বিশ্বব্যাপী করোনায় আক্রান্ত,ভাইরাস-বিপর্যয় থেকে বাঁচার আমল

বিশ্বব্যাপী করোনায় আক্রান্ত,ভাইরাস-বিপর্যয় থেকে বাঁচার আমল

মাওলানা মুহম্মদ খলীলুর রহমান নেছারাবাদী ।।

ভাইরাস কিংবা মহামারী নতুন কিছু নয়। ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, বিভিন্ন শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী এমন অনেক মহামারী ও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল। রাসুল (সা.)-এর সময়েও এমন মহামারী রোগ ছড়িয়েছিল। মানবতার মুক্তির দূত রাসুল (সা.) এর সমাধানও দিয়ে গেছেন।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘মানুষের পাপের কারণে জলে-স্থলে সর্বত্র বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান। যাতে তারা আল্লাহর দিকে ফিরে আসে।’ (সুরা রূম : আয়াত ৪১)। রোগ-কিংবা মহামারী কিংবা দুর্যোগ আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে আসে। বান্দাদের পরীক্ষা করতে বিভিন্ন সময় আল্লাহ তায়ালা এমন করে থাকেন। যেমন পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব ভয়-ভীতির মধ্যে নিপতিত করে, ক্ষুধা-পিপাসায় কষ্ট দিয়ে, ধন-সম্পত্তি বিনষ্ট করে, জীবননাশ করে, ফসল নষ্ট করে। হে নবী! আপনি সুসংবাদ জানিয়ে দিন ওই সব মুমিনদেরকে, যারা বিপদের সময় ধৈর্যধারণ করে।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৫৫)। অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের ওপর যেসব বিপদ-আপদে পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের বহু গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’ (সুরা শূরা : আয়াত ৩০)। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন কোনো জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগ রোগের আবির্ভাব হয়। তা ছাড়া এমন সব রোগ-ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা আগের লোকদের মধ্যে কখনও দেখা যায়নি।’ (ইবনে মাজাহ)
পবিত্র কোরআন ও রাসুল (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণীর হাদিসগুলো পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের কৃতকর্মের কারণে আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন সময় শাস্তিস্বরূপ বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধি ও বালা-মুসিবত দিয়ে থাকেন। যাতে করে আমরা সতর্ক হই।
সুতরাং আমাদেরকে আল্লাহর হক ও মানুষের হক আদায়ের প্রতি খেয়াল রেখে সব পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং মহান সৃষ্টিকর্তার ক্ষমা ও সাহায্য চাইতে হবে। যাতে সমগ্র মানব জাতি এ বিপদ ও দুর্যোগ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত দোয়াসমূহ পাঠ করতে হবে এবং ভাইরাস থেকে বেঁচে থাকার উপায়গুলো অবলম্বন করতে হবে।
দুর্যোগ ও বিপর্যয় থেকে বাঁচতে ইসলামে কিছু নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি পবিত্র কোরআনে এমন বিষয় নাজিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত। গুনাহগারদের তো এতে শুধু ক্ষতিই বৃদ্ধি পায়।’ (সুরা বনী ঈসরাইল : আয়াত ৮২)। আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি বলুন, এটা বিশ্ববাসীদের (ঈমানদার) জন্য হেদায়েত ও রোগের প্রতিষেধক।’ (সুরা হা-মীম, সাজদাহ : আয়াত ৪৪)। বিশে^ ছড়িয়ে পড়া মহামারীর সৃষ্টিকর্তা যেহেতু মহান আল্লাহ; সুতরাং এই মহামারী থেকে বাঁচার জন্য আমাদেরকে প্রধানত কোরআন সুন্নাহর শরণাপন্ন হতে হবে এবং রাসুল (সা.)-এর নির্দেশিত পথ অবলম্বন করতে হবে। এতেই আমরা মুক্তি পেতে পারি। এখানে এমন ১০টি আমলের কথা বলছিÑ ১. কথায় কাজে ঈমানের প্রতিফলন ঘটানো। আদর্শভিত্তিক ঐক্য এবং জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার অধিকার রক্ষার মাধ্যমে ঈমানের প্রতিফলন ঘটালে আল্লাহ তায়ালা দুঃখ, কষ্ট, মুসিবত এবং দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন দান করে থাকেন। ২. বেশি বেশি দোয়া করা। রাসুল (সা.) থেকে বর্ণিত দোয়া বেশি বেশি পাঠ করা। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর বিভিন্ন দোয়ার পাশাপাশি বেশি বেশি হাসবুনাল্লাহ ও দোয়া ইউনুস পাঠ করা। ৩. আক্রান্ত এলাকায় গমন না করা এবং আক্রান্ত ব্যক্তি এলাকা ত্যাগ না করা। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যদি তোমরা মহামারীর কোনো সংবাদ শোন, তো সেখানে তোমরা প্রবেশ হতে বিরত থাক। আর যদি কোনো শহরে বা নগরে কেউ আক্রান্ত হয়, তো সেখান থেকে তোমরা বের হয়ো না’। (বুখারি) ৪. হতাশা ও অস্থির না হওয়া। ভাইরাস নিয়ে হতাশা আর অস্থির না হওয়া। করোনাভাইরাস নিয়ে হতাশা আর অস্থির হওয়া কোনো ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। ৫. মানসিক শক্তিকে দৃঢ় রাখা। অতিরিক্ত চিন্তা করে শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল না হওয়া। ৬. তওবা করা। বেশি বেশি তওবা করা ও ইস্তেগফার পড়া। আল্লাহমুখী হওয়া, তাকওয়া-পরহেজগারি অর্জন করা দরকার।
৭. অজু করা। ঘন ঘন অজু করার মাধ্যমে শরীরকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখা। ডাক্তারগণের পরামর্শ হলো ঘন ঘন দুই হাতের কবজি পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড পর্যন্ত সময় নিয়ে ধৌত করা। রাসুল (সা.) দিনে কমপক্ষে পাঁচবার নামাজের পূর্বে অজুর সময় দুই হাতের কবজি পর্যন্ত তিনবার ধৌত করার কথা বলেছেন। এতে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সময় অতিবাহিত হয়। ৮. কালোজিরা ও মধুর ব্যবহার। দিনে ২-৩ বার কালোজিরা ও মধু খাওয়া। অসুখ হওয়ার পূর্ব হতেই সতর্কতাস্বরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, কালোজিরা ও মধু সব দুরারোগ্য রোগের ওষুধ। (বুখারি)। ৯. হাঁচি-কাশিতে সতর্ক থাকা। হাঁচি-কাশির সময় বাহু দিয়ে ঢেকে রাখা। রাসুল (সা.) যখন হাঁচি দিতেন তখন তার হাত অথবা কাপড় দ্বারা নাক ঢেকে রাখতেন। (আবু দাউদ)। সুতরাং আমাদের উচিত হাঁচির সময় কাপড় অথবা টিস্যু পেপার দিয়ে নাক ঢেকে রাখা। ১০. আল্লাহ তায়ালার সাহায্য চাওয়া। সর্বোপরি মহামারী থেকে মুক্তির জন্য বিনীতভাবে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও সাহায্য কামনা করতে হবে, তাহাজ্জুদ পড়ে দোয়া করতে হবে। ভাইরাসকে ভয় না পেয়ে ভাইরাসের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করবে ঈমানদার।
এ ছাড়াও সতর্কতামূলক অন্যান্য প্রতিষেধক অবলম্বন করাÑ ক. যেকোনো ধরনের ভিড় বা জনসমাগম এড়িয়ে চলা। খ. টাকা-পয়সা গণনার পরে হাত পরিষ্কার করা। গ. যেখানে-সেখানে কফ, থুথু ফেলা বন্ধ করা। ঘ. অপ্রয়োজনে সিড়ির হাতল ধরে ওঠা-নামা না করা। ঙ. কথায় কথায় মুখে হাত দেওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করা। চ. খোলামেলা পরিবেশে থাকা, দরজা-জানালা সর্বক্ষণ বন্ধ না রাখা।
ছ. খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে কচলিয়ে হাত ধৌত করা। জ. পর্যাপ্ত পানি পান করা, সবুজ শাকসবজি ও ভিটামিন এ জাতীয় খাবার খাওয়া। ঞ. ভিটামিন সি, রসুন, টক দই, হলুদ, পেঁপে, ইত্যাদি খাওয়া। ট. খেজুর খাওয়া। রাসুল (সা.) আজওয়া খেজুর খেতে বলেছেন।
সবশেষে বলব, আমরা করোনাকে ভয় করব না বরং সচেতন থাকব, ভয় করব করোনার সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তায়ালাকে। ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি অধিক পরিমাণে নফল ইবাদত করব ও আল্লাহ তায়ালার নিকট বেশি বেশি ইস্তেগফার করব; তিনি যেন বাংলাদেশসহ বিশে^র সব মুসলমানকে করোনাভাইরাসসহ অন্যান্য কঠিন ব্যাধি-মহামারী থেকে আমাদেরকে হেফাজত করেন। আমিন।