ডেঙ্গু জ্বরে কাঁপছে দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়া , বাংলাদেশে সতর্কতা থাকলেও প্রতিরোধে প্রস্তুতি ছিল না

এম মামুন হোসেন ।।

ডেঙ্গু জ্বরে কাঁপছে দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়া , বাংলাদেশে সতর্কতা থাকলেও প্রতিরোধে প্রস্তুতি ছিল না
ডেঙ্গু জ্বরে কাঁপছে দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়া , বাংলাদেশে সতর্কতা থাকলেও প্রতিরোধে প্রস্তুতি ছিল না
ডেঙ্গু জ্বরে কাঁপছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ । বাংলাদেশে ডেঙ্গুর এমন বিস্তার এর আগে কখনও দেখা যায়নি। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ফিলিপাইনে এ জ্বরে অনেক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর মতো না হলেও চীন, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামেও বড় আকারে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে দেশগুলোর কর্তৃপক্ষ। এ জন্য জনগণকে সতর্ক করেছে চীন ও ভিয়েতনাম। অন্যদিকে ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিদিনই মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর সঙ্গে প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতীসহ সব বয়সিদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মশা নিধনে নগর কর্তৃপক্ষের ‘ব্যর্থতা’ নিয়ে জন-অসন্তোষের মধ্যে একাধিকবার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে হাইকোর্টও।


এ বছর বাংলাদেশে এডিস মশার বিস্তার ও ডেঙ্গু রোগী বাড়তে পারে, এমন আশঙ্কা আগেই করেছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। সে ব্যাপারে সতর্ক হতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিল। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি) পৃথক দুটি গবেষণায় বলেছে, ঢাকার দুই সিটিতে ছিটানো ওষুধে এডিস মশা মরছে না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক জরিপে বলা হয়, বর্ষা শুরুর আগে ঢাকা শহরে প্রাপ্তবয়স্ক এডিস মশার সংখ্যা যা ছিল, বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর তা ছয়গুণ বেড়ে গেছে। মশার লার্ভা বা শুটকীটের পরিমাণও অনেক বেশি পাওয়া যায়। চার মাসের বেশি সময় ধরে মশা মারার কোনো ওষুধ ছিটানো হয়নি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায়। এসব কারণেই দেশে ডেঙ্গুর এত প্রাদুর্ভাব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গু নিয়ে জনমনে আতঙ্ক থাকলেও প্রতিরোধে প্রস্তুতি ছিল না।

ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ে চলছে আলোচনা। নানা পেশাজীবী মানুষরা বলছেন, ডেঙ্গুর এ মহামারীর পেছনে কী শুধুই এডিস মশা, না ঢাকার বাতাসে ছড়ানো হয়েছে কোনো ভাইরাস। বহুজাতিক ওষুধ কিংবা প্রতিষেধক কোম্পানি এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতি যে কেবল ঢাকায় তা নয়, বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ, যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বাংলাদেশের তুলনায় ভালো। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডে। এশিয়ার শীর্ষ আয়ের দেশ সিঙ্গাপুরেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। এ বছর ডেঙ্গু নিয়ে নাগরিকদের সতর্ক করেছে চীন ও ভিয়েতনাম।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে শনিবার পর্যন্ত মোট ৬২ হাজার ২১৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৪৭ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তবে বেসরকারি হিসাবে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ১৬০ ছাড়িয়েছে। ঢাকায় যখন ডেঙ্গু মহামারীর রূপ নিয়েছে, তখন ভারতের কলকাতা শহর ডেঙ্গু মোকাবেলায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। গত পাঁচ বছর ধরে কলকাতা সিটি করপোরেশন বছর জুড়ে সাফল্যের সঙ্গে ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশা নিধন করে আসছে।

 

