অর্থ উপার্জন ও সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য মাহফিলের মাহাত্ম্য নষ্ট করা উচিত নয় - মাওলানা মুহাম্মাদ মামুনুল হক

আমিন ইকবাল ।।

অর্থ উপার্জন ও সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য মাহফিলের মাহাত্ম্য নষ্ট করা উচিত নয় - মাওলানা মুহাম্মাদ মামুনুল হক
ইসলামের দাওয়াত ও বিধিবিধান প্রচারের অন্যতম মাধ্যম ওয়াজ-মাহফিল। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই চলে আসা ধর্মীয় এসব অনুষ্ঠান শহর নগর গ্রাম সর্বত্র অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে আপামর জনতা ইসলামের নানা বিষয়-আশয় জানতে পারছেন, শিখতে পারছেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এসব মাহফিলে কিছু বক্তা বা ধর্মীয় আলোচকের বক্তব্য, অঙ্গভঙ্গি এবং অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত বিষয় সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। নবীযুগের ওয়াজ-মাহফিলের চিত্র, বক্তার গুণাবলি ও আলোচিত-সমালোচিত বিষয়ে সময়ের আলোকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া ঢাকার মুহাদ্দিস ও ওয়ায়েজিনদের সংগঠন ‘রাবেতাতুল ওয়ায়েজিন বাংলাদেশ’-এর উপদেষ্টা, ধর্মীয় আলোচক মাওলানা মুহাম্মাদ মামুনুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমিন ইকবাল
 

সময়ের আলো : ওয়াজ-মাহফিলের প্রচলন কবে থেকে ও কীভাবে শুরু হয়?
মাওলানা মামুনুল হক : ওয়াজ-মাহফিল ইসলামের শাশ্বত ও সর্বকালীন বিষয়। মানুষকে ইসলামের পথে আহ্বান করা, ইসলামের আদর্শের কথা শিক্ষা দেওয়া, মানুষকে পরকালমুখী করা প্রভৃতি বিষয়গুলো সর্ব সাধারণের সামনে উপস্থাপন করার জন্য ওয়াজ এবং নসিহত করার এই ধারা রাসুল (সা.)-এর যুগ থেকেই প্রচলিত। পৃথিবীর যেখানেই ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেছে সেখানেই ইসলামের অন্যান্য বিধিবিধান ও আদর্শের পাশাপাশি ওয়াজ-নসিহতের এই ধারাও চলে আসছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী এক-দুই বছর দেশের পরিবেশ কিছুটা থমথমে ভাব ছিল। তবে ৭২-৭৩ সালে সেই অবস্থা কেটে যাওয়ার পর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের শহরগুলোতে এবং পর্যায়ক্রমে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ওয়াজ-মাহফিল শুরু হয়।

সময়ের আলো : এসব মাহফিলে মৌলিকভাবে কী শেখানো হয়?
মাওলানা মামুনুল হক : ওয়াজ অর্থ হলো মানুষকে উপদেশ দেওয়া, পরকালের জন্য প্রস্তুত হতে আহ্বান জানান। কাজেই ওয়াজ-মাহফিলের মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে মানুষকে ইসলামের মৌলিক বিধিবিধান সম্পর্কে অবগত করা। তবে এর মধ্যে অনেকগুলো শাখাগত বিষয়ে আলোচনা হয়। সবচেয়ে বেশি ও ব্যাপকভাবে আলোচনা হয় মানুষকে দুনিয়া থেকে আখেরাতমুখী করার বিষয়। মানুষ যে জাগতিক জীবনে অতিমাত্রায় পার্থিব ও দুনিয়ামুখী হয়ে যায় তা থেকে চিরস্থায়ী জগৎ সম্পর্কে সচেতন করা হয়। পাশাপাশি ইসলামের বিভিন্ন বিধিনিষেধ সম্পর্কে মানুষকে জানান হয়। ইসলামের আকিদা-বিশ্বাস, ইসলামের চিন্তা-চেতনার আলোচনা করা হয়। অন্যায় ও বাতিল প্রতিরোধে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হয়, ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠায় মানুষকে আহ্বান জানান হয়। অর্থাৎ ইসলামের মৌলিক সব বিষয়ে ওয়াজ-মাহফিলে আলোচনা করা হয়।
 
