করোনার প্রতিষেধক নিয়ে একচেটিয়া ওষুধ সংস্থাগুলির লোভের বলি হতে চলেছেন সাধারণ মানুষ

করোনার প্রতিষেধক নিয়ে একচেটিয়া ওষুধ সংস্থাগুলির লোভের বলি হতে চলেছেন সাধারণ মানুষ
কভার ছবি: রোলিং স্টোন   

পোস্টকার্ড ডেস্ক ।।

দুনিয়া জুড়ে ওষুধ ও প্রতিষেধকের গবেষণা, উৎপাদন, বণ্টন ও মূল্য নির্ধারণ করে ওষুধ শিল্পের একচেটিয়া পুঁজিপতিরা । এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো সংস্থাগুলি হল, জনসন অ্যান্ড জনসন(আমেরিকা), রোশে (সুইজারল্যান্ড), সিনোফার্ম (চিন), ফাইজার (আমেরিকা), বেয়ার (জার্মানি), নোভার্টিস (সুইজারল্যান্ড), মের্ক অ্যান্ড কোং (আমেরিকা), গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন (ব্রিটেন), স্যানোফি(ফ্রান্স) ও অ্যাবভি(আমেরিকা)। এই সংস্থাগুলি ২০১৯ সালে সম্মিলিত ভাবে ৫১.২০০ কোটি ডলার উপার্জন করেছিল(ঠিকই পড়ছেন!)।

এই সংস্থাগুলি কোভিড ১৯-এর প্রতিষেধক তৈরির জন্য পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তা কোনো মানবিক কারণে নয়, বরং বাজারের বেশিটা কবজা করে বিপুল মুনাফা করার জন্য। অতিমারির প্রথম তিন মাসেই ফাইজার ২০০ কোটি ডলার আয় করেছে। গত বছরে এই সময়ে তারা ১৬০০ কোটি ডলার আয় করেছিল। অন্যদিকে জনসন অ্যান্ড জনসন এই সময়কালে গত বছরের তুলনায় বাড়তি ৫০০কোটি ডলার আয় করতে চলেছে।

এই মুহূর্তে দুনিয়ায় অনেকগুলি প্রতিষেধক নিয়ে কাজ চলছে তবে তার মধ্যে ২৫টি ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার স্তরে পৌঁছেছে। আর তাদের মধ্যে পাঁচটি পরীক্ষার তৃতীয় বা শেষ ধাপে রয়েছে। এগুলি হল, ফাইজার- যার কাজ চলছে জার্মানির বায়োএনটেক-এ, মডার্না(আমেরিকা), অক্সফোর্ডের হয়ে গবেষণা চালাচ্ছে অ্যাস্ট্রোজেনেকা, চিনের সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম, স্যানোফি ও গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন। এছাড়া জনসন অ্যান্ড জনসনের প্রতিষেধক প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে রয়েছে। তাদের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু হবে সেপ্টেম্বরে। এসবের মধ্যে রাশিয়া প্রতিষেধক তৈরির কথা ঘোষণা করে দেওয়ায় পরিস্থিতিতে কিছুটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তাদের ভ্যাকসিনেরও এখনও তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল বাকি।

এই সংস্থাগুলি আলাদা আলাদা ভাবে প্রতিষেধক নিয়ে কাজ করছে এবং নিজেদের গবেষণার ফলাফল পরস্পরের থেকে যতটা সম্ভব গোপন রাখছে। ভ্যাকসিন তৈরির পথে তারা ঠিক কতটা এগিয়েছে,  তাদের প্রেস বিবৃতিগুলি থেকে সেই সত্য জানা যাবে না। পুঁজিবাদী বাজারে যেভাবে সকল পুঁজিপতিরা স্টক মার্কেটে সংস্থার শেয়ারের দাম বাড়ানোর জন্য যেভাবে পণ্যের মূল্যকে বাড়িয়ে দেখানোর চেষ্টা করে, এটাও ঠিক তাই।

এই শিল্পের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২১ সালের শেষের দিকে ভ্যাকসিন বাজারে মিলবে, তাও সেটা বড়োজোর বিশেষ বা আপদকালীন পরিস্থিতিতে ব্যবহারের অনুমতি মিলতে পারে। অতীতে টানা পাঁচ-সাত বছরের গবেষণার পরই কোনো প্রতিষেধক অনুমোদন পেয়েছে।

যেসব প্রতিষেধকগুলি নিয়ে গবেষণা চলছে, সেগুলির নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতার পরীক্ষা চলছে। অক্সফোর্ডের প্রতিষেধকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে শরীরে ব্যথা, অস্থিরতা ও জ্বরের খবর পাওয়া গেছে। মডার্নার ভ্যাকসিনেও একই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মিলেছে। এই পাঁচটি ভ্যাকসিনের কোনোটিরই এই বছরের শেষে অনুমোদন পেয়ে যাওয়ার কথা নয়।

