইশতিয়াক উদ্দিন আহমদ চৌধুরী বলেন, নতুন চরে অনেক নতুন প্রাণের অস্তিত্ব পাচ্ছি আমরা। বিভিন্ন ধরনের পশু-পাখি নতুন চরে নিজেদের মতো থাকার চেষ্টা করে। তাদের এ চেষ্টার পথে আমরা যেন বাধা হয়ে না দাঁড়াই। তিনি বলেন, উন্নয়ন করতে গিয়ে জীববৈচিত্র্যের দিকেও নজর দিতে হবে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে কোনো উন্নয়ন হলে সেটি টেকসই হয় না।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসাইন বলেন, নতুন চরের জীববৈচিত্র্য রক্ষার ব্যাপারে এখনও কোনো বিশেষ নির্দেশনা পাইনি আমরা। পেলে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে কক্সবাজারের মহেশখালীতে পরিবেশের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে পরামর্শ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। জীববৈচিত্র্য ঠিক রেখে মহেশখালীর নতুন ভূমি ব্যবহার করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ইতোপূর্বে মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শক টিমও পাঠিয়েছে। পরিদর্শন শেষে ওই কমিটি তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দেশের সার্বিক উন্নয়নে মহেশখালীতে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ জরুরি। তবে স্থাপনা নির্মাণ করতে গিয়ে পরিবেশের বিষয়টিও বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এ জন্য মহেশখালীর সোনাদিয়া এলাকাকে ইসিএ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া রয়েছে। মহেশখালীতে তিন প্রজাতির কচ্ছপ দেখা গেছে, যেগুলো আইইউসিএনের 'ক্রিটিক্যালি এনডেনজারড' তালিকাভুক্ত। এ জন্য মহেশখালীতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় প্রবহমান কোনো গভীর চ্যানেল যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকেও নজর রাখতে বলেছে কমিটি।

কক্সবাজার জেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নে সোনাদিয়া অবস্থিত। এর আয়তন সাত বর্গকিলোমিটার। একটি খাল দিয়ে সোনাদিয়া মহেশখালীর মূল দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন। সোনাদিয়ার প্রায় ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতে দেখা মিলছে বিচিত্র প্রজাতির জলচর পাখির। সৈকত এবং বালিয়াড়ি বিপন্ন জলপাই বর্ণের অলিভ রিডলে সামুদ্রিক কাছিমের ডিম পাড়ার উপযোগী স্থান। এখানে সামুদ্রিক সবুজ কাছিম ও হকসবিল কাছিম ডিম পাড়তে আসে পূর্ণিমা রাতে।

সন্দ্বীপসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তে জেগে ওঠা নতুন চরেও আছে নানা জীববৈচিত্র্য। সরেজমিন দেখা যায়, সন্দ্বীপ উপজেলার আশপাশে জেগে ওঠা নতুন চরের পরিমাণ বর্তমান আয়তনের প্রায় দ্বিগুণ। ৫৭ বর্গমাইলের সন্দ্বীপের আশপাশে জেগে ওঠা ভূমির পরিমাণ কম করে হলেও ১০০ বর্গমাইল হবে। সন্দ্বীপের পশ্চিমে জেগে উঠেছে জাহাইজ্যার চর। এর দক্ষিণ পাশে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন আরেকটি ভূখণ্ডের নাম নেমস্তির চর। সন্দ্বীপের পূর্ব ও উত্তর পাশেও বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছে নতুন চর। এরই মধ্যে একটি অংশকে দীর্ঘাপাড় ইউনিয়ন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এ ইউনিয়নে বসবাস শুরু করা কয়েক হাজার ভূমিহীন পরিবারকে সুরক্ষা দিতে ২০১১ সালের জুন মাসে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল প্রশাসক। এখন নতুন জনপ্রতিনিধিও আছেন এই নতুন চরে। দ্বীপের অনেক মানুষ এই ইউনিয়নে হাজার হাজার গরু-ছাগল ও মহিষ পালন করছেন।

দীর্ঘাপাড় ইউনিয়নের বাসিন্দা আবু হানিফ বলেন, নতুন এ চরে এখন আমাদের মতো কয়েক হাজার মানুষের বসবাস। আমরা পাঁচজনের পরিবার এখানে বসবাস করছি চার বছর ধরে। তিনি বলেন, অনেক রকম পাখি দেখি এ চরে। কেউ কেউ এগুলোকে অতিথি পাখি বলেন। আগের তুলনায় এসব পাখির সংখ্যা অনেক বেশি। শীতকালে আরও বেশি দেখা যায়।

নোয়াখালী জেলার হাতিয়া দ্বীপ সংলগ্ন নিঝুম দ্বীপেও বসবাস করছে মানুষ। এ অঞ্চলের ঘন বনাঞ্চলে চরছে হরিণ, বানরসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী। নিঝুম দ্বীপের পাশে এখন নতুন করে জেগেছে চর কবিরা নামক একটি এলাকা। একটু অদূরে গেলে দেখা মিলছে চর কালাম, চর আলীম, সাগরিয়া, উচখালি, নিউ ডালচর নামক নতুন ভূখণ্ডের। নিঝুম দ্বীপের হরিণ এরই মধ্যে নজর কেড়েছে অনেকের। বন বিভাগ বলছে, হাতি ও বানরকে নিরাপদ রাখতে এ দ্বীপে প্রচুর গাছ লাগিয়েছে তারা। নতুন চরের নৈসর্গিক দৃশ্যে মাতোয়ারা হয়ে পল্লিকবি জসীম উদ্‌দীন আরও লিখেন- 'ঝাঁকে বসে পাখি ঝাঁকে উড়ে যায়/শিথিল শেফালি উড়াইয়া বায়/কিসের মায়ায় বাতাসের গায়/পালক পাতি/মহা কলতানে বালুয়ার গানে/বেড়ায় মাতি।'