নেতার দায়িত্ব ও গুণাবলি ইসলাম ধর্মে

নেতার দায়িত্ব ও গুণাবলি ইসলাম ধর্মে

মাওলানা মুনীরুল ইসলাম ।।

নেতৃত্বের ধারা চলে আসছে পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই । আল্লাহ তায়ালা কখনই এই পৃথিবীকে নেতৃত্বশূন্য ছেড়ে দেননি। তিনি যুগে যুগে যেসব নবী-রাসুল (আ.) পাঠিয়েছেন, যারা মানবজাতিকে হেদায়াত ও মুক্তির পথপ্রদর্শন করেছেন, তারাই মানবজাতির সামনে নেতৃত্বের আদর্শ। পৃথিবীর অন্যান্য খ্যাতিমান যশস্বী ব্যক্তিদের সঙ্গে নবী-রাসুলদের পার্থক্য হলো, নবী-রাসুলরা ছিলেন প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়োজিত। মানবজাতির সত্যিকারের কল্যাণের পথ তারাই নির্মাণ করে গেছেন। শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন মানবজাতির সামনে সর্বশেষ আদর্শ। মহাবিপ্লবের মহানায়ক হিসেবে তিনি নেতৃত্বের এক অসাধারণ নজির স্থাপন করে গেছেন। এখন তার আদর্শই আমাদের নেতাদের চলার পাথেয়।

প্রকৃত নেতারা সত্যিকারার্থেই সবসময় মানবকল্যাণে সক্রিয় ও সচেতন থাকেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাদের মধ্যে কিছু লোককে অন্য কিছু লোকের ওপর আমিই প্রাধান্য দিয়েছি, যেন তারা পরস্পর থেকে কাজ নিতে পারে। আর আপনার আল্লাহর রহমত ওই ধনসম্পদ থেকে অধিক মূল্যবান যা (ধনবানরা) দুই হাতে সংগ্রহ করছে।’ (সুরা যুখরুফ : আয়াত ৩২)। অন্য আয়াতে তিনি প্রাধান্যপ্রাপ্ত লোকদের কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ‘বস্তুত আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত সে, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মুত্তাকী বা নীতিপরায়ণ। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সব বিষয়ে জানেন এবং সব বিষয়ে অবহিত।’ (সুরা হুজুরাত : আয়াত ১৩)

আরবিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘সাইয়িদুল কওমি খাদিমুহুম’, অর্থাৎ ‘জাতির নেতারা তাদের খাদেম বা সেবক’। জনগণের ওপর কর্তৃত্ব করার জন্য নয় বরং সমাজের সেবা করে সুখে-দুঃখে তাদের পাশে থাকবেন, তাদের সমস্যা সমাধানে ভ‚মিকা পালন করবেন এবং জনগণের আস্থা অর্জন করে নেতারা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন। নেতা কোনো অবস্থায়ই তার অধীনস্থ লোকদের মধ্যে বৈষম্য করবেন না। সবার সঙ্গে ইনসাফভিত্তিক আচরণ করবেন। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-জাতীয়তা বা অঞ্চল নির্বিশেষে সবাই নেতার কাছ থেকে ইনসাফ পাবেন। এমনকি শত্রæর প্রতি ইনসাফের আচরণ করতে নির্দেশ করে ইসলাম।

পবিত্র কোরআনের ঘোষণা, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে এই আদেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ এগুলোর পাওনাদারদের কাছে পৌঁছে দাও। আর লোকদের মধ্যে যখন (কোনো বিষয়ে) বিচার করবে তখন ইনসাফের সঙ্গে করবে।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৫৮)। আরও ঘোষণা হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহর (বিধিবিধানের) পূর্ণ প্রতিষ্ঠাকারী ও ইনসাফের সাক্ষ্যদাতা হও। আর কোনো সম্প্রদায়ের শত্রুতা যেন তোমাদেরকে সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা সুবিচার কর, এটাই তাকওয়ার বেশি কাছাকাছি। আল্লাহকে ভয় করতে থাক। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে অবগত।’ (সুরা মায়েদা : ৮)

