' মোহাম্মদাবাদ ' প্রাচীন মসজিদে ঘেরা শহর

' মোহাম্মদাবাদ ' প্রাচীন মসজিদে ঘেরা শহর

জাফর উদ্দীন রাজু ।।

প্রাচীন ‘শহর মোহাম্মদাবাদ’ ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় তিন বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে অবস্থিত ।  মোহাম্মদাবাদের বর্তমান নাম বারোবাজার। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দক্ষিণে আর যশোর জেলা শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ঐতিহাসিক মসজিদ পরিবেষ্টিত এই শহর। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় পঞ্চদশ শতাব্দীতে হজরত খানজাহান আলী (রহ.) বারোজন সহচর নিয়ে এ এলাকায় আসার পর থেকে এর নাম হয় বারোবাজার। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৩ সালে এখানকার মাটি খুঁড়ে সন্ধান মিলে ১৫টিরও বেশি প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন। এর মধ্যে ৯টিই মসজিদ। তবে ধারণা করা হয় বর্তমানে মাটির নিচে আরও ৭টি মসজিদ রয়েছে।  প্রতিদিন শত শত লোক এই শহরে ভিড় করে পঞ্চদশ শতাব্দীর নিদর্শন মসজিদ দেখতে। দৈনিক সময়ের আলোর পাঠকদের জন্য প্রাচীন মসজিদগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো।

সাতগাছিয়া মসজিদ
বারবাজারে সাতগাছিয়া মৌজায় আদিনা মসজিদ অবস্থিত। বড় একটি পুকুরের দক্ষিণ পাশে এই মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। এটির শুধু দেয়াল আর নিচের অংশই অবশিষ্ট আছে। সর্বপ্রথম গ্রামের লোকজনই মাটিচাপা পড়ে থাকা এই মসজিদ উদ্ধার করে। আকারে এ এলাকার সবচেয়ে বড় মসজিদ এটি। প্রায় ৭৭ ফুট লম্বা ও ৫৫ ফুট চওড়া মসজিদের ভেতরে আছে ৪৮টি পিলার। এটি ৩৫ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। পশ্চিম দেয়ালে লতা-পাতার নকশা সমৃদ্ধ তিনটি মিহরাব আছে। এটি ১৯৯২ সালের দিনে আংশিক সংস্কার করা হয়।

গলা কাটা মসজিদ
বারবাজার মৌজায় গলা কাটা মসজিদ অবস্থিত। ২১ পুট লম্বা ও ১৮ ফুট চওড়া এই মসজিদ খনন করা হয় ১৯৯৪ সালে। ছয় গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মিহরাব রয়েছে। এর দেয়ালগুলো প্রায় পাঁচ ফুট চওড়া। মাঝখানে আছে লম্বা দুটি কালো পাথর। জনশ্রুতি আছে বারোবাজারে এক অত্যাচারী রাজা ছিল। প্রজাদের বলি দিয়ে মসজিদের সামনের দিঘির মধ্যে ফেলে দিত সে। এ কারণেই এর নাম হয় গলাকাটা।

নুনগোলা মসজিদ
বারোবাজারের হাসিলবাগ গ্রামে বড় দিঘির পশ্চিম পাশে রয়েছে এক গম্বুজবিশিষ্ট নুনগোলা মসজিদ। বর্গাকৃতির এ মসজিদে তিনটি অর্ধবৃত্তকার মিহরাব আছে। মেহরাবে ছোট ছোট  বর্গাকৃতির মধ্যে বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা আছে। মসজিদের বাইরের দেওয়ালে পর্যায়ক্রমিক খাড়া চাল ও খাঁজ আছে। এগুলোয় দিগন্ত রেখাকৃতির ছাচে গড়া নকশা আছে। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ এটি। স্থানীয়রা একে লবণগোলা মসজিদও বলে থাকেন। তবে এ নামকরণের কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না।

হাসিলবাগ মসজিদ
নুনগোলা মসজিদের সামান্য পশ্চিমে এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ এটি। হাসিলবাগ মসজিদ নামে পরিচিত এ মসজিদের আরেক নাম শুকুর মলি­ক মসজিদ। পোড়া মাটির তৈরি মসজিদটি এ অঞ্চলের সবচেয়ে ছোট এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। হাসিলবাগ এলাকায় দমদম জাহাজঘাটা ও সেনানিবাস ও নদীবন্দর ছিল। মসজিদটির উভয় পাশে একটি করে বন্ধ মেহরাবসহ পশ্চিম পাশে একটি অর্ধবৃত্তাকৃতির মেহরাব আছে। এ মেহরাবগুলো সজ্জিত করা হয়েছে পোড়ামাটির ঘণ্টা ও চেইন নকশায়। অপরূপ নকশাগুলো মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

