জল-জঙ্গল-কাদা মাটির মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা মেয়েদের গল্প

জল-জঙ্গল-কাদা মাটির মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা মেয়েদের গল্প
জল-জঙ্গল-কাদা মাটির মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা মেয়েদের গল্প

পোস্টকার্ড ক্রীড়া ডেস্ক ।।

দেশের মৃতপ্রায় স্বপ্নকে জাগিয়ে তুলেছেন সাফ মুকুটধারী বীরকন্যারা। জল-জঙ্গল-কাদা মাটির মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা মেয়েরা নিজেদের চিনিয়েছেন, একই সঙ্গে চিনিয়েছেন অবহেলায় পড়ে থাকা তাদের শৈশবের জায়গাগুলোকেও।

জাম্বুরা দিয়ে খেলতেন কৃষ্ণা

সময়ের আলোর টাঙ্গাইল প্রতিনিধি সুমন কুমার রায় তার প্রতিবেদনে লিখেছেন, কৃষ্ণা রানী সরকারের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে। তার বাবা বাসুদেব চন্দ্র দাস একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মা নমিতা রানী দাস একজন গৃহিণী।

কৃষ্ণার কাকা নিতাই চন্দ্র সরকার জানান, কৃষ্ণা ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলার প্রতি বেশি মনোযোগী ছিল। প্রাইমারিতে পড়ার সময় কৃষ্ণা গাছের ফল জাম্বুরা দিয়ে খেলাধুলা করত। তার আগ্রহ দেখে কৃষ্ণাকে একটি বল কিনে দেন তিনি।

সামাজিক বাধা প্রসঙ্গে বলেন, ছোটবেলায় যখন কৃষ্ণা বল নিয়ে মাঠে খেলাধুলা করত, তখন এলাকার কিছু কিছু মানুষ খুব একটা ভালো চোখে দেখতেন না। কিন্তু এখন তার এই সাফল্যে শুধু গোপালপুরবাসী নয়, গর্বিত পুরো দেশ।

কৃষ্ণার মা নমিতা রানী সরকার জানান, ছোটবেলায় কৃষ্ণা যখন ফুটবল নিয়ে ব্যস্ত থাকত, সে সময় অনেক বকাঝকা দিয়েছি। কৃষ্ণাকে খেলা থেকে দূরে রাখতে রাগ করে বল দা দিয়ে কেটে ফেলেন বলেও জানান তিনি।

একসময় দর্জির দোকান ছিল কৃষ্ণার বাবার বাসুদেব সরকারের। টাকার অভাবে অনেক আগেই দোকানটা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। বর্তমানে কৃষিকাজ করে দিনাতিপাত করছেন তিনি।

স্মার্টফোনের অভাবে ইতির সঙ্গে কথা বলতে পারেননি তার মা

মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার গোয়ালদহ গ্রামে ইতি রানীর বাড়ি। তার বাবা মনোজিৎ কুমার মণ্ডল। পেশায় ভ্যানচালক। পাশাপাশি ডেকোরেটরের দোকানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। কোনো জায়গা-জমি নেই।

মনোজিৎ কুমার বলেন, ‘ইতি যদি ফুটবল না খেলত, তালি ওর এতদিন বিয়ে হয়ে যেত। এখনকার মতো সাহস পালি (পেলে) অন্য মেয়েদের অত অল্প বয়সে বিয়ে দিতাম না।’

ইতির মা উন্নতি রানী মণ্ডল বলেন, ‘ফাইনাল খেলার দিন সারা দিন না খেয়ে ছিলাম। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার একদিন পরেও মেয়ের সঙ্গে কথা হয়নি। কারণ স্মার্টফোন নেই। তাতে এখন আর কোনো দুঃখ নেই, এখন এতটাই আনন্দ হচ্ছে যে কান্না চলে আসতেছে বারবার।’ গোয়ালদহ গ্রামের দুই মেয়ে সাথি বিশ্বাস (১৭) ও ইতি রানী মণ্ডল (১৬) চ্যাম্পিয়ন দলের গর্বিত সদস্য।