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডেঙ্গু এডিস মশাবাহিত একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এখনো পর্যন্ত এর সুপরিচিত কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও অন্য মহাদেশের ১১০টির অধিক দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হয়। বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশের ডেঙ্গুর ঝুঁকি রয়েছে। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় পাঁচ থেকে একশ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। তাদের মধ্যে ১০ থেকে ২০ হাজারের মতো মানুষ মারা যায়। আর প্রতিবছর বিশ্বের যেসব দেশের মানুষের ডেঙ্গু সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়, তার প্রায় ৭৫ শতাংশই দেখা যায় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।
 
এ বছর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ রীতিমতো কাঁপছে ডেঙ্গু জ্বরে। ব্যাংকক পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিঙ্গাপুরে গত এক সপ্তাহে ডেঙ্গু আক্রান্তের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে ৬৫২টি। আর গত তিন মাসে দেশটিতে মোট ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা আট হাজার ২৩ জন। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ফিলিপাইনে। সেখানে গত পাঁচ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত প্রায় ৫০০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে বলে দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ নিশ্চিত করেছে। আর সব মিলিয়ে দেশটিতে এক লাখ ছয় হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন।
 
ফিলিপাইনের স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, তাদের দেশে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় ৮৫ শতাংশ বেশি। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় দেশ জুড়ে জাতীয় ডেঙ্গু সতর্কতা জারি হয়েছে। থাইল্যান্ডে গত কয়েক দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত অন্তত ৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৪৪ হাজারের বেশি মানুষ। দেশটিতে এক সপ্তাহে বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি রোগী। এ বছরের শেষদিকে দেশটিতে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ৩০ হাজারে পৌঁছাতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন খোদ দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী। মালয়েশিয়ার স্টার অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পার্শ^বর্তী দেশগুলোর মতো ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দেখা না দিলেও ডেঙ্গুতে দেশটিতে এখন পর্যন্ত একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় চার হাজার মানুষ। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর মতো না হলেও চীন, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামেও বড় আকারে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে দেশগুলোর কর্তৃপক্ষ। এ জন্য জনগণকে সতর্ক করেছে চীন ও ভিয়েতনাম।
 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণ বোঝা যায়, আক্রান্ত হওয়ার পর তিন থেকে ১৪ দিনের মাথায়। অনেকের ক্ষেত্রে বোঝাও যায় না ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। বেশিরভাগ ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের প্রচÐ মাথা ব্যথার পাশাপাশি অনেক সময় জ্বর ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটে পৌঁছায়। আক্রান্তদের শরীরে বিভিন্ন অংশে ব্যথা, চুলকানি ও বমি হয়। তিনি বলেন, এ বছর ডেঙ্গু রোগে নতুন নতুন কিছু উপসর্গ দেখা গেছে, আগে ডেঙ্গু হলে জ্বর হতো, মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা হতো। তবে এবারে ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো অন্যরকম। যেমন তীব্র পেটব্যথা, কারও হার্টের সমস্যা বেড়েছে। কারও মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়েছে। অন্য বছরের চাইতে এবারে এ জটিলতাগুলো অনেক বেশি।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, মশার সংখ্যা কমে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট তৎপরতা চলছে। আমরা আশা করব, মশার সংখ্যা কমে যাবে এবং ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমে যাবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যা যা পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন তা নেওয়া হয়েছে।

চার মাস ওষুধ ছিটানো হয়নি ঢাকা উত্তরে : মশা মারার ওষুধ অকার্যকর জানার পরও ওষুধ পরিবর্তনের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়নি ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এবার মশা বাড়বে স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের এমন সতর্কবার্তাও সিটি করপোরেশন কানে নেয়নি। দুই সিটি করপোরেশনে মশা মারার ওষুধ কেনা নিয়ে নানা অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। এমনকি চার মাসের বেশি সময় ধরে মশা মারার কোনো ওষুধ ছিটানো হয়নি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায়। মশা নিধনে ওষুধের মানহীনতার অভিযোগে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা ওষুধ গ্রহণ না করায় মজুত শূন্য হয়ে পড়ে সংস্থাটির। গত বছরের নভেম্বর থেকে এ বছরের ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত চার মাসে মশা মারার কোনো ওষুধ ছিটানো হয়নি। পরে নতুন কোম্পানির ওষুধ আসে মার্চের প্রথম সপ্তাহে।

