হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলা এ মুহূর্তে বেশি জরুরি ,বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার আহ্বান

হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলা এ মুহূর্তে বেশি জরুরি ,বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার আহ্বান

রতন বড়ুয়া ।।

এ মুহূর্তে শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য ভেন্টিলেটরের চেয়ে হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলাই (এইচ এফ এন সি) সবচেয়ে বেশি জরুরি। এর মাধ্যমে শ্বাসকষ্টের রোগীকে উচ্চ মাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহ করা যায়। তাই শ্বাসকষ্টের জটিলতা দেখা দিলে বা অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গেলে এই হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলার মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করে অনেক রোগীকেই বাঁচানো সম্ভব বলে মত দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

চিকিৎসকরা বলছেন- শ্বাসকষ্ট দেখা দিলেই সংশ্লিষ্ট রোগীকে ভেন্টিলেটর দিতে হাহাকার করতে দেখা যায়। কিন্তু শ্বাসকষ্টের রোগীর জন্য বেশি প্রয়োজন হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলা। এটি পেলে শ্বাসকষ্টের অনেক রোগীকে বাঁচানো যাবে। যদিও আইসিইউ কিংবা এইচডিও শয্যায় রেখেই রোগীকে এই হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলার মাধ্যমে উচ্চ মাত্রায় অক্সিজেন দিতে হয়। আইসিইউ কিংবা এইচডিও শয্যা ছাড়া এই অক্সিজেন দেয়া যায় না। তাছাড়া রোগীকে এই হাই ফ্লো অক্সিজেন দিতে হলে অ্যানেসথেসিস্টের পাশাপাশি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্লান্ট থাকা অপরিহার্য।

স্বাভাবিকভাবে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনের মাধ্যমে ১৫ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন সরবরাহ দেয়া হয় রোগীকে। কিন্তু শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে কিংবা অক্সিজেনের স্যাচুরেশন একদম কমে গেলে রোগীকে আরো উচ্চ মাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহের প্রয়োজন পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে রোগীর জন্য একটি আইসিইউ-ভেন্টিলেটরের জন্য হাহাকার করেন স্বজনরা। কিন্তু এমন জরুরি মুহূর্তে ভেন্টিলেটর নয়, শ্বাসকষ্টের রোগীর জন্য হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলাই বেশি কার্যকর এবং জরুরি বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা টিমের ফোকাল পারসন ও মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. আব্দুর রব মাসুম।

তিনি বলেন, আমাদের এ মুহূর্তে বেশি প্রয়োজন হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলা। এটির মাধ্যমে স্যাচুরেশন কমে যাওয়া রোগীকে ৭০-৮০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন সরবরাহ করা যায়। যেখানে সেন্ট্রাল অক্সজেন লাইন বা সিলিন্ডার দিয়ে ১৫ লিটারের বেশি অক্সিজেন সরবরাহ দেয়া সম্ভব হয় না। অন্তত বিশটি হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলা পেলে জেনারেল হাসপাতালে বহু রোগীকে বাঁচানো সম্ভব বলে জানান ডা. রব। একই কথা বলেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও করোনা মোকাবেলায় গঠিত সমন্বয় কমিটির আহবায়ক ডা. আব্দুর সাত্তার।

তবে শ্বাসকষ্টের রোগীর জীবন রক্ষাকারী হিসেবে এই হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলার হাহাকার চলছে চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। মান ভেদে এই হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলার প্রতিটির বাজার মূল্য ৫ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তবে কিনতে গেলে বাজারে এর সংকটের কথাও জানিয়েছেন বেসরকারি ম্যাক্স হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লিয়াকত আলী খান। সবমিলিয়ে শ্বাসকষ্টের রোগীদের জীবন রক্ষাকারী হিসেবে এই হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলার সংকটে পড়েছে চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে মাত্র চারটি এইচএফএনসি রয়েছে। মোট তিনটি এইচএফএনসি রয়েছে জেনারেল হাসপাতালে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বিআইটিআইডি হাসপাতাল, রেলওয়ে হাসপাতাল ও হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে একটিও নেই। আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালেও রয়েছে দুটি এইচএফএনসি। আর ম্যাক্স হাসপাতাল ও মেট্রোপলিটন হাসপাতালে তিন/চারটির বেশি এইচএফএনসি নেই বলে জানিয়েছেন ডা. লিয়াকত আলী খান ও মেট্রোপলিটন হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার মো. সেলিম। সিএসসিআর হাসপাতালে মাত্র একটি এইচএফএনসি আছে। যদিও আরো একটি কেনা হয়েছে, যা আজ-কালের মধ্যেই পৌঁছাবে বলে জানিয়েছেন সিএসসিআর’র সিওও (চিফ অপারেটিং অফিসার) ডা. সালাউদ্দিন মাহমুদ। আর ন্যাশনাল হাসপাতালে একটি মাত্র এইচএফ এনসি রয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক ডা. আজমল হোসেন। বেসরকারি অন্য হাসপাতালগুলোর মধ্যে পার্কভিউ হাসপাতালে কয়েকটি থাকলেও বাকি হাসপাতালগুলোতে একটি বা দুটির বেশি ন্যাসাল ক্যানুলা নেই বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।

হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলার সংকটের কথা স্বীকার করে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম হুমায়ুন কবির  বলেন, আমাদের চারটি হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলা আছে। কিন্তু আইসিইউ-তে রোগী থাকছে ৬/৭ জন। যার কারণে সবাইকে এই হাই ফ্লো অক্সিজেন দেয়া সম্ভব হয় না। যদিও এই হাই ফ্লো অক্সিজেনই এখন বেশি প্রয়োজন। আরো চারটি ম্যানেজ হয়েছে জানিয়ে আজ-কালের মধ্যে এই চারটি হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলাও ইনস্টল করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। যদিও এই সংখ্যা পর্যাপ্ত নয় জানিয়ে আরো ন্যাসাল ক্যানুলা প্রয়োজন বলে জানান চমেক হাসপাতাল পরিচালক। আর রোগীদের বাঁচাতে এই হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলা নিয়ে সমাজের বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন তিনি। জোর আহবান জানিয়েছেন চিকিৎসকরাও। তাঁরা বলছেন- শ্বাসকষ্টের রোগীদের বাঁচাতে এ মুহূর্তে যেটি সবচেয়ে জরুরি, তা হলো- হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলা। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানে এই ন্যাসাল ক্যানুলার সংকট খুব বেশি। সরকারি দুই (চমেক ও জেনারেল) হাসপাতালে সবমিলিয়ে ৭টির মতো ন্যাসাল ক্যানুলা রয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। তাই এই ন্যাসাল ক্যানুলা নিয়ে সমাজের বিত্তশালীরা এগিয়ে আসলে অনেক রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হবে। জেনারেল হাসপাতালের করোনা টিমের ফোকাল পারসন ডা. আব্দুর রব বলেন, আমাদের মাত্র তিনটি ন্যাসাল ক্যানুলা রয়েছে। অন্তত ২০টি ন্যাসাল ক্যানুলা পেলে বহু রোগীকে বাঁচানো যাবে। তাই রোগীদের জীবন বাঁচাতে সমাজের বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান তিনি।

চিকিৎসক ও হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন- অক্সিজেন স্যাচুরেশন অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া রোগীকে এইচএফএনসি’র মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করা জরুরি। কিন্তু সংকটের কারণে আইসিইউ-তে থাকা কয়েকজনকে দেয়া সম্ভব হলেও বাকি রোগীদের এই অক্সিজেন দেয়া সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে কিছুক্ষণ এক রোগীকে, আবার কিছু সময় অন্য এক রোগীকে এই হাই ফ্লো অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। এভাবে ভাগাভাগি করে কোন রকমে রোগীদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালান চিকিৎসকরা। কিন্তু যেসব রোগীর নিরবচ্ছিন্ন এই হাই ফ্লো অক্সিজেন প্রয়োজন হয়, ভাগাভাগি করতে গিয়ে এমন অনেক রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। অনেককে বাঁচানো সম্ভবপর হয়ে উঠে না।

অন্যদিকে, ভেন্টিলেটরে দেয়া হলে ওই রোগীর ফিরে আসার সম্ভাবনা তেমন একটা থাকে না। এ পর্যন্ত ভেন্টিলেটরে দেয়া রোগীর মধ্য থেকে উন্নতি হয়ে ফিরে এসেছেন এমন উদাহরণ খুব একটা নেই বলে জানিয়েছেন ডা. আব্দুর রব। একই তথ্য দিয়েছেন চমেক হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ। তাঁরাও বলছেন- এ মুহূর্তে শ্বাসকষ্টের রোগীদের বাঁচাতে ভেন্টিলেটর নয়, হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলাই বেশি জরুরি।