কর্ণফুলীর তীরে আরেক শহর আনোয়ারা, বাড়ছে দেশী বিদেশী বিনিয়োগ

কর্ণফুলীর তীরে আরেক শহর আনোয়ারা, বাড়ছে দেশী বিদেশী বিনিয়োগ
কর্ণফুলীর তীরে আরেক শহর আনোয়ারা, বাড়ছে দেশী বিদেশী বিনিয়োগ

এনামুল হক নাবিদ, আনোয়ারা ।। 

কর্ণফুলী নদীর বুক চিরে উত্তর পাড়ে চট্টগ্রাম শহর আর দক্ষিণ পাড়ে আনোয়ারা উপজেলা। শহর এলাকায় বাণিজ্যিক জোন গড়ে তোলার সুযোগ সুবিধা আর তেমন নেই। এ কারণে দক্ষিণ পাড়কে ঘিরে এখন শিল্প জোনের নানা পরিকল্পনা। ইতিমধ্যে এই উপজেলায় হচ্ছে দেশী বিদেশী বিনিয়োগ।

উপমহাদেশের প্রথম টানেল নির্মিত হয়েছে অর্থনীতির শহর বন্দর নগরী চট্টগ্রামে। যার সংযোগ পথের এক প্রান্ত হচ্ছে শিল্প জোন হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রবেশ পথ আনোয়ারা উপজেলা। বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের ফলে পাল্টে যাচ্ছে আনোয়ারা, কর্ণফুলী ও পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের জনপথের চিত্র। বিশেষ করে পরিবর্তনের ছোঁয়াই বদলে যাবে আনোয়ারার অর্থনীতির দৃশ্যপট। ইতিমধ্যে পরিবর্তন হচ্ছে এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আর্থসামাজিক অবস্থান। সাধারণ মানুষ টানেল নিয়ে দেখছে নতুন দিনের স্বপ্ন। টানেল নির্মাণে আর্থসামাজিক উন্নয়ন বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন অর্থনীতিবিদ, আনোয়ারার দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিরা।

বঙ্গবন্ধু টানেলে বদলে যাচ্ছে আনোয়ারা

প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম এই মেগা প্রকল্প বহুল প্রত্যাশিত বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন হতে যচ্ছে আগামী ২৮ অক্টোবর। গত ১৪ আগস্ট সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য নিশ্চিত করেন।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের সমীক্ষা অনুযায়ি, বছরে প্রায় ৭০ লক্ষাধিক ছোট বড় যানবাহন চলাচল করবে কর্ণফুলী টানেলের ভেতর দিয়ে। এই বিশাল অংকের গাড়ির চাপ সামাল দিতে ৩৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে পিএবি (পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী) সড়কের শিকলবাহা ওয়াই জংশন থেকে আনোয়ারার কালাবিবির দিঘি চত্বর পর্যন্ত ৮.১০ কিলোমিটার ১৮ ফুট প্রস্থের  এই  সড়কটিকেও উন্নীত করা হচ্ছে ছয় লেনে। যার প্রস্থ হয়েছে ১৬০ ফুট। ১৬০ ফুটের ছয় লেনের মধ্যে ১২০ ফুটে হবে চারটি লেন, যা দিয়ে চলবে বড় বড় যানবাহন আর বাকি ৪০ ফুটে হবে দু’টি লেন যা দিয়ে চলবে স্থানীয় ছোট যানগুলো।

এদিকে দেখা যাচ্ছে  সিইউএফএল, কাফকো, ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানি, কেইপিজেড, চায়না  ইকোনমিক জোন, পারকি সৈকত, আধুনিক পর্যটন কমপেক্স নির্মাণ ও বঙ্গবন্ধু টানেলকে ঘিরে এই যেন  নগর পাড়ের আরেক শহরে রূপ নিচ্ছে আনোয়ারা । তাছাড়া কর্ণফুলী টানেল কে ঘিরে কর্ণফুলী ক্রসিং থেকে আনোয়ারা কালাবিবির দীঘির মোড় পর্যন্ত পিএবি সড়কের  চার লেনের সড়কের কাজও শেষ পর্যায়ে। ইতিমধ্যেই কর্ণফুলী টানেলের আশপাশের এলাকায়  দেখা দিয়েছে পরিবর্তনের হাওয়া। স্থানীয়রাও দেখছে নতুন দিনের স্বপ্ন। টানেল উদ্বোধন হলে নতুন করে সৃষ্টি হবে আর্থসামাজিক অবস্থান।

বলা হচ্ছে টানেলকে ঘিরে চীনের সাংহাই সিটির আদলে চট্টগ্রাম শহর ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ মডেলের রূপ পাবে। টানেলকে ঘিরে পশ্চিম পটিয়া এবং আনোয়ারা পরিণত হবে উপশহরে। টানেলের জন্য করা নতুন সড়কের পাশে আনোয়ারা ও পটিয়া এলাকায় নতুন নতুন শিল্প জোন করারও চিন্তা করছেন বিভিন্ন শিল্প মালিকরা।

এ দিকে টানেল নির্মাণের ফলে স্থবির হওয়া চায়না ইকোনমিক জোনের কাজ নতুন করে  শুরু করেছে সরকার। চায়না হারবার ইঞ্ছিনিয়ারিং সাথে চুক্তি বাতিল করে নতুন করে চুক্তি করেছে চায়নার নতুন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান রোড অ্যান্ড ব্রিজ করপোরেশনের সাথে। যেখানে ৭৮৩ একর জমির উপর হবে চাইনিজ অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন।বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এর মধ্যে যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে গত ২০ জুলাই বেজার একটি টিমসহ বেজা চেয়ারম্যান শেখ ইউছুফ হারুন চায়না ইকোনমিক জোন পরিদর্শনে করে যান। এসময় দ্রুত তিনি মাস্টার প্লান জমা দিতে বলেন।