তা সত্ত্বেও, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো তাড়াহুড়ো করে ভ্যাকসিনের বরাত দিয়ে দিচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সরকারগুলি ইতিমধ্যেই এইসব সংস্থাগুলিকে ২৫ কোটি ভ্যাকসিন সরবরাহের বরাত দিয়ে দিয়েছে। অথচ ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণাই শেষ হয়নি।তার মধ্যে ব্রিটেন গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন ও স্যানোফির সঙ্গে ৬ কোটি প্রতিষেধক ডোজ কেনার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। তার আগেই অবশ্য তারা অক্সফোর্ড/অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে ১০ কোটি ডেজের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে রয়েছে।

অন্যদিকে আমেরিকা ফাইজার এবং বায়োএনটেকের সঙ্গে ১৮০ কোটি ডলারের বিনিময়ে ৬কোটি ডোজ প্রতিষেধক কেনার জন্য চুক্তি করেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং জাপানও এই সংস্থাগুলির সঙ্গে চুক্তি করে রেখেছে।

চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার পরিস্থিতিতে ইতিমধ্যেই ১০০ কোটিরও বেশি ডোজের কেনা বেচা বা চুক্তি সম্পন্ন হয়ে গেছে, ভ্যাকসিন তৈরি হওয়ার আগেই।এর অর্থ হল, বাকি দেশগুলিকে প্রতিষেধকের জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করতে হবে অথবা বড়ো ওষুধ সংস্থাগুলি কবে আরও বেশি পরিমাণে উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেয়, তার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হবে। যদি গোটা বিশ্বের জনগণকে প্রতিষেধক দিতে হয়, তাহলে এই সংস্থাগুলিকে ২ ডোজের প্রতিষেধকের ক্ষেত্রে ১৪০০ কোটি ডোজ উৎপাদন করতে হবে। সেটা প্রচুর সময়ে ব্যাপার। কারণ হিসেব মতো ২০২২ সালের প্রথম ত্রৈমাসিক নাগাদ ভ্যাকসিনের ১০০ কোটি ডোজ তৈরি হওয়া সম্ভব।

সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে এই তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে কোভ্যাক্স অ্যালায়েন্সের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দেশগুলিকে আদৌ স্বচ্ছ ভাবে প্রতিষেধক বণ্টন করা যাবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ওই জোটে রয়েছে বিশ্বা স্বাস্থ্য সংস্থা, কোয়ালিশন অফ এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস এবং ১৪৫টি গরিব দেশ। এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন ধনকুবের বিল গেটস। একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে গরিব দেশগুলিতে ভ্যাকসিনের ব্যবসাটা তিনিই করে থাকেন।

ভারতে বায়োটেক সংস্থা কোভ্যাক্স বলে যে ভ্যাকসিনটি নিয়ে কাজ করছে বলে মাঝেমধ্যেই প্রচারিত হচ্ছে, তা এই আন্তর্জাতি্ক প্রকল্পেরই অঙ্গ। প্রকৃতপক্ষে এই মুহূর্তে ভ্যাকসিন গবেষণার যা পরিস্থিতি, তাতে দ্রুত ভ্যাকসিন দেওয়ার য়ে কথা নেতারা বলছেন, তা হল তৃতীয় বা শেষ ধাপের ট্রায়ালটি জনগণের ওপর, তাদেরই পয়সায় করার পরিকল্পনা। বড়ো রকমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে যাতে কোনো বিপর্যয় না হয়ে যায়, সেটুকুই দেখা নেওয়া হচ্ছে (রাশিয়াও তাই করেছে,কিন্তু হু-র বানিয়ে দেওয়া ছক না মেনে আগে ভাগে জানিয়ে দিয়েছে বাজার ধরতে, তাই অন্যদের রাগ)। এত কম সময়ে যে দীর্ঘ মেয়াদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জানা অসম্ভব, তা আমরা সকলেই বুঝি। ভ্যাকসিনে অ্যান্টিবডি শরীরে তৈরি হলেও, তা কতদিন কার্যকর থাকছে কিংবা বিভিন্ন রোগে অসুস্থ মানুষের শরীরে সুস্থদের সমান ফল দিচ্ছে কিনা, তাও বোঝা সম্ভব না এত কম সময়ে।

তাই তৃতীয় পর্য়ায়ের ট্রায়ালের ভ্যাকসিনটা আমাদের দিয়ে রাষ্ট্রনেতারা জনসেবার মসিহা হয়ে উঠতে চাইবেন। বরাবরের মতো সাম্রাজ্যবাদীদের মুনাফার ঘুঁটি হয়ে ভ্যাকসিন নেবো আমরা। মুনাফার জন্য ভ্যাকসিন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সময়টুকু ব্যয় করা ওষুধ সংস্থাগুলির পক্ষে অসম্ভব। কারণ ততোদিনে দুনিয়া শুদ্ধ মানুষের হার্ড ইমিউনিটি হয়ে যাবে। ভ্যাকসিনের প্রয়োজনই হবে না। বস্তুত, আধসেদ্ধ ভ্যাকসিন আমরা নিই বা না নিই, হার্ড ইমিউনিটি ছাড়া করোনায় গতি নেই। বড়োজোর ওই প্রতিষেধকে কয়েকমাস কাজ হতে পারে। ওষুধ সংস্থাগুলির স্বার্থ লুকিয়ে রাখার জন্যই এই সত্যকে গোপন করা হচ্ছে।

সূত্র. পিপলস