সময়ের আলো : ইদানীং মাহফিলকেন্দ্রিক এক ধরনের ‘কমেডি’র প্রচলন হয়েছে! রঙ্গ-তামাশা করে আসর জমানো চেষ্টা করেন কিছু বক্তা! এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

মাওলানা মামুনুল হক : একজন ওয়ায়েজ বা বক্তা যখন আলোচনা করেন তখন উপস্থিত শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য কিছুটা হাস্যরস কিংবা কিছুটা কৌতুক অনেক সময় সীমার ভেতরে থেকে করা দোষণীয় নয়। কিন্তু কারও কারও ক্ষেত্রে বিষয়টা মাত্রাতিরিক্ত হয়। যার কারণে মাহফিলের ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট হয় এবং ওয়াজ-মাহফিলের ব্যাপারে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়। তবে এ ধরনের হাস্যরস ও কৌতুক করার মাত্রা খুব বেশি না। হলেও খুবই সীমিত পরিসরে হয়। কিন্তু একে কেন্দ্র করে যে সমস্যা হচ্ছে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে এ ধরনের হাস্যরস ও কমেডিগুলোকে ওয়াজ-মাহফিল থেকে কাট করে করে ভিউয়ার ও দর্শক বাড়ানোর জন্য বেশি বেশি প্রচার করা হচ্ছে। সস্তা জনপ্রিয়তা বাড়াতে ব্যতিক্রমধর্মী শিরোনাম দিয়ে এসব প্রচার করা হচ্ছে। অথচ মাহফিলের যেটা বেশি প্রচার হওয়া উচিত সেগুলো তারা করছে না। সে জন্যই মানুষের সমালোচনার একটা সুযোগ তৈরি হয়।
 

তবে যেসব বক্তা সীমার বাইরে এসব করে বেড়ান, তাদের উদ্দেশে আমার কথা হলো, আপনারা আরও সতর্ক হোন। শুধু আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্যই আলোচনা করুন। নিজেকে আলোচনায় রাখা কিংবা নিজের সস্তা জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য মাহফিলের ভাবগাম্ভীর্য ও মাহাত্ম্য নষ্ট করার সুযোগ নেই।

সময়ের আলো : প্রকৃত বক্তাদের কেমন গুণাবলি থাকা চাই?

মাওলানা মামুনুল হক : বক্তা বা ওয়ায়েজ; যিনি আল্লাহর পথে মানুষকে দাওয়াত দেবেন তার সর্বপ্রথম বৈশিষ্ট্য হলো ইসলাম তথা কোরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। যাদের ভেতর মানুষকে ওয়াজ করার মতো শরিয়তের জ্ঞান, ইসলামের আকিদা-বিশ্বাস ও বিধিবিধান সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও পড়াশোনা নেই স্বাভাবিকভাবেই তাদের পক্ষে ওয়াজ করা মানানসই নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে জ্ঞান প্রকাশ কর না। নিশ্চয় কান, চক্ষু ও অন্তর প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৩৬)
 

একজন ওয়ায়েজ মানে হচ্ছে একজন মুয়াল্লিম বা শিক্ষক। আর শিক্ষকতা তো যে কেউ করতে পারে না। একজন শিক্ষকের জন্য যে যোগ্যতা প্রয়োজন, প্রাথমিকভাবে একজন ওয়ায়েজের জন্যও সেই যোগ্যতা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি বক্তার উপস্থাপন যোগ্যতাও থাকা চাই। কারণ, ওয়াজ-মাহফিলে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব ধরনের মানুষ থাকে, যাতে শিক্ষিত শ্রোতাও খোরাক পায়, অশিক্ষিত লোকরাও কথা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। তাই ইসলাম সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি উপস্থাপনার কলাকৌশলও রপ্ত করা চাই।

সময়ের আলো : নবীজি (সা.)-এর আলোচনা-মাহফিলের চিত্র কেমন ছিল?