কলসিন্দুরের মেয়েরা পাল্টে দিয়েছে গ্রাম

ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী উপজেলা ধোবাউড়ার কলসিন্দুর গ্রামের আট ফুটবল খেলোয়াড় এখন জাতীয় দলে।

জাতীয় দলকে সগৌরবে প্রতিনিধিত্ব করা আট ফুটবলার হলেন-সানজিদা, মারিয়া, শিউলি আজিম, মারজিয়া আক্তার, শামসুন্নাহার, তহুরা, সাজেদা ও শামসুন্নাহার জুনিয়র।

কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী শীল বলেন, একদিকে সমাজের রক্ষণশীল সমাজ, অন্যদিকে অভাব-অনটন। আরও জানান, ‘২০১৪ সালে প্রথম জাতীয় দলে জায়গা পায় তাসলিমা ও মারজিয়া। এরপর বাকিরা জাতীয় দলে জায়গা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ধাপে ধাপে আট ফুটবলার জাতীয় দলে জায়গা করে নেয়। তারপর থেকেই বদলে যেতে থাকে গ্রামের চিত্র।’

সাফজয়ী ফুটবলার সানজিদার বাবা লিয়াকত আলী বলেন, ‘প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় সানজিদা ফুটবল খেলা শুরু করে। মেয়ে ফুটবল খেলবে, মানুষ কী মনে করবে, এই চিন্তা থেকেই আমাদের খুব একটা ইচ্ছা ছিল না যে সে ফুটবল খেলুক। স্কুলের মফিজ উদ্দিন স্যার জোর করেই সানজিদাকে ফুটবল খেলায় অংশ নেওয়ায়। আস্তে আস্তে আমার মেয়েসহ অন্য মেয়েরা খেলায় ভালো করতে থাকল। তখনই এলাকার মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আসতে থাকে।’

প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা পাননি রুপনা

শরীরে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে নানিয়ারচরে খেলতে যাওয়া পাহাড়ি সর্পিল পথের ভূঁইয়ো আদাম গ্রামের সেই ছোট্ট মেয়েটি আজকের মহাতারকা রুপনা চাকমা।
পরম মমতায় সাফে গোলবার আগলেছেন রুপনা। গর্বিত মা কালাসোনা চাকমা বলেন, শরীরে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে সে ২০১২ সালে নানিয়ারচর উপজেলা সদরে ফুটবল খেলা খেলতে গিয়েছিল মেয়ে। সেখানেই দেশের মুখ উজ্জ্বল করা এই মহাতারকাকে আবিষ্কার করেন বীরসেন চাকমা ও শান্তি মনি চাকমা। তাদের ছায়ায় সে কাউখালী উপজেলার ঘাগড়াতে যায়। সেখান থেকেই উন্নতির সূচনা ঘটতে থাকে।

রুপনার মা আক্ষেপ করে বলেন, ‘গতবার অনূর্ধ্ব ১৪ তে রুপনা ও তার দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। কিন্তু মেয়ের প্রতিভাকে টিকিয়ে রাখতে জেলা প্রশাসন, জেলা ক্রীড়া সংস্থা বা অন্য কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ এগিয়ে আসেনি। পাশে দাঁড়ায়নি কেউ। শুধু শান্তি মনি চাকমা, বীরসেন চাকমা ও আনসার ভিডিপি কোচ সুইলা মং মারমাই পাশে ছিলেন।

তোমার নাতিন তো মানুষ হয়ে গেছে

মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার গোয়ালদহ গ্রামে শিক্ষকদের উদ্যোগে প্রথম যে মেয়েদের নিয়ে ফুটবল চর্চা শুরু হয়, তাদের একজন সাথি বিশ্বাস। নাতনির অর্জন নিয়ে সাথির দাদা বৈকণ্ঠ কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের দরিদ্র পরিবার। মেয়েরা যখন ফুটবল খেলা শুরু করে, তখন এলাকার লোকজন বলত মেয়েদের তো নষ্ট করে ফেলতিছ। এখন তারাই বলে তোমার নাতিন তো মানুষ হয়ে গেছে।’