পাঠাগার মসজিদ
ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কের পশ্চিম পাশে এক গম্বুজবিশিষ্ট পাঠাগার মসজিদ। লাল ইটের তৈরি এই মসজিদ আকারে ছোট। দীর্ঘদিন মাটি চাপা পড়ে থাকার পর ২০০৭ সালে প্রতœতত্ত¡ অধিদফতর মসজিদটি সংস্কার করে। জনশ্রুতি আছে সুলতানী আমলে নির্মিত এ মসজিদকেন্দ্রিক একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার ছিল। মসজিদের পাশেই বড় আকারের একটি দিঘি, নাম পিঠেগড়া পুকুর। বেলাট দৌলতপুর এলাকায় পাঠাগার মসজিদ আবিষ্কৃত হয়।

পীর পুকুর মসজিদ
পাঠাগার মসজিদের পশ্চিম দিকের সড়কে দুটি বাঁক ঘুরলেই বিশাল দিঘি, নাম পীর পুকুর। এ পুকুরের পশ্চিম পাড়ে আছে বড় আকৃতির একটি মসজিদ। ১৯৯৪ সালে খনন করে মাটির নিচ থেকে বের করা হয়েছে স্থাপনাটিকে। এ মসজিদে ছাদ নেই, শুধু দেয়াল আছে। মসজিদটি লাল ইটের তৈরি। বেলাট দৌলতপুর মৌজায় ১৬ গম্বুজবিশিষ্ট পীর পুকুর মসজিদ অবস্থিত।

গোড়ার মসজিদ
পীরপুকুর মসজিদের পাশের তাহেরপুর সড়ক ধরে সামান্য পশ্চিম দিকে হাতের বায়ে আরেকটি প্রাচীন মসজিদের দেখা মিলবে। এর নাম গোড়ার মসজিদ। এ মসজিদটি চার গম্বুজবিশিষ্ট। মসজিদের মিহরাব ও দেয়ালে পোড়ামাটির ফুল, লতাপাতা ফলের নকশাসহ নানান কারুকার্যমন্ডিত। বাইরের দেয়ালও লাল ইটে মোড়ানো। বেলাট দৌলথপুর মৌজায় ৪ গম্বুজবিশিষ্ট গোড়ার মসজিদ অবস্থিত। মসজিদটি খান জাহান আলী কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল বলে প্রবল জনশ্রুতি আছে। ১৯৮৩ সালে এ মসজিদের সন্ধান পায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর। মসজিদটি খননের সময় একটি কবরের সন্ধান মেলে। আরও শোনা যায়, পাশের কবরটি গোড়াই নামের কোনো এক দরবেশের। এ থেকেই এর নাম গোড়াই বা গোড়ার মসজিদ।

জোড় বাংলা মসজিদ
বারবাজার মৌজায় জোড় বাংলা মসিজদ অবস্থিত। মসজিদটি পুনঃসংস্কার করা হয় ১৯৯৩ সালে। খননের সময় এখানে একটি ইট পাওয়া যায়, তাতে আরবি অক্ষরে লেখা ছিল, ‘শাহ সুলতান মাহমুদ ইবনে হুসাইন, ৮০০ হিজরি’। এ থেকে ধারণা করা হয় ৮০০ হিজরির দিকে সুলতান মাহমুদ এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৯২-১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ব বিভাগ খনন করে এটি উন্মোচিত করে। ছোট ছোট পাতলা ইটে গাঁথা এই মসজিদ ১১ ফুট উঁচু একটি প্লাটফর্মের ওপর স্থাপিত। জনশ্রুতি আছে মসজিদের পাশে জোড়া কুড়েঘর ছিল বলেই এর নাম জোড় বাংলা মসজিদ।

মনোহর মসজিদ
১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর বারোবাজার প্রত্নস্থলে খননকার্য পরিচালনা করে। সে সময় মনোহর ঢিবি নামক স্থান থেকে এই প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। এ মসজিদটি যেখানে আবিষ্কৃত হয় তার পাশে একটি জলাশয় থাকায় একে মনোহর দিঘির মসজিদ নামে ডাকা হয়। মনোহর মসজিদটি উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে লম্বাভাবে নির্মিত। অভ্যন্তরের আয়তন ২২.৬৭ ও ২২.৬৭ ফুট এবং মসজিদের দেয়ালগুলোর পুরুত্ব প্রায় পাঁচ ফুট। মসজিদের মিনারগুলো নির্মাণে ইট ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি সারিতে ৪টি করে স্তম্ভ মিলিয়ে মোট স্তম্ভের পরিমাণ ২৪টি। ধ্বংসাবশেষ দেখে ধারণা করা হয়, মসজিদের মাথায় গম্বুজ ছিল ৩৫টি এবং ৪টি মিনার ছিল। খননের ফলে দুটি মিনারের ৫ ফুট পরিমাণ ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে।

 লেখক : ঝিনাইদহ প্রতিনিধি