করোনার ঘোর টোপে ঘেরা জীবন - কামরুন নাহার পারভীন

করোনার ঘোর টোপে ঘেরা জীবন - কামরুন নাহার পারভীন

শহরের প্রানকেন্দ্রে একটি বস্তিতে বসবাস করে শরীফা ( ছদ্দনাম)। ছেলেমেয়ে স্বামী সন্তান নিয়ে বেশ সুখের সংসার তার। শরীফা কয়েকটি বাড়ীতে ছুটা বুয়ার কাজ করে। পরিষ্কার পরিছন্ন, গোছালো। স্বামী, সন্তান বা অভাব নিয়ে তার কোনদিন কোন অভিযোগ ছিলোনা। মার্চ,২০২০ এ সে জানতে পারলো কোন একটা সমস্যা ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশে।

এই সমস্যার প্রতিকার হচ্ছে ঘরে থাকা। পরিষ্কার থাকা।তার অনুপস্থিতিতে তার ছেলেমেয়েরা শত নিষেধ থাকা সত্বেও সারা বস্তি দাপিয়ে বেড়ায়। সেতার কর্মস্থলে জানান দিলো তার স্বামী ছেলেমেয়ে ও পরিবারের সুরক্ষার খাতিরে ঘর থেকে বের হতে বারণ করেছে। মাসের শেষ মোটামোটি সব বাসায় তাকে তার বেতন যৎসামান্য সহযোগিতা করে আপাতত আসতে বারণ করেছে।

সে ভয়ে ছিল এই নিষেধাজ্ঞা একবারের জন্য নাতো ? মোটামোটি সবাই আস্বস্ত করলো সেনা আসলেও মাস শেষে তার টাকাটা সে পেয়ে যাবে।

শরীফার উপার্জনটা ছিল তার সংসারের জন্য বাড়তি উপার্জন। ছেলেমেয়ের পড়ালেখা আর কিছুটা স্বাছন্দের জন্য মূলত সে কাজ করে। সংসারটা তার স্বামীর উপার্জনেই চলে।

রাজমিস্ত্রির কাজ করা স্বামীর উপার্জন মার্চ মাসের শেষদিক থেকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। সে যা পেয়েছে তাতে ৮/১০ দিন চলে যায়। টিভিতে দেখছে, সবা্র থেকে শুনছে সরকার গরীবদের জন্য অনেক কিছু দিচ্ছে।

আশায় বুক বেঁধে থাকে। পয়সাওয়ালারা দিচ্ছে, কাউন্সিলর দিচ্ছে, পুলিশও নাকি দিচ্ছে। দিন যায়, রাত যায় কেউ কোনদিন জিজ্ঞেসও করলোনা তারা কেমনে চলছে? তাদের পার্শ্ববর্তী কলোনীর লোকটা স্থানীয়। কাউন্সিলরথেকে / বা নিজে থেকে ত্রান এনে তার ভাড়াটিয়াদের সহায়তা করেছে। শরীফাদের বাড়ীওয়ালার কাছে কয়েক জন মিলে যায়। বাড়ীওয়ালা বলে, তোমাদের চাইতে আমার অবস্থা খারাপ। আমি কোথা থেকে সাহায্য দিবো ? তোমরা বরং আমার ঘর ভাড়ার টাকাটা দিয়ে দাও। আমার চলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। ক্লান্ত বিধস্ত শরীফারা জানেনা তাদের দিন কেমনে চলবে।

সে যেখানে কাজ করে সেখান থেকে সহায়তা নিয়ে হয়ত তার কোনমতে ১০/১২ দিন চলবে কিন্ত এরপর। অন্য পরিবার তারা কিভাবে চলবে। এরমধ্যে সে জেনেছে অনেককে বাসাবাড়ীতে যেতে মানা করে দিয়েছে। বেতন কেটে রেখেছে। দিনমজুর যারা আছে তারাতো একপ্রকার নাখেয়েই আছে। ঘরে ঘরে ঝগড়া, মারামারি বেড়ে গিয়েছে। টিভি বা মানুষের কথার সাথে সে বাস্তবতার মিল খুজে পায়না। শরীফা জানেনা পুলিশ থেকে সে কিভাবে সহায়তা চাইবে, সরকার থেকে কিভাবে চাইবে। রমজান শুরু হয়েছে। কোথায় ভালোমন্দ খাবে সেহেরী বা ইফতারে পেটভরে খাওয়াও জুটেনা।