মাওলানা মামুনুল হক : হাদিসে রাসুল (সা.)-এর ওয়াজ বা নসিহত করার বিবরণ উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি যখন বয়ান করতেন তখন সাহাবিদের মধ্যে নবীজির প্রতি একাগ্রতা লক্ষ করা যেত। মনোযোগী হয়ে তারা নবীজির কথা শুনতেন। নবীজির কথার ধরন এমন ছিল তিনি যখন সতর্কবাণী উচ্চারণ করতেন তখন উচ্চ কণ্ঠে কথা বলতেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে নবীজি (সা.) যখন কথা বলতেন তখন নবীজির আওয়াজ অনেক উঁচু হয়ে যেত, নবীজির চেহারার মধ্যে রাগ এবং ক্রোধের চিহ্ন ফুটে উঠত। মনে হতো আল্লাহর নবী কোনো সৈন্যবাহিনীকে সতর্ক করছেন।
 

এটা হতো সতর্কবাণী উচ্চারণ করার সময়। আবার যখন মানুষকে পরকালের কথা বলতেন, জান্নাত-জাহান্নামের কথা বলতেন, আল্লাহর ভয় সম্পর্কে বোঝাতেন তখন তার এমন অবস্থা হতো যে, চোখ দিয়ে দরদর করে অশ্রু পড়ত, মানুষের অন্তরগুলো কেঁপে কেঁপে উঠত। মোটকথা, অবস্থার প্রেক্ষিতে নবীজি (সা.)-এর বয়ানের ধরন পরিবর্তন হতো। সাহাবায়ে কেরাম খুবই আগ্রহের সঙ্গে তার কথা শুনতেন। আর নবীজির বড় একটি গুণ ছিল শ্রোতারা যতক্ষণ পর্যন্ত কথা শোনার আগ্রহ রাখত তিনি ততক্ষণই কথা বলতেন। স্রোতাদের মধ্যে বিরক্তির ভাব চলে এলে তিনিও কথা গুছিয়ে শেষ করে দিতেন।

সময়ের আলো : অনেকে আপত্তি করে বলে ‘মাহফিলের নামে কিছু আলেম কাঁচা টাকার ব্যবসা করে। চুক্তি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় ইত্যাদি।’ দ্বীন প্রচারের নামে এভাবে অর্থ কামানো কতটুকু সঠিক?

মাওলানা মামুনুল হক : মূলত আমাদের সমাজব্যবস্থার অধঃপতনের যেসব প্রক্রিয়ায় চলছে, তারই একটা অংশ বা অধ্যায় এটি। ফলে ওয়াজকে একটা পণ্য হিসেবে সাব্যস্ত করা হচ্ছে। আমি বলব, এর জন্য যারা বক্তা বা ওয়ায়েজ শুধু তারাই দায়ী নয়; বরং এ  ক্ষেত্রে বড় ধরনের দায়ী কতিপয় আয়োজকও। ওয়ায়েজদের টাকা-পয়সা নিয়ে বার্গেডিং করা, টাকা উপার্জনের লক্ষ্যেই ওয়াজ-মাহফিল করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। ইসলামের মূল স্প্রিড ও দর্শনের সঙ্গে এটা মানানসই নয়। তবে একজন মানুষ যিনি দ্বীন শেখানোর কাজে নিয়োজিত হওয়ার কারণে তার প্রয়োজনীয় জীবন উপকরণ গ্রহণ করা ইসলামের চেতনার পরিপন্থি নয়। কিন্তু এটাকে পণ্যায়ন করা ও ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই।
 

