প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস যে প্রাণী থেকে ছড়িয়েছে

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস যে প্রাণী থেকে ছড়িয়েছে
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস যে প্রাণী থেকে ছড়িয়েছে

স্বাস্থ্য ডেস্ক ।।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৮০ জনে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়াও প্রায় ৩ হাজার মানুষ এতে আক্রান্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে দেশটির স্বাস্থ্য কমিশন। এদিকে চীনে সরকারিভাবে আক্রান্তের যে সংখ্যা বলা হচ্ছে- প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। এক চীনা নার্সের দাবি, উহানে এক লাখ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। এরপর পুরো বিশ্বে ২৭৪৪ আক্রান্ত হয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে উহান শহর লকডাউন করে দেয়া হয়েছে। খবর ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য সানের।

চীনা বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন, কেবল ফ্রুট ব্যাট বা মেগাব্যাটের মধ্যে পাওয়া যায় ভাইরাসের সঙ্গে উহানে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসের মিল রয়েছে। এরপর বিভিন্ন ফুটেজ ও ছবি ছড়িয়ে পড়ে যেখানে দেখা যায় যে, চীনা মানুষজন বাদুড়ের স্যুপ খাচ্ছে।

বাদুড়ের স্যুপ ব্যতিক্রমী হলেও বিশেষ করে উহানে এই খাবারটি খুবই জনপ্রিয়। এই শহরেরই একটি মাছ বাজার থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত অসমর্থিত ফুটেজে দেখা গেছে, মানুষজন একটি বাটি থেকে দাঁত বের করে রাখা মৃত একটি বাদুড় খাচ্ছে। আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, একটি মৃত বাদুড়ের পেট সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং সেখানে ঝোল রয়েছে।

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
সম্প্রতি চায়না সায়েন্স বুলেটে প্রকাশিত এক নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে, বাদুড়ের শরীরে পাওয়া যায় এমন একটি ভাইরাসের সঙ্গে নতুন করোনাভাইরাসের সম্পর্ক রয়েছে। এর আগে প্রাণঘাতী সার্স ও ইবোলা ভাইরাসের বিস্তারও উড়ন্ত কোনও স্তন্যপায়ী থেকে হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা ভেবেছিলেন নতুন ভাইরাস মহামারীর কারণ হবে না কারণ আগে যেসব ভাইরাসের প্রকোপ দেখা গেছে, সেসব ভাইরাসের জিন ভিন্ন ছিল। এদিকে নতুন এই ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরি করতে কমপক্ষে এক বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সেস, পিপলস লিবারেশন আর্মি ও ইন্সটিটিউট পাস্টোর অব সাংহাই যৌথভাবে এই নতুন গবেষণা পরিচালনা করেছে। সেখানে দেখা গেছে, মানবদেহে থাকা এসিই২ নামের একটি প্রোটিনের সঙ্গে এই ভাইরাসের একটি ‘দৃঢ় সম্পর্ক’ রয়েছে।

গবেষকরা বলছেন, এই বান্ডিং প্রোটিনের সঙ্গে সার্স ভাইরাসের উচ্চমাত্রা মিল হয়েছে। ২০০২-২০০৩ সালে ছড়িয়ে পড়া ওই ভাইরাসে প্রায় ৮০০ জনের মৃত্যু হয় এবং বিশ্বজুড়ে আট হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়। সরকারি একটি ডাটাবেজে করোনাভাইরাসে নতুন স্ট্রেইনের বিবর্তন শনাক্ত করেছেন এবং বিবর্তন ট্রি থেকে জানতে পেরেছেন এটা বেটাকরোনাভাইরাসভুক্ত।

তাদের দুটির মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ জিনগত মিল রয়েছে, যা শূকর ও মানুষের সাদৃশ্যের চেয়ে কম। তাদের গবেষণায় জানা গেছে, ২০১৯-এনসিওভি নামের নতুন এই করোনাভাইরাসটি গবেষকরা অবমূল্যায়িত করে থাকতে পারেন।