বাজারে একটা ছোট স্টুডিও সাথির বাবা বিদ্যুৎ কুমার বিশ্বাসের। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে এতদূর যাবে ভাবিনি।’ এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন সাথি বিশ্বাস। সাফে খেলতে যাওয়ার কারণে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি সাথি।

এ বিষয়ে তার মা সুদেবী বিশ্বাস বলেন, ‘পরীক্ষা দেবে না খেলতে যাবে, এটা ওর শিক্ষকদের ওপরে ছেড়ে দিয়েছিলাম। দেশের জন্য খেলে ও যে সম্মান এনেছে, এতে আমি খুবই খুশি।’

সাথি ও ইতি ফুটবল খেলা শুরু করেছিল গোয়ালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। সেখান থেকে বিকেএসপি হয়ে এখন খেলছেন জাতীয় দলে।

পিতৃহারা সাবিনার বড় ভরসা তার বড় বোন

সাবিনা খাতুন ও মাসুরা পারভীনের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলায়। শহরের সবুজবাগে সাবিনাদের বাড়ি। বাংলাদেশ অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের ডাক নাম ময়না।

সাবিনার মা মমতাজ বেগম বলেন, ‘ওর বাবা বেঁচে থাকলে কী যে খুশি হতো! সাবিনার বাবা মো. সৈয়দ আলী গাজী ২০২০ সালে মারা যান। পাঁচ বোনের বড় দুই বোন লেবাননে থাকতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর বড় বোন সালমা খাতুন দেশে থেকে গেছেন। সাবিনার পরিবারের দেখভাল করেন বড় বোন সালমা খাতুন।’

তিনি বলেন, ‘সারা দিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি জয়ে জন্য। যখন দেখলাম বাংলাদেশ ৩-১ গোলে জিতেছে, তখন মন ভরে গেল। স্বপ্ন সার্থক হয়েছে আমার বোনটার।’

মাসুরার বাবার থিতু হওয়ার লড়াই

রক্ষণভাগের অতন্দ্র প্রহরী মাসুরা পারভীন। বাবা রজব আলী মেয়েকে খেলতে দিতে চাইতেন না। স্থানীয় কোচ আকবর আলী ও মা ফাতেমা খাতুনের উৎসাহে খেলা চালিয়ে যান মাসুরা।

মাসুরার বাবা রজব আলীর বাড়ি সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কয়লা ইউনিয়নের আলাইপুর গ্রামে। রজব আলী অল্প বয়সে সাতক্ষীরা শহরে এসে আর ফিরে যাননি। শহরের বিভিন্ন নানা জায়গায় চালান চায়ের দোকান। ভ্যানে করে ফল-সবজি বিক্রি করেছেন। শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগের সমস্যায় এখন সেভাবে কাজ করতে পারেন না।

মাসুরার মা ফাতেমা খাতুন বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। ছোটবেলা থেকে মাসুরার খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ দেখে আমি তাকে খেলা চালিয়ে যেতে বলেছিলাম। কোচ আকবর আলীই আমার মেয়েকে এ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন। খুব কষ্টের যে, এত বড় জয় উনি দেখে যেতে পারলেন না। দুই মাস আগে পরলোকে পাড়ি জমিয়েছে আকবর আলী।’

আঁখি খাতুন , যেন ভাঙা ঘরের আলো 

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের পাড়কোলা গ্রামের মেয়ে আঁখি খাতুন। আঁখির বাবা আক্তার হোসেন একজন তাঁত শ্রমিক মা গৃহিণী। বাড়িঘর ভাঙাচোরা। তার মা নাছিমা খাতুন জানান, আমার মেয়ে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। আনন্দে ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আমি কিছু বলতে পারছিনা । আমার মেয়ের জন্য দোয়া করবেন । সে যেন ভবিষ্যতে আরো উঁচু জায়গায় যেতে পারে । বার বার দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে ।  

খালেদ / পোস্টকার্ড ;