পুলিশের কেলেঙ্কারি : ওসি মাহমুদুল ধর্ষণের অভিযোগ চাপা দিতে ২০ লাখ টাকা খরচ করেন

আলমগীর হোসেন , সময়ের আলো ।।

পুলিশের কেলেঙ্কারি : ওসি মাহমুদুল ধর্ষণের অভিযোগ চাপা দিতে ২০ লাখ টাকা খরচ করেন
ধর্ষণের অভিযোগ চাপা দিতে ২০ লাখ টাকা খরচ করেন ওসি মাহমুদুল
☑ ফেসবুকের সূত্র ধরে পরিচয়-প্রেম
☑ ক্যাপিটাল হোটেলে বিভিন্ন সময়ে মেলামেশা
☑ পাবনায় আপত্তিকর অবস্থায় পুলিশ সদস্য আটক
☑ চাঁদাবাজির অভিযোগে খুলনায় পুলিশের ৭ সদস্য সাময়িক বরখাস্ত
☑ এসব ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে পুলিশ সদর দফতর : এআইজি সোহেল রানা


পুলিশে কেলেঙ্কারি যেন পিছুই ছাড়ছে না। কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্যের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে বারবার ইমেজ সংকটে পড়ছে বাংলাদেশ পুলিশ। নারী কেলেঙ্কারি, ঘুষ-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত জুয়া বা ক্যাসিনো কাণ্ডেও বিভিন্ন পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ হরহামেশাই এখন পাওয়া যাচ্ছে। নতুন করে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে পল্টন থানার ওসি (সাময়িক বরখাস্তকৃত) মাহমুদুল হকের বিরুদ্ধে। চাকরি ও বিয়ের প্রলোভনে তরুণী এক ব্যাংক কর্মকর্তাকে ধর্ষণের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন তিনি।

এর মাঝেই মঙ্গলবার পাবনার চাটমোহর থানার এক পুলিশ কনস্টেবল এক প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়েছেন। এ ঘটনায় পুলিশ সদস্য ফিরোজ আলীকে প্রত্যাহার (ক্লোজড) করে পাবনা পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়াও খুলনার ডুমুরিয়ার চুকনগর এলাকার একটি প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজির অভিযোগে খুলনা জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার এসআইসহ সাত পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকালে খুলনার পুলিশ সুপার স্বাক্ষরিত এক লিখিত আদেশে এদের বরখাস্ত করা হয়। 

পল্টন থানা পুলিশের একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে বলেন, যে মেয়েটিকে চাকরি ও বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগে পল্টনের ওসি মাহমুদুল হক সদ্য সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন সেই তরুণী তার নিজ এলাকার। নওগাঁর সদর থানাধীন গাঙ্গুরিয়ার ওই সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে বছরখানেক আগেই ফেসবুকে পরিচয় হয় মাহমুদুলের। ঢাকা ব্যাংকের রংপুর শাখায় কর্মরত ওই মেয়েটি নিজ এলাকার হিসেবে পরিচয়ের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর পল্টন এলাকার ক্যাপিটাল হোটেলে মেয়েটিকে নিয়ে বিভিন্ন সময় মেলামেশা করতে থাকেন মাহমুদুল। একাধিকবার মেয়েটি পল্টন থানাতে এসেও তৎকালীন ওসি মাহমুদুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও সময় কাটিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন থানা পুলিশের একাধিক সদস্য। এভাবেই তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে একপর্যায়ে মেয়েটি বিয়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করলে সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়। মেয়েটি প্রতিবাদ শুরু করলে বিষয়টি চাপা দিয়ে রাখতে ওসি মাহমুদ অন্তত ২০ লাখ টাকা খরচ করেছেন বলেও জানা যায়। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। 

জানা যায়, দুই মাস আগেও অনেকটাই ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় প্রায় ১০ হাজার কনস্টেবল নিয়োগ সম্পন্ন করে অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বাংলাদেশ পুলিশ। এর বাইরেও অনেক পেশাদারি ও মানবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পুলিশের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ঊর্ধ্বতন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা-সদস্যই নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সেখানেই কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্যের নানা অপকর্ম তথা নারী কেলেঙ্কারি, ঘুষ-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ড বারবার বিতর্কিত করছে পুলিশ বাহিনীকে। এর আগে কয়েক মাস আগে পুলিশের আলোচিত চাকরিচ্যুত ডিআইজি মিজানুর রহমানের নারী ও ঘুষ কেলেঙ্কারি কলঙ্কিত করে বাহিনীকে। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার এমন অপকর্মে চরম বিব্রত হয় পুলিশ। এরপর খুলনার জিআরপি থানায় এক নারীকে ওসিসহ কয়েকজন মিলে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগ উঠলেও ব্যাপক সমালোচনা হয়। এরপর গত ২ সেপ্টেম্বর যশোরের শার্শা উপজেলায় এক গৃহবধূ নিজের ঘরেই পুলিশের এসআই খায়রুলসহ চার পুলিশ সদস্যের ধর্ষণের শিকার হন বলে অভিযোগ ওঠে। পরে ওই এসআইকে প্রত্যাহারও করা হয়েছে। তবে ইতিবাচক দিক হচ্ছে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়ানোর অভিযোগ উঠলে সে বিষয়ে ছাড় পাচ্ছেন না অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা। বিভাগীয় তদন্তে এরই মধ্যে আলোচিত অনেকেই শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন বলে জানা যায়। 

এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা সময়ের আলোকে বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ একটি মর্যাদাপূর্ণ শৃঙ্খলা বাহিনী। কোনো ব্যক্তির অপকর্মের দায় নেবে না বাংলাদেশ পুলিশ। যার বিরুদ্ধেই অনৈতিকতা বা আইনবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠছে তদন্ত করে তার বিরুদ্ধেই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে পুলিশ সদর দফতর। সম্প্রতি পুলিশ সদস্যদের নৈতিক স্খলনজনিত বিষয়েও নতুন করে সকল ইউনিটকে সতর্ক করেছে সদর দফতর। 

জানা যায়, সারা দেশে বর্তমানে ক্যাসিনো বা জুয়া নিয়ে তোলপাড় অবস্থা চলছে। এসব অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনায় ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো ব্যাপক সমালোচিত হচ্ছে। তবে নেতাদের এই অপকর্মের নেপথ্যে পুলিশের একশ্রেণির কর্মকর্তাদের যোগসাজশেরও অভিযোগ রয়েছে। সেই অভিযোগসহ নানা কারণে মঙ্গলবারও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) আলোচিত মতিঝিল থানার ওসি ওমর ফারুকসহ আট থানার ওসি এবং তিনজন পরিদর্শককে বদলি করা হয়েছে। আলোচিত ক্যাসিনো কাণ্ডের মাঝেই নতুন সমালোচনায় এসেছে পল্টনের সদ্য বরখাস্তকৃত ওসি মাহমুদুল হকের যৌন কেলেঙ্কারির বিষয়টি। 

আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়া কনস্টেবল প্রত্যাহার : পাবনা প্রতিনিধি জানান, পাবনার চাটমোহর থানার এক পুলিশ কনস্টেবল এক প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়েছেন। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ওই পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করে পাবনা পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত (ক্লোজড) করা হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চাটমোহর সদরের দোলং মহল্লার সিঙ্গাপুর প্রবাসীর স্ত্রীর (৪০) সঙ্গে চাটমোহর থানার পুলিশ কনস্টেবল মো. ফিরোজ আলীর দীর্ঘদিনের পরকীয়া সম্পর্ক চলে আসছিল। সোমবার রাত ৮টার দিকে ফিরোজ আলী ওই নারীর ঘরে প্রবেশ করে অসামাজিক কাজে লিপ্ত হলে স্থানীয় লোকজন টের পেয়ে তাদের ধরে ফেলে। এ সময় কয়েকশ উৎসুক মানুষ ঘটনাস্থলে ভিড় জমায়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ফিরোজকে উদ্ধার করে তাৎক্ষণিক পাবনা পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করে।

এ ব্যাপারে চাটমোহর থানার ওসি সেখ মো. নাসীর উদ্দিন জানান, কোনো ব্যক্তির দায় পুলিশ বাহিনী নেবে না। ওই ঘটনায় কনস্টেবল ফিরোজকে ক্লোজ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে পুলিশ অ্যাক্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া ওই নারীর পক্ষ থেকে অভিযোগ দেওয়া হলে সে ব্যাপারেও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

চাঁদাবাজির অভিযোগে খুলনায় পুলিশের ৭ সদস্য সাময়িক বরখাস্ত : খুলনা ব্যুরো জানায়, চাঁদাবাজির অভিযোগে খুলনা জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার এসআইসহ সাত পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকালে খুলনার পুলিশ সুপার স্বাক্ষরিত এক লিখিত আদেশে এদের বরখাস্ত করা হয়। এদের বিরুদ্ধে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর এলাকার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। বরখাস্তরা হলো এসআই লুৎফর রহমান, এএসআই কেএম হাসানুজ্জামান, এএসআই শেখ সাইদুর রহমান, এএসআই গাজী সাজ্জাদুল ইসলাম, কনস্টেবল মো. কামরুজ্জামান বিশ^াস, জামিউল হাসান ইমন ও মো. রুবেল শেখ।

জানা গেছে, খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর এলাকার একটি মোটরসাইকেল বিক্রয় কেন্দ্রে অনৈতিক আর্থিক সুবিধা হিসেবে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে পুলিশ। একপর্যায়ে দাবিকৃত টাকা পরিশোধও করা হয়। তবে পরবর্তীতে বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলে জানানো হয়। ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা মেলায় সোমবার রাতে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মঙ্গলবার বিকালে পুলিশ সুপারের অফিস থেকে লিখিত আদেশে এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে খুলনা জেলা পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ জানান, অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত করা হবে। তবে যেহেতু আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, তাই সোমবার রাতে এমন অভিযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বরখাস্তের নির্দেশ দেওয়া হয়।