বর্তমান সময়ের বক্তাদের কারও কারও মধ্যে এ বিষয়ে ত্রুটি রয়েছে। তারা মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা পেশ করে থাকেন, মানুষের সঙ্গে অসদাচারণ করে থাকেন। আবার কিছু কিছু আয়োজক রয়েছে যারা মাহফিলের নামে এলাকার মানুষ থেকে ব্যাপকভাবে টাকা কালেকশন করে থাকে। তারা তাদের কালেকশনের সুবিধার্থে যে ধরনের বক্তার ডিমান্ড বেশি রয়েছে তাদের নানা অফার করে চুক্তি করে এবং এলাকার মানুষ থেকে ব্যাপক কালেকশন করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু বক্তা এই শ্রেণির লোকদের ফাঁদে পড়ে যায়; যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

সময়ের আলো : বাংলাদেশে অনেক দল ও মতের আলেম আছেন। সবাই যার যার জায়গা থেকে আলোচনা করতে গিয়ে পরস্পরে কাদা ছোড়াছুড়ির মতো ঘটনা ঘটে! এতে সাধারণ মানুষের মনে বিরূপ প্রভাব লক্ষ করা যায়। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
মাওলানা মামুনুল হক : আসলে বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক ও মতপার্থক্য হওয়া সহজাত ও স্বাভাবিক বিষয়। এটাকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা সম্ভব না। তবে অবশ্যই সাধারণ মাহফিলগুলোতে কথা বলার সময় অন্য মতের এবং অন্য মতের যারা প্রবক্তা ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে প্রমাণের আলোকে নিজের মতামত ও নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা চাই। এ ক্ষেত্রে সবাই যদি ভারসাম্য রক্ষার দিকটাকে গুরুত্ব দেন, তাহলে এটা সহনীয় হওয়া সম্ভব।

সময়ের আলো : সম্প্রতি ‘রাবেতাতুল ওয়ায়েজিন বাংলাদেশ’ নামে বক্তাদের একটি সংগঠন হয়েছে। আপনি এর উপদেষ্টা। এই সংগঠন মাহফিলের নামে এসব কাদা ছোড়াছুড়ি ও কমেডি বন্ধের উদ্যোগ নেবে কি?
মাওলানা মামুনুল হক : ‘রাবেতাতুল ওয়ায়েজিন বাংলাদেশ’ গঠিত হওয়ার মূল লক্ষ্য হলো যারা মাঠে-ময়দানে ওয়াজ এবং নসিহতের কাজ করেন তাদের এ বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষ এবং উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলা। এ জন্য যতটুকু সম্ভব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আলোচনার উপাদান ও বিষয়বস্তু তাদের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা। পাশাপাশি বিভিন্ন ঘরানার ওয়ায়েজিন যারা রয়েছেন, তাদের মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় তৈরি করা, কেউ যেন ওয়াজ-মাহফিলে অসদাচারণ না করেন বা ভুলভ্রান্তি না হয় এবং কোরআন ও হাদিসের বিপরীত কোনো কার্যক্রম যেন না হয় এসব বিষয়ে তাদের সতর্ক করা ও সম্প্রীতি রক্ষা করা এই সংগঠনের অন্যতম কাজ।

সময়ের আলো : তরুণ ওয়ায়েজিনদের প্রতি আপনার বার্তা কী?
মাওলানা মামুনুল হক : তরুণ ওয়ায়েজিনদের প্রতি বার্তা হলো ওয়ায়েজ হওয়াটা কোনো শখের বিষয় নয়, এটা একটা মহান দায়িত্ব। এই দায়িত্ববোধ নিয়ে ইসলামের দাওয়াত মানুষের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন। নিজের জনপ্রিয়তা অর্জন কিংবা অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে এটাকে গড়ে তুলবেন না। বরং এর দ্বারা সুমহান লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি, পরকালের সফলতা, সর্বোপরি আলেম হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ গ্রহণ করবেন। - সময়ের আলো ।