এক বিবৃতিতে গবেষকরা জানিয়েছে, উহান করোনাভাইরাসের প্রাকৃতিক হোস্ট বাদুড় হতে পারে; কিন্তু বাদুড় ও মানুষের মাঝখানে একটি অজ্ঞাত মাধ্যম থেকে থাকতে পারে। কিন্তু নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উহান ইন্সটিটিউট অব ভিরোলজির একজন সিনিয়র গবেষক বলেছেন, এই গবেষণার ফলাফল সতর্কভাব নিতে হবে।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে তিনি বলেন, একটি কম্পিউটার মডেলে ক্যালকুলেশনের ভিত্তিতে এই ফলাফল তৈরি করা হয়েছে। বাস্তব জীবনে এটা ঘটবে তা অনিবার্য নয়। বান্ডিং প্রোটিন গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অন্যান্য আরও অনেক কিছুর সঙ্গে এটি নিয়েও তদন্ত করা হচ্ছে। এর সঙ্গে অন্য প্রোটিনেরও সম্পর্ক থাকতে পারে।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নতুন এই ভাইরাসটি একটি আরএনএ ভাইরাস। অর্থাৎ স্পলপক্স বা গুটি বসন্তের মতো ডিএনএ ভাইরাসের ১০০ গুণ দ্রুত রূপান্তর ঘটে এই আরএনএ ভাইরাসের।

সাপ থেকে ছড়িয়েছে ভাইরাসটি?
পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দাবি করেছেন, বাদুড় থেকে ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশ করেছে সাপের মাধ্যমে। উহানের ওই মাছ বাজারে অন্যান্য বণ্যপ্রাণীর সঙ্গে সাপও বিক্রি করা হয়। গবেষকরা বলছেন, নতুন ২০১৯-এনসিওভি ভাইরাসটি বাদুড়কে আক্রান্ত করে এমন একটি করোনাভাইরাস এবং আরেকটি অজানা করোনাভাইরাসের সমন্বয়।

গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, করোনাভাইরাসের সাদৃশ্য ভার্সনের কারণে আক্রান্ত হবার বেশি ঝুঁকি আছে সাপের। এর মানে হচ্ছে, ভাইরাসটি আরও শক্তিশালী ও অনুলিপি তৈরি করার ‘আধার’ হিসেবে কাজ করে সাপ।

তারা বলছেন, করোনাভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাব্য উৎস উহানের হুয়ানান ‍সিফুড মার্কেটে সাপও বিক্রি হয়। আর সেখান থেকেই এই ভাইরাস মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ার আগে অন্য কোনও প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করে থাকতে পারে।

জার্নাল অব মেডিকেল ভিরোলজিতে এক আর্টিকেলে গবেষকরা জানিয়েছে, আমাদের বিবর্তন বিশ্লেষণ থেকে এই প্রথমবার দেখা গেছে যে ২০১৯-এনসিওভি ভাইরাসের আধার হিসেবে সম্ভবত কাজ করে সাপ।

প্রসঙ্গত, গত বছরের শেষদিকে চীনের মধ্যাঞ্চলীয় শহর উহানের একটি সিফুড মার্কেট থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হয়। উহান থেকে ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব চীনের রাজধানী বেইজিং, বৃহত্তম শহর সাংহাইয়ের পাশাপাশি থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, নেপাল, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও কানাডা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এই রোগ বিস্তার কেন্দ্র করে চীনা ভ্রমণে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। উহান শহর থেকে নিজ দেশে ফেরা ব্যক্তিদের শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে। উহান থেকে কানাডায় ফেরা এক ব্যক্তির শরীরে ভাইরাসটি পাওয়া গেছে। পঞ্চাশোর্ধ্ব ওই ব্যক্তি বুধবার টরেন্টোতে ফেরার একদিন পর শ্বাসযন্ত্রের অসুখ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।