অবাস্তব মনগড়া কাহিনী ‘এক্সট্রাকশন’, বাংলাদেশের দর্শকরা ক্ষুব্ধ

অবাস্তব মনগড়া কাহিনী ‘এক্সট্রাকশন’, বাংলাদেশের দর্শকরা ক্ষুব্ধ

নিপু বড়ুয়া।।

২৪ এপ্রিল নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে হলিউডের আলোচিত সিনেমা ‘এক্সট্রাকশন’ । এই ছবিটি অন্য দশটি সিনেমার চেয়ে খানিক আলাদা। কারণ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সিনেমার গল্প। এই সিনেমার প্রাথমিক নামও ছিলো ‘ঢাকা’। এমনকি কিছু শুটিং ঢাকায় হয়েছে বলেও খবর শোনা যায়।

তা ছাড়া এ সিনেমায় আছেন ‘থর’- খ্যাত ক্রিস হেমসওয়ার্থ। আছেন ভারতের রনদীপ হুদা, পঙ্কজ ত্রিপাঠির মতো অভিনেতা। সিনেমা পরিচালনা করেন স্যাম হারগ্রেভ, যিনি কিনা অ্যাভেঞ্জার, ড্যাডপুল সিনেমায় ছিলেন স্টান্টম্যান হিসেবে। কাহিনি লিখেছেন জো রুশো। সবমিলিয়ে সিনেমাটির জন্য দর্শকের আগ্রহ ছিলো তুঙ্গে। সিনেমা নেটফ্লিক্সে আসার পর দেখা গেলো দর্শকের প্রত্যাশার ছিঁটেফোঁটাও পূরণ করতে পারেনি সাড়ে পাঁচশ কোটি বাজেটের ‘এক্সট্রাকশন?’।

সিনেমার গল্পে বাংলাদেশ আছে। বলতে গেলে ঢাকা শহর আছে। ভারতের এক মাফিয়া ডনের ছেলেকে অপহরণ করে বাংলাদেশে নিয়ে আসে আরেক ডন। ছেলেকে উদ্ধারের দায়িত্ব পড়ে টেইলার তথা ক্রিস হেমসওয়ার্থের।  তিনি অন্য ‘অপহরণ’ সিনেমাগুলোর মতোই ছেলেটিকে উদ্ধার করতে এসে নানান বাধার মুখে পড়েন। পুরনো ঢাকায় তার সাথে প্রবল সংঘর্ষে লিপ্ত হয় বাংলাদেশের ডনের লোকজন।

তবে স্থানীয়দের মুখে কলকাতার বাংলা শুনতে অধিকাংশ দর্শকের ভালো লাগেনি। বাংলাদেশে ঐ সুরে আসলেই কী লোকজন কথা বলেন? শুধু কী তাই, ঢাকা শহরের নানা জায়গায় পুরনো হিন্দি গান বাজতে শোনা যায়। এমনকি হিন্দি নামফলকও দেখা গেছে সিনেমার ঢাকায়। ঢাকার ট্রেডমার্ক হিসেবে সিনএনজি চালিত অটোরিকশা, বাস দেখানো হয়েছে প্রচুর। বাসের নাম হাসিনা পরিবহন। অথচ এই নামে কোনো গণপরিবহন নেই ঢাকায়।

এখানেই বিষয়টা থেমে গেলে চলতো। কিন্তু তা আর হলো কোথায়?এক সন্ত্রাসীর কথায় বাংলাদেশের দেশরক্ষায় নিয়োজিত সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনীসহ সরকারি অন্যান্য বাহিনী উঠবে বসবে তা কতটা গ্রহণযোগ্য? তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। দিনে দুপুরে ঢাকার রাস্তায় ক্রিস একে একে পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে পাখির মতো গুলি করে মেরে ফেলছে। যা এদেশের দর্শকের কাছে অবাস্তবই লেগেছে। বাংলাদেশ কিএমন? বাংলাদেশকে পর্দায় তুলে ধরার আগে রিসার্চ করা প্রয়োজন ছিলো নেটফ্লিক্সের।