 

ডিএনসিসির একাধিক মশা নিধন কর্মী ও সুপারভাইজার বলেন, গত নভেম্বর নয়, মূলত সেপ্টেম্বর থেকে ওষুধ ছিল না। তখন ওষুধ না দিয়ে দুই মাস শুধু ধোঁয়া দেওয়া হয়েছে যাতে মানুষ বুঝতে না পারে। পরে নভেম্বর মাস থেকে মার্চ পর্যন্ত কোনো ওষুধই দেওয়া হয়নি। আমরা শুধু এসে এসে হাজিরা দিয়ে চলে যেতাম।
 
দুটি প্রতিষ্ঠান দুই সিটি ভাগ করে ওষুধ বিক্রি করত। উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা নোকন নামের একটি কৃষি ও কীটনাশক বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ওষুধ কেনে। আর লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জের ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেডের মাধ্যমে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে ওষুধ ব্যবহার করত। তবে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) মশা নিধনের ওষুধ পরীক্ষা করে বলেছে, এটি অকার্যকর। একই ওষুধ পরীক্ষা করে সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখাও (সিডিসি) বলেছে অকার্যকর। উত্তর সিটি করপোরেশন লিমিটেডের ওষুধ মাঠ পরীক্ষায় অকার্যকর বলে বাতিল করে। উত্তরের বাতিল করা ওষুধ দক্ষিণে ব্যবহার করা হয়।
 

ডেঙ্গু মোকাবেলায় এ অঞ্চলের দৃষ্টান্ত কলকাতা : এর আগে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কলকাতার চিত্র ঢাকার চেয়ে খুব একটা আলাদা কিছু ছিল না। অভিযোগ অস্বীকার করার প্রবণতা কলকাতার রাজনীতিতেও ছিল। কলকাতা সিটি করপোরেশন শুধু বর্ষা এলেই নামত এডিস মশা নিধন কার্যক্রমে। কিন্তু, করপোরেশনের কর্মীরা মাঠে নামার আগেই ডেঙ্গু জ্বর ছড়িয়ে পড়ত। কাজের এই ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে কলকাতা সিটি করপোরেশন। এখন তারা সারা বছর তৎপর থাকে এডিস মশা প্রতিরোধে। করপোরেশন কর্মীরা সারা বছর চোখ রাখেন নালা-ডোবা, জমে থাকা পানির ওপর। হাসপাতালগুলোও রাখেন নজরদারিতে।

কলকাতার উপ-মেয়র ও স্বাস্থ্য বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্যানেল মেয়র অতিন ঘোষ বলেন, করপোরেশন সার্বক্ষণিক ডেঙ্গু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। ১৫ থেকে ২০ জন কর্মী দুটি দলে বিভক্ত হয়ে ১৪৪টি ওয়ার্ডে কাজ করেন। একটি দলের কাজ রোগ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা, অন্যটির কাজ এলাকায় ডেঙ্গু মশার জন্ম নিতে পারে এমন জমানো পানি শনাক্ত করা। ৮ থেকে ১০ জনের আরেকটি দলকে প্রস্তুত রাখা হয় জরুরি সেবার জন্যে। খবর পেয়ে তারা গিয়ে এডিস মশার জন্মস্থল ধ্বংস করেন। যদি কোনো ভবনে জমানো পানি দেখতে পান যেখানে এডিস মশার জন্ম হতে পারে, তাহলে সেই ভবনের মালিককে ১ লাখ রুপি (ভারতীয় মুদ্রা) জরিমানা করা হয়।