আনোয়ারা শুধু উপশহর নয় পরিণত হবে একটি আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক বাজারে

কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে বহুল প্রত্যাশিত ও স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ এখন দৃশ্যমান। টানেলের মাধ্যমে কর্ণফুলীর দুইপাড় সংযুক্ত হচ্ছে। এ পাড়ের আনোয়ারা পয়েন্টের টানেলের টিউবের মুখ বের হয়েছে পারকি সিইউএফএল এলাকায়। চট্টগ্রাম শহর থেকে পারকি সৈকতের দীর্ঘ ৩৫ কিলোমিটার হলেও টানেলের আনোয়ারা পয়েন্ট থেকে পারকির দূরত্ব হবে মাত্র আট কিলোমিটার। টানেল ব্যবহার করে সহজে পর্যটকরা ১৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারবেন পারকি সমুদ্রসৈকতে। এর মধ্যে পারকি সৈকত পর্যটন কর্পোরেশনের অর্থায়নে ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে পর্যটন কমপেক্স।

চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড হয়ে টানেলের ভেতর দিয়ে যানবাহন উঠবে কক্সবাজার মহাসড়কে। এ লক্ষ্যে প্রস্তত হচ্ছে আনোয়ারা থেকে শিকলবাহা পর্যন্ত  প্রায় ১১ কিলোমিটার চার লেনের সড়ক। ফলে আনোয়ারার সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ হবে। টানেল ঘিরে শিল্পকারখানা ও আবাসনের পাশাপাশি খুলবে পর্যটন শিল্পের নতুন দুয়ার। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণে মুখর হবে পারকি। হবে কর্মসংস্থান, বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। ফলে পর্যটন খাত থেকে সরকারের আয় বাড়বে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এমনটাই মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

টানেল নির্মাণে আনোয়ারার আর্থসামাজিক অবস্থান কেমন হবে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ডঃ আলাউদ্দিন বলেন, আনোয়ারা এমনিতে ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ন এলাকা। একদিকে কর্ণফুলী নদী অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর।  ভৌগলিকভাবে এটি অর্থনীতির নাভি হিসেবে কাজ করবে। টানেলের সুবিধা নিয়ে আনোয়ারা অনেক শিল্পায়ন হবে। এর ফলে সেখানকার অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতি আসবে যা আশার বাইরে। স্থানীয় মানুষজনের চাকুরি ও ব্যাবসা বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাছাড়া চট্টগ্রাম শহরের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে অত্র অঞ্চলের মানুষ ব্যাপক সুবিধা ভোগ করবে। টানেলের ফলে যোগাযোগ সহজতর হওয়ায় আনোয়ারা অঞ্চলে ব্যবসা করার খরচ  হ্রাস পাবে। কাঁচামাল ও পণ্য পরিবহন আরামদায়ক হবে। এতে করে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ব্যপকভাবে আকৃষ্ট হবে।  এছাড়াও সামনে আরো যা মাষ্টার প্লান আছে  তা বাস্তবায়ন হলে আনোয়ারা হবে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার বিনিয়োগের  আঞ্চলিক বাজার।

এদিকে কেইপিজেড, কাফকো ও সিইউএফএলকে কেন্দ্র করে বন্দর সেন্টার এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য অভিজাত রেস্টুরেন্ট আধুনিক হোটেল-মোটেল।  বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ বাস্তবায়ন হওয়ায় এর মধ্যে  চায়না ইকোনেমিক জোন ফের ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে। এভাবে বিনিয়োাগটা অনেক বেশি দ্রুত গতিতে বাড়বে। চলমান পিএবি সড়কের চার লাইনের কাজ সম্পূর্ণ হলে পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের চিত্র পাল্টে যাবে। তদ্রূপ পুরো অর্থনীতির বাজারটাই হবে তখন আনোয়ারা। টানেলের ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। টানেলের পাশ্ববর্তী অঞ্চলে শিল্পের প্রসার ঘটায় রপ্তানিযোগ্য পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন বাড়বে। আবার টানেলের ফলে বন্দরের কার্যক্রমে গতি আসবে যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে তরান্বিত করবে।

টানেল নির্মাণ ও আনোয়ারার সার্বিক উন্নয়নে নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক চৌধুরী বলেন, আওয়ামীলীগ সরকার বরাবরাই উন্নযন বান্ধব সরকার। আর আনোয়ারার অভিভাবক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী একজন সৃজনশীল নেতা। যার নেতৃত্বের ছোঁয়া আনোয়ারাকে বদলে দিয়েছে।

তিনি আরো বলেন, উনি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আনোয়ারাকে নিয়ে একটি মাষ্টারপ্ল্যান গ্রহণ করেন। এটি বাস্তবায়িত হলে আনোয়ারাকে যাতে বিশ্ব বাজারের স্পট বানানো যায় তার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী মহোদয় বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যায়। যার ফল স্বরূপ আনোয়ারায় সিইউএফএল কাফকো, ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানি, কেইপিজেড, চায়না ইকোনমিক জোন সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ বাস্তবায়ন ও আধুনিক পর্যটন কমপ্লেক্স  ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প হাতে রয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আনোয়ারা শুধু উপশহর নয় একটি আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক বাজারে পরিণত হবে।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;