ইসলামের দৃষ্টিতে নেতাদের কিছু গুণ থাকা জরুরি। যেমন একজন নেতার মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকবে। হজরত আওফ ইবনে মালিক রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের উত্তম নেতা হলো তারা, যাদেরকে তোমরা ভালোবাস এবং তারাও তোমাদেরকে ভালোবাসে। তারা তোমাদের জন্য দোয়া করে, তোমরাও তাদের জন্য দোয়া কর। আর তোমাদের নিকৃষ্ট নেতা হলো তারা, যাদেরকে তোমরা ঘৃণা কর এবং যারা তোমাদেরকে ঘৃণা করে আর তোমরা যাদের ওপর অভিশাপ বর্ষণ কর। সাহাবায়ে কেরামের পক্ষ থেকে জিজ্ঞেস করা হলো, হে রাসুল! আমরা কি তলোয়ারের সাহায্যে তাদের মোকাবেলা করব? তিনি বললেন, না, যতক্ষণ না তারা তোমাদের মধ্যে নামাজ কায়েম করতে থাকবে। তোমাদের নেতৃস্থানীয় লোকদের মধ্যে যদি তোমরা এমন কোনো জিনিস দেখতে পাও যা তোমরা অপছন্দ কর, তবে তোমরা তার কাজ ঘৃণা করতে থাক। কিন্তু তার আনুগত্য থেকে হাত টেনে নিও না। (মুসলিম)

নেতারা উদার, মহৎ ও ক্ষমাশীল হবেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! এটা আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহের বিষয় যে, আপনি এসব লোকের জন্য খুবই নম্র স্বভাবের হয়েছেন। আপনি যদি উগ্র স্বভাব ও পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী হতেন, তবে এসব লোক আপনার চারপাশ থেকে দূরে সরে যেত, অতএব তাদের ক্ষমা করে দিন। তাদের জন্য মাগফেরাতের দোয়া করুন এবং ইসলামের কাজকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুন। অবশ্য কোনো বিষয়ে আপনার মতো সুদৃঢ় হয়ে গেলে আল্লাহর ওপর ভরসা করুন। বস্তুত আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন যারা তার ওপর ভরসা করে কাজ করে।’ (সুরা আলে ইমরান : আয়াত ১৫৯)। মক্কা বিজয়ের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) ক্ষমার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, বিশ^ ইতিহাসে এমন আরেকটি খুঁজে পাওয়া যাবে না।

নেতারা দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ হবেন। তাদের ওপর দায়িত্ব এলে তিনি সর্বোত্তমভাবে তা পালনের চেষ্টা করেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমার এ ঘরে রাসুলুল্লাহকে (সা.) দোয়া করতে শুনেছি, হে আল্লাহ! যে ব্যক্তি আমার উম্মতের যেকোনো কাজের দায়িত্বশীল নিযুক্ত হয়, এরপর সে লোকদের কষ্টের মধ্যে ফেলে, আপনিও তাকে কষ্টের মধ্যে ফেলে দিন। আর যে ব্যক্তি আমার উম্মতের যেকোনো বিষয়ে দায়িত্বশীল নিযুক্ত হয় এবং লোকদের সঙ্গে নম্র ব্যবহার করে, আপনিও তার সঙ্গে নম্র ব্যবহার করুন।’ (মুসলিম : ৪৭২২)

যেহেতু ইসলামে ধর্ম ও রাজনীতি আলাদা নয়, তাই রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় নেতাদেরও সেসব গুণের অধিকারী হওয়া জরুরি। তা ছাড়া নেতারা হবেন খোদাভীরু ও আল্লাহর প্রেমিক। উন্নত নৈতিকতা ও নির্মল চরিত্রের অধিকারী। গঠনমূলক সমালোচনা, বাক-স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকারী। জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। দৃঢ়চিত্ত ও সাহসী। অসাধারণ সততা ও যোগ্যতার অধিকারী। চিন্তাশীল ও উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী। নম্র, ভদ্র, বিনয়ী ও সুমধুর ব্যবহারের অধিকারী। পরিস্থিতি মোকাবেলা ও সঙ্কট ব্যবস্থাপনায় পারদর্শী। ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের প্রতীক। অধ্যবসায়ী, সাধক ও পরিশ্রমী। নির্লোভ ও নির্মোহ। সংগঠন পরিকল্পনা ও শৃঙ্খলা বিধানে পারদর্শী। আস্থাভাজন ও অসহায়ের আশ্রয়দানকারী। উদ্যোগী ও সক্রিয়। শিক্ষানুরাগী ও শৈল্পিক মনোবৃত্তির অধিকারী। পরোপকারী ও গণমুখী। সব ব্যাপারে অগ্রগামী ও আদর্শ স্থাপনকারী।

যারা আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কিংবা দেবেন, তারা ইসলাম প্রদত্ত গুণাবলি অর্জন করলে এবং যথাযথ দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এলে দেশের আরও উন্নতি ও সমৃদ্ধি আসবে ইনশাল্লাহ।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম