জান্নাতে প্রবেশকারীদের জন্য আল্লাহ জান্নাতে বিচিত্র প্রকার নদ-নদী ও ঝরনাধারা প্রস্তুত করে রেখেছেন

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন ।।

জান্নাতে প্রবেশকারীদের জন্য আল্লাহ জান্নাতে বিচিত্র প্রকার নদ-নদী ও ঝরনাধারা প্রস্তুত করে রেখেছেন

জান্নাতে যেসব সৌভাগ্যবান মানুষ যাবেন আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য জান্নাতে বিচিত্র প্রকার হ্রদ, নদী, ফোয়ারা, প্রস্রবণ ও নির্ঝর ধারা প্রস্তুত করে রেখেছেন। দুনিয়ার কোনো নদী ও ঝরনার সঙ্গে এগুলোর তুলনা হয় না। আকার, আয়তন, স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে রাসুল! যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, আপনি তাদের এমন জান্নাতের সুসংবাদ দিন, যার পাদদেশে নির্ঝর ধারা প্রবহমান থাকবে।’ (সুরা বাকারা : ২৫)
জান্নাতে চারটি বড় সমুদ্র থাকবে। একটি পানির, দ্বিতীয়টি মধুর, তৃতীয়টি দুধের আর চতুর্থটি শরাবের। এখান থেকে আরও অসংখ্য ছোট ছোট নদী প্রবাহিত থাকবে। জান্নাতের প্রতিটি প্রাসাদের সঙ্গে এ চার নদীর সংযোগ থাকবে। জান্নাতের সমুদ্রগুলো কস্তুরির পাহাড় ও আদন থেকে উৎসারিত হয়ে গর্তের মতো বিশাল বিস্তৃত নিচু স্থানে জমা হয়। ওখান থেকে সমুদ্র ও নদীর আকারে প্রবাহিত হতে থাকে। দুনিয়ায় যারা মদ পান করে তারা জান্নাতের শরাব থেকে বঞ্চিত থাকবে। পানি, মধু, দুধ ও শরাব কখনও বিস্বাদ বা বিবর্ণ হবে না। (ইবনে হিব্বান : ১০/২৪৯; তিরমিজি : ২৫৭১; কানযুল উম্মাল : ৩১৮৪৬, ৩৯২৩৯; ইবনে আবি শায়বা : ১৫৯৩৮; তাফসির ইবন কাসির : ৪/১৭৬)
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে হাজির হওয়ার ভয় রাখে, তার জন্য রয়েছে দুটি উদ্যান। উভয় উদ্যানই ঘন শাখা-পল্লববিশিষ্ট। উভয় উদ্যানে আছে বহমান দুটি ঝরনা।’ (সুরা আর-রাহমান : ৪৬-৫০)। উত্তাল ও প্রবাহ মুহূর্তের জন্য থেমে থাকবে না। দুই নদীর তীরে অবসর ও বিশ্রামের জন্য থাকবে সারি সারি তাঁবু, আনন্দোপকরণ ও সেবক-সেবিকা।
জান্নাতের একটি বিশেষায়িত নদীর নাম ‘কাউসার’। এটা অফুরন্ত কল্যাণ ও বরকতের আধার। প্রায় ৫০ জন সাহাবি ‘কাউসার’-এর বর্ণনা দিয়েছেন। হজরত মুহাম্মদকে (সা.) আল্লাহ তায়ালা এটা বিশেষভাবে দান করেন। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন আমরা মদিনার মসজিদে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাক্ষাতে উপস্থিত হলাম। হঠাৎ তার মধ্যে তন্দ্রা অথবা অচেতনতার ভাব দেখা দিল। অতঃপর হাসিমুখে মাথা উঁচু করলেন। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার হাসির কারণ কী? তিনি বলেন, এ মুহূর্তে আমার ওপর একটি সুরা অবতীর্ণ হয়েছে। অতঃপর তিনি বিসমিল্লাহসহ সুরা কাউসার পাঠ করেন এবং বলেন, ‘কাউসার’ কী তোমরা জানো? আমরা বললাম, আল্লাহ তায়ালা ও তার রাসুল ভালো জানেন। তিনি বলেন, এটা জান্নাতের একটি নদী। আমার পালনকর্তা ওটা আমাকে দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন। এতে