যে বন্ধুত্বে ঝগড়া বেশি, সে বন্ধুত্বে দৃঢ়তাও বেশি!

জুনাইদ আল হাবিব , ঢাকা ।।

যে বন্ধুত্বে ঝগড়া বেশি, সে বন্ধুত্বে দৃঢ়তাও বেশি!
যে বন্ধুত্বে ঝগড়া বেশি, সে বন্ধুত্বে দৃঢ়তাও বেশি!

বন্ধু মানে সাথী, সঙ্গী, কাছের মানুষ, প্রিয়জন, প্রিয়মুখ। এক কথায় ভালোবাসার মানুষ। যাদের ছাড়া চলা যায় না, ফেরা যায় না। মাথায় কিছু এলেই যাদের কাছে নির্দ্বিধায় শেয়ার করা হয়। নতুন নতুন ভাবনা, নতুন নতুন চিন্তা-ধারা বন্ধুদের সাথে শেয়ার করার মাধ্যমেই বাস্তবে রূপ নেয়। বন্ধুত্বের এ রসায়নটা সকল ক্ষেত্রে এক নয়। বয়স, প্রজন্ম এবং সময় অনুযায়ী বন্ধুত্বের এ গল্পগুলো একেক রকমের।

ছোট্ট দু’জন শিশু। মনে করেন, তারা দু’জন একই বাড়ির। ওরা দু’জন এক সাথে খেলবে, একসাথে ঝগড়া করবে আবার একসাথ হওয়া না পর্যন্ত দু’জন থাকতেই পারবে না। ওদেরকে আপনি যতই দূরে সরানোর চেষ্টা করবেন, আপনার চেষ্টা বরাবরই ব্যর্থ হবে। ওরা ঝগড়া করে, একজনের সাথে একজনে মারামারি করে, সে চিন্তা থেকে আপনি তাদের সাময়িক সময়ের জন্য সরালেও তারা কিছুক্ষণ পর আবার মিল। কারণ, তাদের বন্ধুত্বটা তাদের সাথেই মানায়, বড়দের সাথে না। তারা তাদের সমবয়সীদের সাথেই মিশতে ভালোবাসে। আর যে বন্ধুত্বে ঝগড়া বেশি, সে বন্ধুত্বে দৃঢ়তাও বেশি! যার কারণে এ স্মৃতিগুলো কখনো ভোলার নয়।

ফুটবল এবং ক্রিকেট খেলার মধ্য দিয়ে কিশোর-তরুণদের মাঝে এক ধরণের বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়। প্রাইমারীর পাঠ পেরিয়ে যখন হাইস্কুলের বারান্দায় পা রাখি, তখন গ্রামের একঝাঁক খেলোয়াড়ের সঙ্গে আমার চলমিল। খেলাধূলায় অতটা সাফল্য না আসলেও খেলতে যেতাম নিয়মিত। কাদায় ভরা ক্ষেতে ফুটবল খেলে কতই না সময় পার হতো বন্ধুদের সাথে। সারাটা গায়ে কাদামাটি লেগে যেত। তবুও সবার একসঙ্গে খেলা চলতো। তারপর ক্রিকেট টিমে খেলা হতো আমার। বাম হাতে ব্যাট ধরা আর ডান হাতে বোলিংটা করা হতো। আমার ছক্কা মারাটা ছিল মাঠ কাঁপানো। যার জন্য সবার কাছে ছিল অন্যরকম পরিচিতি। ব্যাটিং শুরু হলেই আমাকে ব্যাটিংয়ের জন্য নামিয়ে দেয়া হতো। কারণ, কোন বলটা মাঠের উপর দিয়ে বাউন্ডারি গড়াবে, তারপর দলীয় রান সংখ্যা বাড়বে, তা ছিল সবার স্বপ্নের। সে স্বপ্নের জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে মাঠ গরম করার মতো অসংখ্য স্মৃতি মনে পড়ে। এমনও হয়েছে আমার চার-ছক্কায় ম্যাচ জিতেছে। সেক্ষেত্রে টিমে যারা ছিলো, তাদের সাথে একধরণের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাছাড়া কাপে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট বহু কিশোরের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়।

আবার পড়ার সাথী অনেকেই আজ বন্ধু। সে ছোটবেলা থেকে তারুণ্য। প্রাইমারী পেরিয়ে হাইস্কুল, সেখান থেকে কলেজ। এতটুকু সময় বহু সহপাঠীর সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু সময়ের পালাবদলে এ বন্ধুত্বগুলো যেন বেশি দিন টিকছেনা। হয়তো সামনে পড়লে কিছুক্ষণ কথাবার্তা। তারপর বিদায়। কবে যে দেখা হবে, তার কোন নিশ্চয়তা নাই। এভাবে বহু বন্ধু জীবনে আসে, তবে তার স্থায়িত্ব কতদূর, সেটা নিয়ে নানান মুখী প্রশ্ন থেকেই যায়। হয়তো অনেকের জীবনে বন্ধুত্বের গল্পগুলো এমনই। অনেক সময় দেখা যায়, কর্মজীবনে অনেকে সহকর্মীদের সাথে বন্ধুত্বের একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। কাজের সূত্রেই অনেকের সম্পর্কটা দৃঢ়তা লাভ করে। অনেক হয়ে ওঠেন ঘনিষ্ঠজন।

বন্ধুত্বের এসব গল্পের বাইরে এবার আসি অন্যদৃষ্টিতে। পড়াশোনার খাতিরে ছেলেদের সাথে মেয়েদের একটা বন্ধুত্বের বন্ধন সৃষ্টি হয়। এসব বন্ধুত্ব এতই গভীরতা লাভ করে যে, যা এক পর্যায়ে প্রেম-ভালোবাসার মতো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ দৃঢ়তা হয়তো অনেকে আজীবনের জন্য বন্ধুও খুঁজে পায়। এমন গল্প আছে শত শত। বন্ধুত্বের এ অধ্যায়টা সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে একেকভাবে দেখা হয়। তবে এমনটি সত্য যে, কিছু কিছু বন্ধুত্ব প্রেমের সম্পর্কের দিকে ঝুঁকে পড়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে, একজন অন্যজনের প্রতি চরম ভক্তি। যারা দু’জন দু’জনের কথা বার্তা, চাল-চলন, আচার-আচরণ এসব কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এমন সম্পর্ক তৈরি করে।

আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, বয়স্ক মানুষরা তাদের পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। যারা অবসর সময় কাটান চা-পান খেয়ে। টেলিভিশনের খবরে চোখ রেখে একেকজন একেকজনের সাথে গল্প-আড্ডায় মেতে ওঠেন। এরাই আসলে শেষ বয়সের বন্ধু। যারা মারা যাওয়ার পর অন্তত জানাজা পড়তে আসেন। সুখ-দুঃখে এ বন্ধুরাই পাশে থাকেন। জীবনে শেষার্ধে এ বন্ধুরাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

প্রযুক্তি ব্যাপক বিস্তৃত পরিসর লাভের কারণে এখন সামাজিক নেটওয়ার্কেও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠছে। পৃৃথিবীর একপ্রান্তের মানুষ আজ অন্যপ্রান্তের মানুষের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক করছেন। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বন্ধুদেরও নিজের বন্ধুর চোখেই দেখেন। তবে অনেকে এও মনে করেন, এ বন্ধুত্বে তেমন মজবুত সম্পর্ক নেই। যতক্ষণ লাইক-কমেন্ট, ততক্ষণ ভালো বন্ধু ভাবা হয়। তবে একটা বিষয় পরিস্কার যে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকের মাধ্যমে অনেকে ঘনিষ্ট বন্ধু পেয়ে বসেন। আবার এও দেখা যায়, একসাথে কয়েকজন তরুণ বন্ধু ঠিকই বসে আছে, কিন্তু সবাই ফোন চালনাতেই ব্যস্ত।

বন্ধুত্ব নিয়ে আরেকটি ব্যাতিক্রমী উদ্যোগের কথা মনে পড়ে গেল। লক্ষ্মীপুর শহরের একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সামাদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। এ স্কুলের ৯৬ ব্যাচের বন্ধুরা বন্ধুত্বের সম্পর্ককে চিরদিন টিকিয়ে রাখার জন্য গড়ে তোলেছেন “ফ্রেন্ডলি এ রিলেশন” নামের একটি সামাজিক সংগঠন। যারা বছরে একবার হলেও একসাথ হন। হাস পার্টি করেন, গল্প করেন, আড্ডা দেন। তাদের একটি আয়োজনে গিয়ে অবাকই হলাম, তারা কেউ ফোন টিপছেনা। সবাই মনোযোগী হয়ে একেকজন একেকজনের সাথে গল্প করছে। তাদের স্বপ্ন, সবাই একসাথে একটা প্র্যাট কিনে আজীবন একসাথে থাকার।

বন্ধুত্বের এমন ব্যাতিক্রমী গল্প এ প্রজন্মের মাঝে পাওয়া মুশকিল। এখানকার বন্ধুত্ব মানে সেলফিবাজি, গলাবাজি, অনিরাপদ সম্পর্ক। তাই এসব কিছু থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের উচিত প্রকৃত বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলোকে টিকিয়ে রাখা।