ঢাকায় শুটিংয়ের কথা বললেও আদৌ তেমন শুটিং হয়নি। কয়েকটি ড্রোন শট ঢাকার ঘনবসতি বিল্ডিং , আর বুড়িগঙ্গার দৃশ্য নেয়া হয়েছে।  বেশির ভাগ শুটিং হয়েছে মুম্বাই, আহমেদাবাদ ও থাইল্যান্ডে। ওখানে ঢাকার আদলে সেট বানিয়ে শহর দেখানো হয়েছে। আরেকটি হাস্যকর ব্যাপার হলো, ঢাকার অদূরে বুড়িগঙ্গার উপরে অবস্থিত সুলতানা কামাল সেতু দিয়ে নাকি ভারত যাওয়া যায়। ভারত ঢাকার এত কাছে এলো কবে সেটাও তো ভাববার বিষয়! দুঃখের বিষয় এই সিনেমার বাংলাদেশ অংশের সাথে যুক্ত ছিলো প্রখ্যাত অভিনেতা তারিক আনাম খানের প্রতিষ্ঠান। বাংলা ভাষার দিকটা দেখেছেন ওয়াহিদ ইবনে রেজা।

ফেসবুকে নেটিজেনরা সিনেমাটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। তাতে যোগ দিয়েছেন দেশের শোবিজের তারকারাও। অভিনেত্রী মৌটুসী বিশ্বাস তার ইউটিউব চ্যানেলে রিভিউ ভিডিও দিয়েছেন। সেখানে ক্ষোভের সাথে এ প্রিয় অভিনেত্রী বলেন, ‘এ তামাশার সিনেমা দেখে আমি কী ভালো কথা বলব। না আছে কোনও ভালো গল্প, না আছে কোনও ভালো চিত্রনাট্য। এ সিনেমা দেখে যে সময় নষ্ট হয়েছে তার চেয়ে দুটো রান্নার অনুষ্ঠান দেখলে আমার কাজে লাগতো।’

জানা যায় ‘এক্সট্রাকশন?’ সিনেমার মূল গল্প ২০১৪ সালের ‘সিউদাদ’ নামক একটি কমিকবুক থেকে ধার করা। যার অর্থ শহর। আর সে শহর ঢাকা। উপন্যাস প্রকাশেরও আগে ২০১২ সালে প্যারাগুয়ের প্রেক্ষাপটে ‘দ্য রক’ ডোয়াইন জনসনকে নিয়ে সিনেমাটি করতে চেয়েছিলেন জো রুশো। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেশ, নায়ক বদলে গেলেও বদলায়নি মূল গল্প।

প্যারাগুয়ের জায়গায় এসেছে বাংলাদেশ। মূল গল্পে পৃথিবীর নিকৃষ্ট শহরের কথা বলা হয়েছিলো। ঢাকাকেই বেছে নেয়া হয়েছে সেরকম শহর হিসেবে। কেন? এর মূলে রয়েছে বাণিজ্য।

ধারণা করা হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশের বাজার ধরতে চাচ্ছে নেটফ্লিক্স। নির্মাতা দীপঙ্কর দীপন বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, ‘আজকের দিনে বিনোদন বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির অঙ্ক। আর বাণিজ্য সব সময় তার মূল ভোক্তাদের সন্তুষ্ট রাখে। তাই আমেরিকানরা তৃতীয় বিশ্বকে যেভাবে দেখতে চায়- সেভাবেই এক্সট্রাকশনে বাংলাদেশকে দেখিয়েছে নেটফ্লিক্স- এটাই তাদের আসল রিসার্চ।’

আরেক নির্মাতা রাশেদ জামানের কথায়ও পাওয়া যায় একই সুর। তার ভাষ্যে, ‘দুর্বলের সূক্ষ অনুভূতির প্রতি সবলের সহানুভূতি ও শ্রদ্ধা কোনকালে কি ছিলো?’

ম‌োদ্দা কথা পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশকে যেভাবে দেখতে চায় সেভাবেই দেখিয়েছে। তাদের কাছে ভারতও বস্তির দেশ, ‘স্লামডগ মিলিওনিয়ার’ - এর কথা মনে আছে তো?

‘এক্সট্রাকশন’ প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত আছেন ক্রিস হেমসওয়ার্থ। ছবির মেকিং নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ নেই। শুধু বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য বাংলাদেশকে এভাবে উপস্থাপন না করলে খুব কি ক্ষতি হতো? এমনই প্রশ্ন ক্রিস হেমসওয়ার্থের প্রতি কোটি ভক্তের।