কিভাবে চলবে পুরা মাস? বাসাবাড়ীতে গেলে ইফতার, সেহেরীর জন্য তৈরী করা খাবারসহ অনেক কিছু পেত। এখনতো কিছু পাওয়ার আশা করাই বৃথা।

উপরের ঘটনাটি পুরো বাংলাদেশের একটুকরো চিত্র।

মার্চ থেকে শুরু হওয়া করোনা ঝড় সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশকেও আষ্টেপৃষ্টে চেপে ধরেছে। দৈনিক উপার্জনকারী মানুষদের অধিকাংশ না খেয়ে আছে। ভিক্ষার জন্য বের হবে তারও কোন উপায় নেই। সরকার হাজার কোটি টাকা প্রনোদনা দিচ্ছে। ব্যক্তি থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসনের নানা উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারপরও একটা বিশাল অংশ অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে।

লকডাউন শুরু হওয়ার আগে যে ভিক্ষুকগুলো ছিলো তারা অনেক বছর আগ থেকেই বিভিন্ন স্পটে ভিক্ষা করতো। কিন্ত বর্তমানে দেখা যাচ্ছে অনেক ভিক্ষুক বিশেষ করে বয়স্কনারী ও পুরুষ এবং কিশোর কিশোরীরা । তারা যত্রতত্র হাত পাতছে।

করোনা আমুল বদলে দেওয়া পৃথিবীর মানুষকে চরমভাবে অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে। বিশ্বের পরাক্রমশালী দেশ যাদের স্বাস্থ্যসেবার মান অত্যন্ত উন্নত, যেখানকার অধিবাসীরা বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত তারাও আজ চরমভাবে বিপদগ্রস্থ।

সারা বিশ্বে লক্ষ লক্ষ মানুষ চাকুরী হারাচ্ছে। আমাদের দেশ এমনিতেই বেকারের সংখ্যা অনেক বেশী। যদিওবা আমরা কাগজে কলমে উন্নয়নের জাতি হিসেবে নিজেদের গর্বভরে দাবী করি । স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় নানা প্রশ্ন ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনস্বার্থরক্ষা তথা এ দেশের মেহনতি মানুষের ক্ষুধা নিবারণের জন্য অনেক যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্ত যাদের জন্য বরাদ্দ সেখানে আসার আগে বিলি বন্টনে দলীয়করণ, এলাকার ভোটার কিনা তা যাচাই করা, জাতীয়তা সনদ থাকার বাধ্যবাধকতা বিষয়ে হাস্যকর কিছু যুক্তি দরিদ্র মানুষকে চরমভাবে বঞ্চিত করছে।

ত্রান আত্নসাতের কথা পূর্বপ্রজন্ম থেকে শুনে আসছি। এই চরম মহামারীতেও এই আত্নসাৎকারীরা আরো ন্যাক্কারজনকভাবে তাদের নোংরা হাত প্রসারিত করে রেখেছে। মানুষের পেটে ভাত নাই কিন্তু সরকারী স্বল্পমূল্যের চালে পুকুর ভরাট হয়, গোডাউনে/ঘরে চাল আর তেলের খনি পাওয়া যাচ্ছে। নদীতে ভাসছে সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত তেলের খালি বোতল? এইসব নোংরা খেলার কারণে নিতান্ত দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত শ্রেনী তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এই ধরণের অবস্থা চলতে থাকলে খাদ্যের জন্য লুটতরাজ, খুনোখুনি শুরু হতে খুব বেশী দেরী নেই। সুষ্ঠ ত্রান বন্টনে ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জেলা ভিত্তিক সরকারী উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়ে স্ব স্ব কর্মস্থলে প্রেরণ করেছে। রেশন ব্যবস্থা, মধ্যবিত্তের জন্য প্রনোদনাসহ নানাবিধ উদ্যোগের মাধ্যমে জনগণকে করোনাকে জয় করার সর্বাত্নক সহায়তা করা হচ্ছে। হয়তো সময় বলে দেবে চুইয়েপড়া নীতির কারণে হাজারো শরীফাদের নিবুনিবু চুলাটা আবারো গনগনিয়ে জ্বলে উঠবে কিনা? কপালের ঘাম মুছে ক্লান্ত দেহে মুখে একরাশ হাসি নিয়ে শরীফা তার ৪ বছরের শিশুসন্তানকে ডেকে বলবে আয় বাবা তোকে গরম গরম দুটো ভাত খাইয়ে দিই।

লেখক - সমাজকর্মী ।