বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে সীতাকুণ্ডের জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প

বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে সীতাকুণ্ডের জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প
বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে সীতাকুণ্ডের জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক।।

১৯৬০ সাল। চট্টগ্রামের সমুদ্র সৈকতে বিকল হয়ে পড়ে গ্রীক জাহাজ এমডি আলপাইন নামে একটি জাহাজ। সিদ্ধান্ত হয় জাহাজ ভেঙ্গে ফেলার। এরপর জাহাজটিকে স্থানীয় মানুষ ও চট্টগ্রাম স্টিল মিলের শ্রমিকরা মিলে রশি দিয়ে টেনে তীরে নিয়ে আসে। শুরু হয় জাহাজ ভাঙ্গা। তারসাথে শুরু হয় নতুন একটি যাত্রা। বাংলাদেশ প্রবেশ করে নতুন এক শিল্পে।

পরবর্তীতে, অনন্য ভৌগলিক অবস্থানের কারণে ৭০ এর দশকের শেষের দিকে সীতাকুন্ড উপকূলে এ শিল্প ধীরে ধীরে বিকশিত হতে শুরু করে একবিংশ শতকের প্রথম দশকে বিশ্বে নেতৃত্ব দেয়া শুরু করে। বর্তমানে বৃহত্তম জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প হিশেবে বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে সীতাকুণ্ডের এ শিল্প। সেই সাথে দেশের অর্থনীতিতে যোগান দিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব।

সীতাকণ্ডের উপকূল ধরে প্রায় ১০০ শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে। যার ফলে তৈরি হয়েছে প্রচুর কর্মসংস্থান এবং প্রায় ৫০,০০০ মানুষ সরাসরি এই শিল্পের সাথে জড়িত। অন্যদিকে এ শিল্পের সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১,০০,০০০ মানুষ। এই বিশাল শ্রমজীবী মানুষগুলোর অধিকাংশই এসেছে দেশের দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল থেকে। আমাদের দেশের স্থানীয় রড এবং ইস্পাতের বাজার সর্ম্পূণভাবে এই শিল্পের উপর নির্ভরশীল। দেশের ইস্পাতের চাহিদার ৬০% আসে এই শিল্প থেকে। তাছারা জাহাজ এবং জাহাজের ভেতরের প্রায় সবই পুনর্ব্যবহারযোগ্য।

বৈশ্বিক অর্থনীতিতে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের প্রভাব জোড়ালো। বিশ্ববাজারে বর্তমানে ৪০ হাজার কোটি ডলারের বাজার উন্মুক্ত রয়েছে। এই বাজার ধরতে উন্নয়নশীল দেশগুলো এই শিল্পের দিকে মনোযোগী হচ্ছে দিন দিন। ভারতের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে বহুদুর। বর্তমানে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের নেতা বাংলাদেশই। বেলজিয়ামের ‘দা এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম’ ফেব্রুয়ারিতে এক প্রতিবেদনের তালিকায় দ্বিতীয় বারের মতো শীর্ষস্থান দখল করেছে বাংলাদেশ। প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ সংখ্যক জাহাজ ভাঙ্গা হয়েছে বাংলাদেশে। সে বছরে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বাংলাদেশে ২৩৬টি জাহাজ ভাঙ্গার জন্য আমদানি করে, যা ২০১৮ এর তুলনায় ২০.৪১ শতাংশ বেশি। এর আগেও ২০০৪-২০০৯ এই পাঁচ বছর বাংলাদেশ জাহাজ ভাঙ্গাতে বিশ্বে প্রথম স্থানে ছিল। বিশ্বে এই শিল্পে আমাদের প্রতিদন্ধী ভারত, পাকিস্তান, চীন ও তুর্কি। বিশ্বের ৮০% জাহাজ ভাঙ্গা হয় এই এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশ গুলোতে।

বাংলাদেশের এই শিল্প পরিবেশের উপর যেমন প্রভাব ফেলেছে তেমনি প্রতিবন্ধকতাও আছে । শুরুর দিকে যদিও জাহাজ ভাঙ্গার পুরো প্রক্রিয়াটিই ছিল সনজদি তবে কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোয়া লাগতে শুরু করেছে এ শিল্পে। এখন ভারী ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যাবহার শুরু হয়েছে। অনেক শিল্প মালিকই এখন তাদের কারখানাকে গ্রীন শিপ রিসাইাক্লিং ইন্ডাস্ট্রিতে রুপান্তরের প্রক্রিয়া হাতে নিলেও বেশির ভাগ কারখানায় এখনও পর্জাপ্ত আধুনিক সু্যোগ সুবিধা গড়ে ওঠেনি। শ্রমিকদের দেয়া হয়না পর্জাপ্ত সু্যোগ সুবিধা এবং নিশ্চিত করা হয়না সুরক্ষা। ফলে নানান বিষাক্ত পদার্থে শ্রমিকরা অসুস্থ হয়ে পরছে, আহত হচ্ছে, অনেকে মারাও যাচ্ছে। নেই কোন ইন্সুরেন্স বা আর্থিক নিরাপত্তা। প্রায় সব শিল্পের মতই এখানেও রয়েছে পরিবেশের উপর অত্যাচার। জাহাজ ভাঙ্গা একটি অতি ঝুঁকিপূর্ন কাজ। এখান থেকে বিশাক্ত কেমিক্যাল ও তেল পরিবেশে ছড়িয়ে পরে এবং জলজ প্রাণী ও মানুষের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে পুরাতন জাহাজ থেকে মারাত্মক বিষাক্ত পারমাণবিক বর্জ্য, বিষাক্ত রাসায়নিক, টক্সিন, প্রাণঘাতি যৌগ ডাম্প করা হয় সমুদ্রে যা সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার সমুদ্র বাস্তুসংস্থানের চরম পর্যায়ের ক্ষতি করে।

সীতাকুণ্ড নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সদস্য সচিব লায়ন গিয়াস উদ্দিন বলেন, এই শিল্পে যারা কাজ করেন সেই সব শ্রমিকদের নিরাপত্তার দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়না তেমন। তাদের জীবনমান উন্নয়ন ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। জাহাজ ভাঙ্গায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কারিগরি ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পুরাতন ও বিসাক্ত জাহাজ আমদানি নিয়ন্ত্রনে কিছু নীতি গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। এই সবটার সমন্ময় থাকলে এই শিল্পের নেতৃত্ব ধরে রাখা যাবে বহুবছর, যা আমাদের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে অনেক বড় ভূমিকা পালন করবে ।