রয়েছে অজস্র কল্যাণ। এই নদী থেকে কেয়ামতের দিন আমার উম্মত পানি পান করতে যাবে। এর পানি পান করার পাত্র আকাশের তারকাপুঞ্জের মতো হবে। পানপাত্রগুলো স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত। যারা একবার এই নদীর পানি পান করবে তারা কোনোদিন পিপাসার্ত হবে না। তখন কতিপয় লোককে ফেরেশতাগণ পানি পান করতে বাধা দেবে এবং হটিয়ে দেবে। আমি বলব, হে পরওয়ারদেগার! এরা তো আমার উম্মত। আল্লাহ তায়ালা বলবেন, আপনি জানেন না, দুনিয়া থেকে আপনার বিদায়ের পর এরা কী কী বিদআত শুরু করেছিল। তখন আমি বলব, দূর হও দূর হও, আমার পরে দ্বীনে যারা পরিবর্তন এনেছিলে। (সুরা কাউসার : ১; মাআরিফুল কোরআন : পৃ. ১৪৭৮; তাফসিরে সাবি : ৪/৪৮৫, ৪৮৬)
মহানবী (সা.) বলেন, মিরাজ রজনীতে আমি যখন জান্নাতে গিয়েছি আমি একটি নদীর ধারে পৌঁছলাম, যার উভয় তীরে শূন্যগর্ভ মুক্তার তৈরি গম্বুজ রয়েছে। নদীর দুই তীর খাঁটি সোনায় মোড়া। আমি পানিতে হাত ঢুকিয়ে দেখলাম, খাঁটি মিশকের মতো সুগন্ধিযুক্ত। আমি বললাম, হে জিবরাঈল! এটা কী? তিনি বললেন, এটা হাওজে কাওসার; আল্লাহ তায়ালা আপনাকে দান করেছেন। পানির বর্ণ দুধের চেয়ে সাদা; মধুর চেতে মিষ্ট। বরফের চেয়েও শীতল। লম্বা গলাসম্পন্ন পাখিরা এর ওপর উড়তে থাকবে। হজরত ওমর (রা.) এ কথা শুনে বলেন, এসব পাখি কি হালকা ও কোমল হবে? মহানবী (সা.) বলেন, এদের মাংস আরও বেশি কোমল ও উপাদেয় হবে। হাওজে কাউসারের তলায় থাকবে নীকান্তমণি ও গোমেদ পাথর। ইয়ামেন থেকে জর্দান যতদূর, কাউসারের আয়তন তার চেয়েও বড়। প্রখ্যাত মুফাসসির হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হাওজে কাউসারের গভীরতা ৭০ হাজার ফারসাখ, অর্থাৎ ৫ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার। (বুখারি : ৪৫৯৫; তিরমিজি : ৩৩৬১; তাফসিরে মাজহারি :১২/৫৪৯-৫৫০; তাফসিরে সাবি : ৪/৪৮৫; সুয়ুতি, বুদুরুস সাফিরাহ : ১৯১৬)
জান্নাতে আরও কিছু নদী ও ঝরনাধারা রয়েছে। সবগুলো আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতে ভরপুর। এগুলোর নাম হলো বেদখ, হারাওয়াল, বারিক, রাইয়ান, রাজাব, সালসাবিল, যানজিল, তাফজির, তাসনিম। এসব ঝরনাধারার উভয় পাড়ে পবিত্র কুমারীরা অপূর্ব সুরলহরিতে আল্লাহ তায়ালার হামদ-সানা ও প্রশংসাগীত পরিবেশন করতে থাকবে।
আল্লাহর পথে যারা শহীদ হয়েছেন, তারা বারিক ঝরনাধারার পাশে সবুজ বর্ণের গম্বুজে অবস্থান করবেন। সকাল-সন্ধ্যা বিশেষ খাবার তাদের পরিবেশন করা হবে। রাইয়ান নামক ঝরনাধারার কিনারে মারজান নামে একটি শহর গড়ে তোলা হয়েছে। স্বর্ণ ও রৌপ্যনির্মিত দরজার সংখ্যা ৭০ হাজার। কোরআনের হাফেজরা এখানে অবস্থান করবেন। (সুরা দাহার : ১৭-১৮; মুসনাদে আহমদ : ১/২৬৬, ৩/১৩৫; আবু নুআইম, সিফাতুল জান্নাহ : ৩/১৬৩; কানযুল উম্মাল : ১/৫৫০; বুদুরুস সাফিরাহ : ১৯৩২)

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গণি এমইএস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম ।